( পর্ব-১)

লেখক- রাধা রানী বিশ্বাস 

হালকা হিমেল হাওয়া বইছে আজ । বারান্দায় লাগানো ঝুলন্ত 

টবে ফুল গাছটা পেন্ডুলাম ঘড়ির কাটার মত দুলছে । অস্তরবি যাই যাই করছে দিগন্তকে ছুঁয়ে দেখার জন্য । এই আনন্দে সোনালী রোদ বারান্দায় গড়াগড়ি খাচ্ছে । ফুল গাছের ছায়াটা 

গাছের সাথে তালে তালে দুলছে ।  

বিশ্বমহিম রায় বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে বসে আছেন আরাম করে । ডান বাহুর নিচে এক প্যাচ দিয়ে শূন্য বানিয়ে শালটা গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন । পা দুটো ঠান্ডা হয়ে যায় তাই 

আজ মোজা পড়েছেন । প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে তিনি এভাবে বসে থাকেন । বসে বসে সূর্য ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে ভালোবাসেন তিনি । কেমন করে রক্তের মত লাল সূর্যটা ধীরে ধীরে নিচে নামে। দিগন্ত যেন বাহু মেলে অপেক্ষা করতে থাকে।   

সূর্যটাও তার মায়ায় কেমন করে আত্নসমপর্ণ করে।  

আর তখনই চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে ।  

অন্ধকার নামলে বিশ্বমহিম রায়ের মনটা কেমন খারাপ লাগতে শুরু করে । চিন্তায় পড়ে যান কিভাবে পার করবেন পুরো রাতটা। আজকাল ঘুম তার সোনার হরিণ । বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে পাখির কোলাহল শুরু হয়ে যায়। জীবনের কতগুলো বছর পার করেছেন একা একা ।  

দূরে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকা বড় গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর বিড়বিড় করে বলেন, “গাছ তোরও তো অনেক বয়স হয়েছে । তুই আর আমি একই সাথে বড় হয়েছি । আমি বুড়ো হয়েছি আর তুই বলিষ্ঠ, শক্তিশালী হয়েছিস। যেনতেন বাতাস তোকে নাড়তে পারে না । আমিও একদিন তেমন ছিলাম । “

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার কথা বলতে যাবে, এমন সময়

বারান্দার লাইটের সুইচটা টস করে উঠার সাথে সাথে বাতি জ্বলে উঠল। 

বাসার কাজের দেখভাল করা মেয়েটি চিৎকার করে বলে,”দাদু ঘরে যাও দিকিনি।তোমার জন্য বারান্দাটা ঝাড়ু দিতে পারলুম নে। ” 

বিশ্বমহিম বাবুর আদরের কুকুরটা এসে পায়ের কাছে বসল।  

চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে হুহ্.. শব্দ করে পিঠ টান করে বললেন, “হারে বুলবুলি তুই আর বুলু না এলে টের পেতাম না। কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । “

বুলবুলি আধা ভিজা কাপড় গুলো দড়ি থেকে টেনে নামাচ্ছে । 

আর একপাশে তাকিয়ে নিচের বস্তিতে ঝগড়া দেখছে।

 ” প্রেত্যক দিন ঝগড়া শুনতে ভাল্লাগে না। ” বলে ঘরে ঢুকে গেল। 

 “বুলবুলি ! অলংকার দাদু ভাই ঘরে ফিরেনি? ” মহিমবাবু কোন উত্তর না পেয়ে তাকিয়ে দেখেন বুলবুলি চলে গেছে । বিশ্বমহিম বাবু কুকুরকে বলল,”চল বুলু, ঘরে চল। “

 বুলু বিশ্ব মহিমের পিছে পিছে লেজ নেড়ে হেঁটে গেল। এই বাড়িতে তার কথা বলার লোক এই বুলু আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বড় গাছটা। 

বুলবুলিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না। এমনিতেই সব গড়গড় করে বলে। পেটে কথা পঁচে না। তাই বিশ্বমহিম 

বুলবুলির সাথে দরকারি কথা ছাড়া কিছু বলেন না।  

বিশ্বমহিম রায় যে বাড়িটায় থাকেন। সেটা উনার পৈত্রিক বাড়ি। তার বাবা সরকারী চাকুরী করতেন । পেনশনের টাকা

আর স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে এই দোতলা বাড়িটা কিনেছেন । 

কিস্তিতে টাকা মিটাবেন এই শর্তে। যুদ্ধের সময় দরজা জানালা ক্ষতি হয়েছে বটে। তবে তার পরিবারের একমাত্র বেঁচে যাওয়া ভাইপো অভিমান রায় মেরামত করে আধুনিক করেছেন বাড়িটা । অভিমানকে লেখা পড়া করিয়ে মানুষ করছেন বিশ্বমহিম বাবু । 

ভাইপো তার বউ আর নাতি অলংকার কে নিয়ে তার সংসার । 

এখন এই বুড়ো বয়সে তার বিশ্বস্ত সঙ্গী বুলু। কারণ অভিমান রায় ব্যবসা নিয়ে ব্যাস্ত। বউমা ব্যস্ত থাকেন শপিং পারর্লার নিয়ে। আর গহনার নতুন ডিজাইন কি এল সেগুলো নিয়ে

সারাদিন ফোনে ব্যাস্ত থাকে। মন চাইলে জিজ্ঞেস করে, “কাকাবাবু খেয়েছেন?”

নাতি অলংকার বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে নিজের ঘরে হৈ-হুল্লোড় করে । 

পুরো সংসারটা সামলায় বুলবুলি । মা মরা বুলবুলিকে বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন বিশ্বমহিম বাবু । এই দুনিয়ায় বুলবুলির আর কেউ নাই । যুদ্ধ শেষে ফিরার সময় রাস্তা থেকে ছোট্ট বুলবুলিকে কুড়িয়ে আনেন মহিমবাবু। মহিমবাবু অনেক চেষ্টা করে দূরসম্পর্কের একজন আত্নীয়কে খুঁজে বের করেছিলেন। বলেছিলেন, ” আমি বিয়ের খরচ দিব ওর জন্য গ্রামে একটা ছেলে দেখ। শহরে আমি কোথায় খুঁজবো । আমার বয়স হয়েছে । “

সেই লোক সম্মতি জানিয়ে যে গেল আর আসেনি। বুলবুলিও

এ বাড়ি ছেড়ে যাবেনা বলে হাতে পায়ে ধরে মহিমবাবুর । সারাদিন বাড়ির সমস্ত কাজ করে । 

মাঝে মাঝে মহিমবাবু বলেন,”বুলবুলি তোর কি ক্লান্তি নেই “

খিলখিল করে হাসে আর বলে,” দাদু আমি ছাড়া তোমার কে আছে? ” আমি কাজ না করলে হবে? “

মহিমবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে বসে থাকা কুকুরটায় মাথায় হাত বুলায়। আর বলতে থাকে,” হারে বুলবুলি ঠিক বলেছিস।

তুই আর বুলু আমার মনের কথা বুঝতে পারিস। ” দেখ বুলু

সব সময় আমার সাথে থাকে । একটুও নড়ে না। 

বুলবুলি আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়ে। হাগো দাদু তুমি না থাকলে আমি বাঁচতুম না। তুমি অনেক দিন বেঁচে থাক। “

বুলবুলি চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেল । মহিম বাবুর 

চোখের কোনে জল চিকচিক করছে । হাতে চোখের জল মুছতে দেখে কুকুরটা কান্নার মত ঘেউ ঘেউ করে গা ঘেষতে লাগলো মহিমবাবুর। 

বাড়িটা ঘিরে নারিকেল গাছ। বারান্দার পাশে নিচ তলায় একটা কামিনী ফুল গাছ। রাতে বেশ গন্ধ ছড়ায়। তারই পাশে 

মস্ত একটা বকুল গাছ । মহিমবাবুর অনুরোধে তার ভাইপো ইট দিয়ে গোল করে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে । বিশ্বমহিম বুলুকে নিয়ে গাছটার গোড়ায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন । আর মনে মনে স্মৃতির পাতা উল্টে উল্টে দেখছেন। 

বুলবুলি তার চিন্তার বাঁধন ছিড়ে দেয়,”ও….দাদু অমন মূর্তির মতন বসে আছ যে।তোমার গরম জল ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । “

বুলবুলি তার সমস্ত কাজ দায়িত্ব নিয়ে করে। ঠিক সময়ে স্নানের জল দেওয়া, ঔষধ দেওয়া,খাবার দেওয়া সব কিছু । 

বুলবুলি না থাকলে তার যে কি হত। এই ভেবে বুলুর গলার শিকলটা ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *