অষ্টমী স্নান সম্পর্কে দুই ধরনের পৌরাণিক কাহিনী
(এক)
ইতিহাস ঘেঁটে জানাযায়, কোন এক দূর অতীতে জমদগ্নি মহামুনির রেনুকা নামে এক রাজ বংশীয় পরমা সুন্দরী স্ত্রী ছিল। তাদের ছিল পাঁচ পুত্র। সর্ব কনিষ্ঠের নাম ছিল পরশু রাম। ঘটনাক্রমে মার্তিকাবর্ত দেশের রাজাকে সস্ত্রীক জল বিহার করতে দেখে আশ্রম বাসিনী রেণুকা কাম স্পৃহ হয়ে পড়েন এবং নিজের পূর্ব-রাজকীয় জীবন সম্পর্কে স্মৃতিবিষ্ট হন। মুনি স্ত্রীর এই আসক্তি দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে পাঁচ পুত্রকে তাদের মাতাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কোন পুত্রই মাতৃ হত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতে রাজি হলোনা। তখন মুনি তার প্রিয় পুত্র পরশু রামকে ডেকে বললেন, পুত্র,আমি কি তোমার পিতা? প্রশ্ন শুনে পরশু রাম অবাক হলেন এবং বললেন “হ্যা, অবশ্যই তুমি আমার পিতা। তখন জমদগ্নি ঋষি পুত্রের নিকট এসে অত্যন্ত আদুরে কণ্ঠে বললেন “ আমি যদি তোমাকে কোন কঠোর নির্দেশ দেই ,তাকি তুমি পালন করবে ”? পুর্বের মতো এবারেও পরশু রাম বলল, অবশ্যই। কেন করব না ? পুত্রের সম্মতি পেয়ে এবার জমদগ্নি ঋষি পুত্রকে নির্দেশ দিলেন “যাও, এই মুহূর্তে কুঠার দিয়ে তোমার মাতা ও চার ভ্রাতাকে হত্যা করো ”। পিতার এমন অমানবিক নির্দেশ শুনে পরশু রাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে। জমদগ্নি ঋষি পুত্রকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুনরায় নির্দেশ দেন- “যাও পিত্রাদেশ পালন করো। নচেৎ তুমি, আমার কঠিন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে”।
উপায়ান্ত খুঁজে না পেয়ে অবশেষে পরশুরাম কুঠারের আঘাতে নির্মম ভাবে তার মা ও ভ্রাতাদের কে হত্যা করে। কিন্তু একি কুঠার তো আর হাত থেকে খুলছে না। পরশু রাম তখন তার হাতে আটকে থাকা রক্তাক্ত কুঠার সমেত পিতৃ চরণে লুটায়ে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন “ পিতা, আমি তো পিত্রাদেশ পালন করেছি। এবার তুমি তোমার মহত্তে¡র গুণে আমার মা ও চার ভ্রাতাকে জীবিত করে দাও। পুত্রের কান্না দেখে পিতার মন অবশেষে শীতল হলো। ঋষি পরশু রামের মৃত মাতা ও চার ভ্রাতার জীবন দান করলেন। একটি সমস্যার সমাধান তো হল বটে কিন্তু পরশু রামের হাত থেকে কুঠার তো আর খুলছে না। আবার পরশু রাম পিতার চরণে মাথা রাখলেন। বললেন “ পিতা আমার হাত থেকে কুঠার খুলছেনা কেন? জবাবে ঋষি বললেন-
ঃ তুমি মাতৃহত্যা করার পাপে অভিশপ্ত। পাপমোচন না হওয়া পর্যন্ত কুঠার তোমার হাত থেকে খুলবেনা বৎস।
ঃ পিতা, আমি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো কি ভাবে ?-তুমি বলে দাও।- জানতে চায় পরশু রাম । অবশেষে জমদগ্নি ঋষি বললেন-
ঃ তুমি যদি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চাও,তাহলে তোমাকে ওই কুঠার হাতে আটকানো অবস্থায় সমস্ত পীঠস্থান ভ্রমণ করতে হবে। পীঠাস্থান ভ্রমণ শেষে তোমাকে যেতে হবে, কোশলের বষ্ণুদশা নামে পরিচিত দ্বিজের নিকট। তিনিই তোমার এই অভিশাপ মোচনের পথ দেখাবেন। কি আর করা? অবশেষে পরশু রাম পিতার পরামর্শ মতো অভিশপ্ত কুঠারটি হাতে নিয়েই পীঠস্থান ঘুরতে বের হলেন। গোটা ভারত বর্ষে যতগুলো পীঠস্থান আছে সর্বত্র এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এসে পৌঁছলেন কোশলের দ্বিজ বিষ্ণুদশার নিকট। বিষ্ণুদশা পরশু রামের অভিশপ্ত হবার সমস্ত কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং বললেন-
ঃ মানস সরোবরে যাও। দেবতা ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের বুকে হ্রদ রূপে লুকিয়ে আছে। পরশু রাম বিষ্ণু দশার নিকট থেকে ব্রহ্মপুত্রের মাহাত্ম্যের কথা জানতে পেরে ছুটে গেলেন মানস সরোবরে। তিনি খুঁজে পেলেন হিমালয়ে লুকায়িত ব্রহ্মপুত্র হ্রদ এবং প্রার্থনা জানালেন যেন এর পবিত্র জলে তার পাপ মুক্ত হয়। তিনি হ্রদের জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আটকে থাকা কুঠার খানা হাত থেকে খুলে গেল। এভাবে তিনি মাতৃহত্যার প্রায়শ্চিত্ত থেকে মুক্ত হলেন। ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন পাপ হরণকারী জল যাতে সাধারণ মানুষের উপকারে আসে সে উদ্দেশ্যে পরশু রাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তিনি কুঠার খানা লাঙলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসেন। মাতৃ হত্যার অভিশাপ থেকে মুক্তির দিনটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষের অষ্টম তিথি। (মহাভারত, পৃষ্ঠা-১০০৩ লেখক শ্রী কাশিরাম দাস)।
তখন থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জীবনের সকল পাপ মোচনের জন্য প্রতিবছর নির্দিষ্ট এই দিনটিতে স্নানের জন্য ছুটে আসেন কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরের ব্রহ্মপুত্র নদে। হিন্দু ধর্ম বিশেষজ্ঞগণ , মহাভারত, কলিকা পুরান, হিন্দুশাস্ত্র চৈতান্য চরিতামৃত বিভিন্ন শাস্ত্রে কাহিনী বর্ণনায় কিছুটা অমিল থাকলে ও মুল বিষয় বস্ত একই। তবে তীর্থের প্রকৃত স্থানটির ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতে, পরশুরাম কুড়িগ্রাম হয়ে পূর্ব বাংলা অথাৎ বর্তমান বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিনি চিলমারী নামক এলাকায় প্রথম বিশ্রাম নেন এবং পরে দক্ষিণে এগিয়ে যান। সে কারণেই প্রাচীন যুগ থেকে চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমীর ¯স্নান হয়ে আসছে।

পৌরণিক কাহিনী-২ (দুই)
‘লাঙ্গল বন্দ’ তীর্থের উৎপত্তি সম্বন্ধে কালিকা পুরাণ (৮৪/৮৫ অধ্যায়) আছে : শান্তনু মুনির পত্নী অমোঘা দেবী ব্রহ্মার তেজ গর্ভে ধারণকরে এক সুন্দর পুত্র সন্তান প্রসব করেন। প্রসবের পূর্বে মুনি উত্তরে কৈলাস, পূর্বে সম্বর্তক, দক্ষিণে গন্ধমাদন ও পশ্চিমে জারুধি এই চার পর্বতের মধ্যে একটি কুণ্ড খনন করে রাখেন। প্রসবান্তে পুত্রটিকে সেই কুন্ডে স্থাপন করেন এবং ব্রহ্মা এসে ঐ পুত্রকে দেখে নাম রাখেন ‘লোহিত্য’। কিছুদিন পরে পুত্র জলে দেহ বিস্তার করে কুন্ড মধ্যে অবস্থান করেন। সে হতে ইহা ‘ব্রহ্মকুন্ড’ নাম হয়।

ত্রেতা যুগে জমদগ্নি নামে এক মুণি ছিলেন। রেণুকার সাথে তার বিবাহ হয়। তাদের ছিল পাঁচ পুত্র সন্তান। কনিষ্ঠ সন্তানের নাম হলো পরশুরাম, বিষ্ণুর দশম অবতারের মধ্যে ষষ্ঠ অবতার। মহা তপস্বী জমদগ্নির সহধর্মিনী রেণুকা এক দিন নদীতে জল আনতে গিয়ে পদ্ম মালাধারী রূপবান চিত্র রথকে দেখে মোহিত হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং সময় মতো গৃহে ফিরবার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এদিকে হোমাদি কর্ম অতিবাহিত হল। জমদগ্নি ধ্যানে জানতে পারলেন রেণুকা অন্য পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। রেণুকার যখন গৃহের কথা মনে পড়ল তখন হতচকিত হয়ে দ্রুত গতিতে গৃহে এসে ক্রুদ্ধ পতির সম্মুখে অধোমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। জমদগ্নি তখন তার চার পুত্র রুমন্বান, সুষেণ, বসু ও বিশ্বাবসু কে ফল সংগ্রহ করে গৃহে ফিরে আসতে দেখে তাদের কে তীব্র ভাবে নির্দেশ দিলেন, তাদের মাতার মস্তক ছেদন করতে। কিন্তু তারা সবাই পিতৃ নির্দেশ পালনে পরামুখ হলেন। তখন জমদগ্নি সেই পুত্রদের অভিশাপ দিলেন, তোমরা জ্ঞানহীন জড়ের মতো হয়ে যাও।
সেই সময় কনিষ্ঠ পুত্র পরশুরাম সেখানে এসে পৌঁছালে জমদগ্নি তাকে নির্দেশ দিলেন বৎস, কোন প্রশ্ন না করে অক্ষুব্ধচিত্তে তোমার পাপা চারিণী জননীকে এক্ষুনি সংহার কর। পিতার প্রভাব পরশুরাম জানতেন। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ মাতার শির ছেদন করলেন।

তখন জমদগ্নির ক্রোধ শান্ত হল। তিনি প্রসন্ন হয়ে বললেন, বৎস আমার নির্দেশে তুমি অতি দুষ্কর কর্ম সম্পাদন করেছ। এখন তোমার অভিলাষ অনুসারে“বর”- প্রার্থনা কর। পরশুরাম বললেন, হে পিতা যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তাহলে আমার জননীর পুনজীবন লাভ হোক, আমি যে তাকে বধ করেছি সেকথা যেন তার স্মৃতিতে উদিত না হয়, আমার ভাইয়েরা পুনচৈতন্য লাভ করুক। জমদগ্নি তথাস্ত বলে পরশুরামকে তৎক্ষণাৎ সেই বর দান করলেন মাতা রেণুকা এবং ভাইয়েরা যেন নিদ্রা থেকে আনন্দে জেগে উঠলেন। কিন্তু পরশুরামের হাতে মাতৃ হত্যার ঐ কুঠারটি লেগে থাকে। পিতার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে পিতা বলেন ‘তুমি মাতৃ হত্যা আর নারী হত্যা’ এই দ্বিবিধ পাপেই আক্রান্ত হয়েছ। আর জেনে রেখো, পাপ ছোট বা বড় যা-ই হোকনা কেন কৃতকর্মীকে তা স্পর্শ করবেই।’
তারপর পুত্রকে আশ্বস্ত করে ব্রহ্মকুন্ডে স্নান করার উপদেশ দিয়ে বলেন ‘যে তীর্থ গমনে বা স্নানে তোমার হাতের কুঠার স্খলিত হবে, জানবে যে ঐ পুণ্য স্থানই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র।’
পিতৃ আজ্ঞায় পরশুরাম তীর্থ পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মকুন্ডে পৌঁছে স্নান করার সাথে সাথে তাঁর হাতের কুঠার পতিত হয়ে যায় এবং সর্ব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিথিটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি বুধবার পুনর্বসু নক্ষত্র। পরে পরশুরাম চিন্তা করলেন এমন সুমহান পুণ্য জনক জলকে সকলের সহজ লভ্য করার জন্য এর ধারা পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন। পিতৃ আজ্ঞায় ব্রহ্মকুন্ডের জলধারাকে এ পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য পরশুরাম হাত থেকে স্খলিত কুঠার দিয়ে ব্রহ্মকুন্ডের জলধারাকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত আনতে সক্ষম হন। তারপর লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে নারায়নণ গঞ্জ জেলার ‘লাঙ্গলবন্দ’ পর্যন্ত নিয়ে আসেন। সুদূর হিমালয় থেকে হাল চালনায় ক্লান্ত হয়ে পরশুরাম বিশ্রাম করার জন্যে এখানে লাঙ্গল বন্ধ রাখেন বলে স্থানটির নাম হয় ‘লাঙ্গলবন্দ’।
‘লাঙ্গলবন্দ’ স্নানে অধিক পুণ্যার্থী আসে। চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী বুধবার ও পুনর্বসুন ক্ষত্র যোগ হলে তাকে ‘বুধাষ্টমী’ বলে। প্রতি বার বছর পর পর এ তিথি একত্রে মিলিত হয়। আর এ সময় ব্রহ্মপুত্রে সর্বতীর্থের সমাগম হয় এবং তীর্থরাজে পরিণত হয়। এই ‘বুধাষ্টমী’ যোগে ব্রহ্মপুত্র স্নানে সর্বপাপ থেকে মুক্তি লাভ হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তির ইতিহাস কি বলে ?

দেশসমূহ-চীন, ভারত, বাংলাদেশ।
রাজ্যসমূহ- আসাম, অরুণাচল প্রদেশ । উপনদী – বাঁদিকে দিবাং নদী, লোহিত নদী, ধানসিঁড়ি নদী, ডান দিকে-কামেং নদী, রায়ডাক নদী, জলঢাকা নদী, তিস্তা নদী। নগরঃ গুয়াহাটি, তেজপুর, শিলঘাট । উৎসঃ- শিমায়াঙ-দাঙ হিমবাহ । অবস্থান ঃ-হিমালয়, চীন। উচ্চতাঃ-৫,২১০ মিটার (১৭,০৯৩ ফিট) । মোহনাঃ-বঙ্গোপসাগর, অবস্থানঃ- গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ, বাংলাদেশ।
ব্রহ্মপুত্র নদ বা ব্রহ্মপুত্র নদী এশিয়া মহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। সংস্কৃত ভাষায় ব্রহ্মপুত্রের অর্থ হচ্ছে “ব্রহ্মার পুত্র। ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব নাম ছিল লৌহিত্য। নদীটি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন অসমীযায়: লুইত , বাংলাদেশেঃ ব্রহ্মপুত্র নদ ইত্যাদি।
ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের নিকট জিমাইয়ংজং হিমবাহে, যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। জাঙপোনামে তিব্বতে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি অরুণাচল প্রদেশে ভারতে প্রবেশ করে যখন , তখন এর নাম হয়ে যায় সিয়ং। তারপর আসামের উপর দিয়ে দিহাঙ নামে বয়ে যাবার সময় এতে দিবং এবং লোহিত নামে আরো দুটি বড় নদী যোগ দেয় এবং তখন সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামে রমধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব বাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পড়েছে।
১৭৮৭ সালে ভূমি কম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত দিক পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদী হয় [সূত্র:নতুনবিশ্ব]। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য ২৮৫০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্র নদের সর্বাধিক প্রস্থ ১০৪২৬ মিটার (বাহাদুরাবাদ)। এটিই বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা হচ্ছে যমুনা। এক কালের প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদ বর্তমানে (২০১১) শীর্ণকায়। উপনদী ১. ধরলা। ২. তিস্তা ৩. দুধকুমার। ৪. করতোয়া আত্রাই প্রণালী । ৫. সুবর্ণ সিরি ।শাখানদী ১. বংশী ২. শীতলক্ষ্যা ৩. বানার ৪. সাতিয়া
অপর একটি সূত্র মতে, বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদী যমুনা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দের নিকট পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। কিন্ত আগে ব্রহ্মপুত্রের গতি গারো পর্বত মালার পশ্চিম দিক দিয়ে পূর্ব দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে জামালপুর, ময়মনসিংহ ও মধুপুর জঙ্গলের পাশ দিয়ে ও ঢাকা জেলার পূর্বাঞ্চল হয়ে নাঙ্গলবন্দ ও সোনারগাঁও পাশে রেখে শেষে নারায়নগঞ্জের ধলেশ্বরীর সাথে মিলিত হতো। করতোয়া এককালে একটি বিশাল ও হিন্দুদের পবিত্র নদী ছিল। এর পাশে ছিল মৌর্যদের বিখ্যাত পুন্ড্রবর্ধন নগর। জানাযায় যে ১৭৮৭ সালে তিস্তায় বড় বন্যা হয় এবংতার ফলে সে নতুন গতিপথ পায়।
প্রকৃত তীর্থ স্থান নাঙ্গলবন্দ না চিলমারী কোনটি?

প্রথম পৌরণিক কাহনিীতে পাওয়া যায়-
১. মানস সরোবরে যাও । দেবতা ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের বুকে হ্রদ রূপে লুকিয়ে আছে।
২. মানুষের উপকারে আসে এ উদ্দেশ্যে পরশুরাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তিনি কুঠার খানা লাঙলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসেন।

দ্বিতীয় পৌরণিক কাহনিীতে পাওয়া যায়-

১.শান্তনু মুনির পত্নী অমোঘা দেবী ব্রহ্মার তেজ গর্ভে ধারণ করে এক সুন্দর পুত্র সন্তান প্রসব করেন। প্রসবের পূর্বে মুনি উত্তরে কৈলাস, পূর্বে সম্বর্তক, দক্ষিণে গন্ধমাদন ও পশ্চিমে জারুধি এই চার পর্বতের মধ্যে একটি কুণ্ড খনন করে রাখেন।
২. প্রসবান্তে পুত্রটিকে সেই কুন্ডে স্থাপন করেন এবং ব্রহ্মা এসে ঐ পুত্রকে দেখে নাম রাখে‘লোহিত্য’।
৩ . সে হতে ইহা ‘ব্রহ্মকুন্ড’ নাম হয়।

১. পরশুরাম হাত থেকে স্খলিত কুঠার দিয়ে ব্রহ্মকুন্ডের জলধারাকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত আনতে সক্ষম হন। তারপর লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে নারায়নণগঞ্জ জেলার ‘লাঙ্গলবন্দ’ পর্যন্ত নিয়ে আসেন। সুদূর হিমালয় থেকে হাল চালনায় ক্লান্ত হয়ে পরশুরাম বিশ্রাম করার জন্যে এখানে লাঙ্গল বন্ধ রাখেন বলে স্থানটির নাম হয় ‘লাঙ্গলবন্দ’।

উ্ইকিপিডিয়িয় ব্রহ্মপুত্র নদরে উৎপত্তরি র্বণনা থেকে পাওয়া যায়-

১, সংস্কৃত ভাষায় ব্রহ্মপুত্রের অর্থ হচ্ছে “ব্রহ্মার পুত্র। ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব নামছিল লৌহিত্য।
২. ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের নিকট জিমাইয়ংজং হিমবাহে ।
৩. ব্রহ্মপুত্র হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয় ।
৪. ব্রহ্মপুত্র হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

এবার স্নানরে মন্ত্রটি পড়ুন-

“ ও ব্রহ্মপুত্র মহাভাগ শান্তোনঃ কুল নন্দন। অমোঘা- গর্ভ সম্ভূত পাপং লৌহিত্য মে হর। ত্বং ব্রহ্মপুত্র ভুবন তারণ তীর্থরাজ, গম্ভীর-নীর পরিপূরিত সর্ব্বদেহ । ত্বদ্দর্শ নং হরতু মে ভবঘোর দুঃখং সংযোগতঃ কালিযুগে ভগবন্নমস্তে।”

প্রিয়পাঠক, এতো বিষয় লিখলাম প্রকৃত স্নান স্থান কোনটি তা বিশ্লেষনের জন্য। নারায়ণগঞ্জের নাঙ্গলবন্দ। প্রতিবছর বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে অর্থ্যাৎ মহা-অষ্টমীতে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে অসংখ্য পুণ্যার্থী পুণ্যস্নান করতে আসেন। কিন্তু এখন এ নদের নাব্যতা না থাকায় পুণ্যার্থীরা ঐ ঘোলা জল বা কাদা জলেই পুণ্য স্নান করে থাকেন।কারণ সনাতনী বা পুরাণীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এ নদে পুণ্য স্নান করতে পারলে অতীতের সব পাপ ধুয়ে মানুষ শুদ্ধ হয়। লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নান করার ব্যাপারে কথিত আছে- এ নদের জল পুরাণোক্ত পরশুরাম মুনিকে পাপ মুক্ত করেছিল। অন্যদিকে মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র নদের যে স্থানে স্নান করে পরশুরাম মুনি পাপ মুক্ত হয়েছিলেন বর্তমানে সেটি নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে অবস্থিত। এ বিশ্বাস নিয়েই পুরাণীরা ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এখানে স্নান করতে আসেন। পুরাণোক্ত পরশুরাম মুনির পাপ মুক্তির কথা স্মরণ করেই কয়েক শত বছর ধরে পুরাণীরা অষ্টমী-পুণ্যস্নান উদযাপন করে আসছেন।
অষ্টমীর স্নানানের স্থান নিয়ে লেখকের নিজের বিশ্লেষন

১. নারায়নগঞ্জ জেলাটি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নয়।
২. ব্রহ্মপুত্র নদটির উৎপত্তির ইতিহাস বলছে, এটি কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তার অর্থ দাঁড়ায় চিলমারীর মাটিতে পরশুরামের পদ ধূলি প্রথম পরেছে।
৩. ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব বাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পড়েছে।
৪.১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত দিক পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদী হয়।
৫. শীতলক্ষ্যা নদী ব্রহ্মপুত্র নদের উপনদীও নয়, শাখা নদী মাত্র।
৬ পৌরনিক কাহিনী দুইটিতেই ব্রহ্মপুত্র নদের কথা বলা হয়েছে। এমন কি কাহিনী,কাহিনীর ব্যবহৃত স্থান,শব্দ এমনকি স্নেনানের মন্ত্রেও ব্রহ্মপুত্র ও লৌহিত্য শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। শীতালক্ষ্যা কিংবা ধলেশ্বরী বা লাঙ্গলবন্দ এসব কোন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি।
সুতরাং আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনেকরি, পরশুরামের চারণভূমি চিলমারী। ঘটনার যথার্থতা দাবি করে চিলমারীর অষ্টমীর স্ননাই প্রকৃত স্নান স্থান হওয়া উচিৎ। বাকিটা ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *