লেখক -রাধা রানী বিশ্বাস 

আজ বিশ্বমহিমের মনটা ভালো নেই । শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস পালিত হচ্ছে সারাদেশে । বুকের ভিতরটায় স্মৃতিগুলো তোলপাড় করে চলেছে । তার বাবাকেও ১৪ ই ডিসেম্বর ধরে নিয়ে গিয়েছিল । আর ফিরেনি কোনদিন । পুরনো একটা কাঠের আলমারি রাখা আছে তার ঘরে । এটা তার বাবা ব্যবহার করতেন। আলমারির পিছনের দেয়ালে মা বাবার ছবি বাঁধিয়ে রাখা আছে । ছবিতে চোখ যেতেই আস্তে আস্তে কাছে গেলেন । দাঁড়িয়ে মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে অনেকক্ষণ আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছবির দিকে ।  

 বুলবুলি ঘরে ঢুকে গরম চায়ের কাপ টেবিলে রাখছে। হাতে একটু গরম লাগায় কাপটা ঠকঠক শব্দ হল।  

 শব্দ শুনে বিশ্বমহিম বুলবুলিকে বললেন,” কিরে বুলবুলি তুই আজ কোন কথা বললি না যে? “

“মেজাজ ভালো নেই দাদু।”

 কেনরে? কি হয়েছে ? 

গতকাল কত রাত অবধি রান্না ঘরে কাজ করেছি । আজ

ভোর রাত থেকে শুরু করেছি আবার ।  

কাকিমা( অভিমানের স্ত্রী) একটার পর একটা কাজ দিয়ে যাচ্ছেন । 

নিজে একটুও হাত লাগাচ্ছেন না । 

মহিমবাবু বললেন,”বুঝতে পারছি। কিন্তু আজ এত কাজ কেনরে? “

বুলবুলি ব্রু কুচকে বলল,” আজ নাকি ফেস্ট আসবে। ফেস্ট কিগো দাদু? “

মহিমবাবু কাপটা মুখের কাছে নিয়ে আবার ফিরিয়ে আনলেন।  

গরম চা পরে যেতে পারে এই আশঙ্কায় । তারপর হো হো করে হাসলেন । শব্দ হয়নি কিন্তু হাসিতে তার পুরো শরীর কাঁপছে । বুলবুলি ভ্রু কুচকে তাকিয়েই আছে । বুলবুলি রাগ মিশ্রিত সুরে বলল,”তুমি আবার এভাবে হাসছ দাদু? তোমার হাসি শুকিয়ে গেছে জানতাম। “

মহিম বাবু হাসি থামিয়ে বললেন, ফেস্ট নয়,গেস্ট। 

মানে কি গো দাদু?

বিশ্বমহিম বুলবুলিকে বুঝিয়ে বললেন, ” মানে হল বাড়িতে অতিথি আসবে। “

কিন্তু.. আজ এত অতিথি আসবে কি কারণ রে বুলবুলি? 

কাকিমার নাকি আজ জন্মদিন। বলেই বুলবুলি চলে গেল । 

 কষ্টে মহিমবাবুর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আনমনা হয়ে ভাবনার সাগরে তলিয়ে গেলেন। 

অভিমানকে মানুষ করার জন্য নিজে সংসারী হলেন না। সেই অভিমান কি করে ভুলে যায়! 

অভিমান আমার মা বাবাকে দেখেছে । যেদিন আমার বাবাকে

ধরে নিয়ে যায়, দাদু….দাদু… বলে চিৎকার করে পিছনে ছুটেছিল । আমার দাদুর চোখ বেঁধেছে কেন ঠাকুরমা? ছেড়ে দিতে বল! আমার মা তার আদরের নাতিকে বুকে জাপটে ধরেন । নাতির সাথে চিৎকার করে কান্না করেছিল। 

মুক্তি যুদ্ধে যাওয়ার পর অনেকদিন কোন যোগাযোগ ছিল না আমার পরিবারের সাথে । আমার বোন গহনা রায়, যখন যুদ্ধে যাই তখন খুব কেঁদেছিল । যাওয়ার মুহূর্তে ফুপিয়ে কেঁদে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ” দাদা ভাল থাকিস। “

গহনা আমাকে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে বের হতে সাহায্য করেছিল। কারণ মা জানতে পারলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে দিতেন না। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া টগবগে যুবক।  

বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরটা গহনার চিঠি থেকে জেনেছিলাম । চিঠি লিখে এখানে ওখানে গুজে রাখতে রাখতে 

কিছুটা ময়লা হয়ে গিয়েছিল । 

একদিন রাতে কাউকে না বলে লুকিয়ে বের হয়ে যায় গহনা । আমার সহযোদ্ধা এবং বন্ধু তরণী বসুর বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। 

 সাহস করে কিছুদূর যায়, আবার গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। এভাবে তাদের বাড়ির গেটে গিয়ে পৌঁছায়। কলিং বেল না টিপে আস্তে আস্তে টোকা দেয়। তরনীর মা ভেবেছিল মিলিটারি আসছে । তরনী দৌঁড়ে আলমারির পিছনে লুকায়। তার বাবা ডায়বেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের রোগী । তাই তরণীর মা এগিয়ে আসেন । গেট খুলে দেখেন গহনা। 

গহনা তুমি! বলে হাত ধরে একটানে গেটের ভিতরে নিয়ে আসেন। 

এত রাতে তুমি এসেছ কেউ দেখে নাই! কেন এসেছ! 

না মাসি, কেউ দেখে নাই । নিরুত্তাপ উত্তর দিল । তারপর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেছিল, “শুনেছি তরনী দাদা তোমার সাথে দেখা করে গেছে । আবার যদি আসে, এই আশায় একটা চিঠি লিখে নিয়ে এসেছি। “

কোন ভাবে যদি আমার মহিম দাদার সাথে দেখা হয় । বাবার

খবরটা আমার দাদা জানেন না। ফিসফিস করে তরণীর মা বলেন, “তুমি ভিতরে যাও তরণী আছে।” গহনার বুকের ভিতর 

ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে । চাওয়াটা পূরণ হল এই ভেবে । আর তরণীকে একটু দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছে । কতদিন… দেখে না।

 তরণীকে দেখে চাপা কান্নাটা, দলা পাকিয়ে শব্দ করে উতরে উঠতে চাইলে, তরণী গহনার মুখ হাত দিয়ে আলতো করে চেপে ধরে কান্নাটা আটকায়। মাথায় হাত রেখে বলে, কেন এসেছ? বেশি সময় নাই। বের হয়ে যাব। মহিম এখনো পর্যন্ত ভালো আছে । যাওয়ার আগে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাব। কেউ দেখে ফেললে কত বড় বিপদ হতে পারত জাননা!

 শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা চিঠিটা বের করে তরণীর হাতে দিল। দাদার সাথে দেখা হলে দিয়ে দিও। বাবার খবর শুনেছ

নিশ্চয়ই । বলে আবার কেঁদে উঠল। তরণী গহনাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,বেঁচে থাকলে দেখা হবে। এরপর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল । আর এক মুহূর্ত সময় নাই চল। বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাই। মা বাবাকে সাবধান করে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। নিজে চাদর মুড়ি দিল। গহনাকে মাথায় আঁচল দিতে বলে গহনার হাত ধরে গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। 

আমার বোনটা তরণীকে এত ভালোবাসত! কোনদিন প্রকাশ করেনি। সব জেনেছি তরণীর কাছ থেকে । আর শেষ লেখা ঐ চিঠিটা থেকে। 

রক্তমাখা চিঠিটা বের করে ছুঁয়ে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে । 

কারণ চিঠিটায় গহনা আর তরণীর ছোঁয়া আছে। 

এই ভেবে উঠে কাঠের আলমারিটার দিকে যাবে, এমন সময় তার কানে ভেসে এল পাশের ঘরের আনন্দের কোলাহল আর খাবারের গন্ধ।

এতক্ষণ কষ্টের দরিয়ায় সাঁতার কাটছিলেন বিশ্বমহিম। 

সম্বিত ফিরে পেল বুলবুলির কথায়। গরম ভাতের থালা নিয়ে 

তাড়াহুড়ো করে ঢুকল । আর গড়গড় করে বলতে লাগল, 

“ও…দাদু.., জেগে আছ? আমি জানি তুমি বেশি তেলের খাবার খাবে না। তাই তোমার আর আমার জন্য গুড়া মাছ, সবজি আর শিং মাছের ঝোল করেছি । ” দাদু!

মহিম বাবু এবার মুখ খুললেন, “আমর জন্য তুই কেন কষ্ট করবি? এত কষ্ট করে রান্না করলি? তুই ওদের সাথে খেতে পারতি? “

নাগো দাদু তুমি যেটা খাবে না। আমিও খাব না। তাড়াতাড়ি ওঠ। এমনেই দেরি হয়ে গেছে । 

আমি জল নিয়ে আসতেছি । 

বিশ্বমহিম উঠে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন, নাহ্ না খেয়ে ত আর বাঁচতে পারব না। হাত ধুইয়ে আসি । আমি না খেলে বুলবুলিও খাবে না। 

মা মরা মেয়েটাকে স্বয়ং বিধাতা আমার দেখাশুনার জন্যই বোধ হয় রাস্তায় ফেলে রেখে গিয়েছিল…। 

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *