download

কামরুল ইসলাম হৃদয়,ব্যুরো প্রধান,চট্টগ্রাম:: চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে প্রতি রাতে পাচার হচ্ছে কোটি টাকার কাঠ। প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে মার্চ মাস পর্যন্ত চলে কাঠ পাচারের মহোৎসব।সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে শুরু করে সামাজিক বনায়ন কোনটাই রেহাই পাচ্ছেনা পাচারকারীদের হাত থেকে।এসময় পাচারকারীদের সাথে সহযোগিতায় পাল্লা দেয় স্থানীয় সরকারি বনবিট কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এ সাত মাস বনপ্রহরীদের কাছে ‘সিজন’ মৌসুম নামে পরিচিত। এসব বনপ্রহরীদের অবৈধ আয়ের প্রতিযোগিতা দেখে সুযোগ পায় কাঠ পাচারকারীরা।এতে করে সরকারি অর্থায়নে সৃজিত বন বাগান ধবংসের পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী।চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ফটিকছড়ির ৫টি রেঞ্জ অফিসের আওতায় ১৫টি বনবিট থেকেই একযোগে চলছে কাঠ পাচারের মহোৎসব। বনবিট, থানা পুলিশ, ও ক্ষমতাসীন দলের নেতার নামে ঘাটে ঘাটে প্রতিরাতে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায়ের হাট বসে। রাউজান ও হাটহাজারীর ইটভাটায় সিংহ ভাগ কাঠ সরবরাহ চলে ফটিকছড়ির এসব বনাঞ্চল থেকে।কাঠ পাচারের সংবাদ প্রকাশ করায় বনকর্মকর্তা ও পাচারকারীদের হাতে সাংবাদিক লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়াও কোন কোন সময় বনকর্মকর্তা ও পাচারকারীদের যোগসাজসে সংবাদ কর্মীদেও নামে মিথ্যা মামলা দেয়ার নজিরও রয়েছে।অনুসন্ধনে জানা যায়, নারায়নহাট রেঞ্জের নারায়ণহাট বনবিট, দাঁতমারা বনবিট, বালু খালী বনবিট, ধুরুং বনবিট, হাজারীখীল রেঞ্জের বারমাসিয়া বনবিট, ফটিকছড়ি বনবিট, হাসনাবাদ রেঞ্জের হাসনাবাদ বনবিট, তারাখোঁ বনবিট, হাটহাজারী রেঞ্জের শোভনছড়ি বনবিট, করেরহাট রেঞ্জের হেয়াকো বনবিট ও আঁধার মানিক বনবিট থেকে প্রতিদিন সামাজিক বনায়ন এবং রাজস্ব বনায়নের নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে।আকাশমণি, জারুল, জাম সেগুন, চাপালিশ, গামারি, কড়ই, গর্জন সহ নানা প্রজাতির গাছ দিনভর কাটে রাতভর সড়ক পথে পাচারের মহোৎসব চলে। রাত যতই গভীর হয় ততই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কাট পাচার।বিশেষ করে রাউজান ও হাটহাজারীর ইটভাটায় নির্বিঘ্নে এসব কাঠ পাচার করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে নাজিরহাটের প্রভাবশালী কাঠ পাচারকারী সিন্ডিকেট (তৈয়ব-জসিম) একটি সমিতিও করেছে। যাতে অন্য কেউ ঐসব ইটভাটায় কাঠ বিক্রি করতে না পারে।দাঁতমারা-হেঁয়াকো-রামগড়-সোনাইপুল সড়ক, দাঁতমারা-নারায়ণহাট-কাজিরহাট সড়ক, নারায়ণহাট-শ্বেতছড়া-মীরশ্বরাই সড়ক, গাড়িটানা-সাপমারা-কাজিরহাট সড়ক, কাজীরহাট-ফটিকছড়ি সড়ক, কাঞ্চনপুর-ফটিকছড়ি-লেলাং সড়ক, কাজিরহাট-নাজিরহাট-হাটহাজারী সড়কের উপর দিয়ে এসব কাঠ পাচার হয়।খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মানিকছড়ি থেকে কাজিরহাট সড়কে এবং রামগড় এলাকা থেকে নারায়ণহাট ও দাঁতমারা সড়কে কাঠ পাচার চলে।প্রত্যেক বনবিট ও থানা পুলিশকে জ্বালানী প্রতি জীপ গাড়ি ৪-৫শ টাকা, মিনি ট্রাক ১হাজার-১৫শ টাকা, বড় ট্রাক ২-আড়াই হাজার টাকা, টিসি ট্রাক ৩-৪ হাজার টাকা নিচ্ছে।গোল গাছ ও চিরাই গাছ হলে প্রতি জীপ গাড়ি ৮শ-১২শ টাকা, মিনি ট্রাক ৩ হাজার-৫হাজার টাকা, বড় ট্রাক ৮-১২হাজার টাকা, টিসি ট্রাক ১৫-২০হাজার টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে।সরেজমিনে ফটিকছড়ি সদরে ধুরুং বনবিটের ফ্রি-ম্যান লতিফ ওরফে বন লতিফ, ভূজপুর কাজিরহাট বাজার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণহাট বনবিটের আবদুস সালাম, ফটিকছড়ি বনবিটের কর্মকর্তা প্রদীপ, নারায়ণহাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বালুখালী বনবিটের লোকমান ওরফে মিয়া লোকমান, নারায়ণহাট বনবিটের সোহরাব, দাঁতমারা বাজারে দাঁতমারা বনবিটের বন প্রহরী আলমগীর কাঠ পাচারের গাড়ির পাস দিচ্ছে।আবার এসব চাঁদা আদায়ের জন্য নারায়ণহাট এলাকায় স্থানীয় কালেক্টর নিয়োগ দিয়েছে (ইজারার ভিত্তিতে) ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় ছাত্রনেতা ও যুবনেতার প্রভাবে। এখানে বন বিভাগের বিশেষ টহল বাহিনী (স্পেশাল নামে পরিচিত)’র নামেও মোটা অংকের চাঁদা তোলা হচ্ছে।ইটভাটায় জ্বালানী কাঠ সরবরাহকারী সাহাবুল আলম (৪৩) বলেন, ঘাটে ঘাটে চাঁদা না দিলে গাড়ি পার হয়না। আবার নাজিরহাটের কাঠ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়েও ব্যবসা করা যায়না।দাঁতমারা এলাকার কাঠুরিয়া আইয়ুব (৩৮) জানান, বন বিভাগের দখলদার এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকায় জ্বালানী কাঠের বাগান ক্রয় করেছি। এজন্য ইউপিডিএফ, জেএসএস বনবিট অফিস ও স্থানীয় নেতাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। আবার গাড়ি প্রতি চাঁদাও দিতে হচ্ছে।নারায়ণহাট বনবিটের সন্ধিপ পাড়া এলাকার বাসিন্ধা কিছমত আলী (৫৫) বলেন, এখানে আমাদের বসতি প্রায় ২০-৩০ বছর। আমাদের রোপিত গাছ কাঠতে ও প্রতি বছর বনবিট অফিসকে চাঁদা দিতে হয়। না হলে উচ্ছেদ হতে হয়।নাম প্রকাশে অনিশ্চুক সামাজিক বনায়নের লট ক্রেতা (নিলাম ক্রেতা) এক ব্যবসায়ী বলেন, নিলামে বাগান ক্রয় করে সরকারী কোষাগারে সব টাকা জমা দিয়ে, সব নিয়ম মেনে গাছ কাটতে আসার সময় বনবিট ও রেঞ্জ কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হচ্ছে।এ ব্যাপারে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধ কমিটির সভায় কঠোর ভাবে সকলকে অবহিত করা হয়েছে। কাঠ পাচার রোধে বন বিভাগের পাশাপাশি উপজেলা ও জেলা প্রশাসন থেকে কাঠ পাচারের অভিযান চালানো হবে। বনবিট, রেঞ্জ ও পুলিশ কর্তার নামে চাঁদা তোলার ব্যাপারে তদন্ত করে আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের প্রধান বন কর্মকর্তা মো: জগলুল হোসেন বলেন, বনবিট ও রেঞ্জ অফিস রাখা হয়েছে বনায়ন রক্ষার জন্য। কাঠ চোরের সাথে যোগসাজস করে বন ধ্বংস করে কাঠ পাচারের জন্য নয়। সব সড়কে শীতকালীন বিশেষ টহল টিম (স্পেশাল টিম) সক্রিয় করা হবে এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *