—আব্দুল খালেক ফারুক
গলির মোড়ে ঢোকার মুখে কচ্চপের মতো মাথাটা বের করে সন্তর্পণে চারপাশটা ভাল করে দেখে নেয় সাজিদ। বরাতটা ভালই মনে হচ্ছে। আশেপাশে কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না। অনেকটা নি:শঙ্কচে পথ চলতে শুরু করে সাজিদ। হঠাৎ কোত্থেকে যম দূতের মতো উদয় হলেন বিবিসি চৌধুরী। যাত্রা শুভ ছিল না। তাই কট এন্ড বোল্ড হতে হলো। বিবিসি চৌধুরীকে যমের মতো ভয় পায় সাজিদ। অথচ তার হাতেই ক্যাচ আউট হতে হলো; আলগা শট খেলা নালায়েক ব্যাটসম্যানের মতো।
—এই যে বাবা সাজিদ— সেই মোহময় আহবান। অগ্রাহ্য করার সাধ্য কার? অগত্যা বলির পাঁঠার মতো পা টেনে টেনে কাছে এলো বিবিসি চৌধুরীর।
— শোন বাবা । দিন কয়েক যাবৎ তোমাকেই খুঁজছিলাম। জরুরি কথা আছে তোমার সাথে।
এইরে সেরেছে। বিবিসির জরুরি আলাপ মানেতো পুর্ণদৈঘ্য লেকচার। বেশরিভাগই খাজুরা আলাপ। শুধুই বকবক। একবার শুরু করলে বিরতিহীন এক্্রপ্রেস। এই এলাকায় তিনি বিবিসি চৌধুরী নামে খ্যাত।
বিবিসির আসল নাম জামায়েত চৌধুরী। ‘বাচাল ব্রডকাষ্টিং কপোর্রেশন’ সংক্ষেপে বিবিসি। সাথে বংশীয় পদবি চৌধুরী। তিনি ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের হেড মাষ্টার। এখন অবসরে। হাতে অফুরন্ত সময়। কথা বলার জন্য শিকার খেঁাজেন সব সময়। একবার কথা শুরু করলে থামতে চান না। দাঁড়ি ,কমা, সেমিকোলন তাঁর ব্যাকরণে নেই। পাড়ার মুরুব্বিরাতো বটেই, মধ্য বয়সী, অল্পবয়সীরাও তাকে যমের মতো ভয় পায়। তাকে দেখলেই অনেকে কৌশলে কেটে পড়েন। একবার বাগে পেলে দিন কাবার। সাজিদও একজন ভূক্তভোগী। সে কারণে প্রতিদিন বাসা থেকে বেরুনোর পর কয়েকবার দোয়া ইউনুছ পড়েন। আল্লাহ্র কাছে এই জুলুমবাজের হাত থেকে পানাহ্ চান। কোন দিন আল্লাহ্পাক কবুল করেন। কোন দিন কবুল করেন না। আজ যেমন, সাবধানে সন্তর্পণে চলেও রেহাই মিলল না। ভাবতে ভাবতে বিবিসির সাথে হাঁটছে সাজিদ।
বিবিসির গন্তব্য এখন সিরাজ মিয়ার টি স্টল। স্টলের এক কোণায় একটি ফাঁকা টেবিল দখল করে বসে পড়লেন বিবিসি। সাজিদকেও বসতে বললেন। চড়া গলায় অর্ডার দিলেন— সিরাজ জলদি দু’কাপ চা লাগাও।
সিরাজ মিয়ার দোকানে এখন কাষ্টমারের তেমন ভীড় নেই। ভীড় বাড়বে বিকেল থেকে। তখন জিলাপি, পিঁয়াজুসহ নানান পদ তৈরী হবে। একহাতে ক্যাশের ড্রয়ার আগলে কাস্টমারের ফাই ফরমায়েস পালন করবে সিরাজ।
—সিরাজ সময় কম, জলদি লাগাও। সিরাজ মনে মনে বিরক্ত হয়। আজও মনে হয় লক্ষী বাগড়া দিল। ব্যাটা একবার টি স্টলে বসলে তো চেয়ারের সাথে লেপ্টে যায়। অনবরত বকবক করবে। মুরুব্বি মানুষ ওভাবে গ্যাট হয়ে বসে থাকলে চ্যাংরা কাস্টমাররা উঁকি ঝঁুকি মেরে হটে যায়। তাতে সিরাজের বিক্রি যায় কমে। কিছু বলাও যায়না। মহাবিড়ম্বনা।
— চাচা বলেন। বেশীক্ষণ সময় দিতে পারব না। ডিসি অফিসে একটা জরুরি কাজ আছে।
—আরে রাখ তোমার জরুরি কাজ। ইরাকের খবর শুনেছ?
—না। সাজিদ উজবুকের মতো মাথা নারে।
—তা জানবে কেমন করে। ইরাকে পাল্টা হামলা শুরু হয়েছে। বুশ এখন আবল তাবল বকছে। আরে ব্যাটরা মুসলমানদের কাৎ করা অত সোজা? এবার বুশ ব্যাটা বুঝবে ঠেলা কাকে বলে। থ্রিব্যান্ড রেডিওটা সারাতে মেকারের দোকানে দিলাম। মনে হয় গরম খবর আসছে। গেরিলা হামলার মুখে ইহুদি নাসারাদের অবস্থা হয়েছে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
— চাচা কিছু মনে করবেন না। আফগানিস্তানের যুদ্ধের সময়তো আপনি একই কথা বলেছেন।
— বোকা ছেলে। যুদ্ধের নানান টেকনিক থাকে। এটা হচ্ছে ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড, টু স্টেপ ব্যাক। আপাতত লাদেন ভায়া ঘাপটি মেরে কোন পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে আছে। সুযোগ মত খপ করে বুশের টুটি চেপে ধরবে। খপ করে টুটি ধরার এ্যাকশন দেখাতে গিয়ে মুহূর্তে বিপত্তি ঘটে। হাঁটুর ধাক্কায় টেবিলের উপর রাখা চায়ের কাপের পতন ঘটে। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বিবিসি বয়কে টেবিল পরিষ্কার করে আরো দুকাপ চা দেয়ার হুকুম জারি করে। এই সুযোগে সাজিদ ওঠার কোশেশ করতেই বিবিসি তার ঘাড় ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
— আরো আরে উঠছ কেন?
— চাচা জরুরি কাজ ছিল।
— এত অস্থির হচ্ছো কেন। যা হোক যা বলছিলাম। ইরাকের যা পরিস্থিতি তাতে মুসলমানদের শক্ত জিহাদ করা ছাড়া আর কোন রাস্তা দেখি না। তোমাদের মত নওজোয়ানরা জিহাদে অংশ না নিয়ে কেন বসে বসে ফিডার খাচ্ছ বুঝতে পারছি না। নপুংশক আর কাকে বলে!
— চাচা কিছু মনে করবেন না। আপনার মধ্যে যে জিহাদী জোশ দেখছি, তাতে আপনার উচিৎ যুদ্ধের ময়দানে যাওয়া।
— বয়স বুঝেছ, বয়সটা বাগরা দিচ্ছে। যুবাকালে দশগ্রামে আমার মত সাহসী মানুষ ছিল না। সিক্্রটি ফাইভের ওয়ারে হাতের একটা আঙ্গুল হারালাম। আর সেভেনটি ওয়ানে হারালাম পায়ের একটা আঙ্গুল। অল্পের জন্যে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিটা পাইনি। আরে ও সব হাসিল করতে লবিং লাগে। পাক বাহিনীর গুলির শব্দে যাদের প্যান্ট নষ্ট হয়েছিল’ তারাই এখন বড় বড় উপাধি বাগিয়ে বসে আছেন। ইনসাফ কোথায়? সব জায়গায় যোগ্যতার অবমূল্যায়ন। এই জাতি কি আরো উপরে উঠবে ভেবেছ? কোন বাপের সাধ্য নেই পতন ঠেকায়।
— চাচা আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
— আরে ঠান্ডা হয়ে যাবে কোথায়। বরফতো আর হবে না। প্রাণ খুলে কথা বলার লোক পাইনা। তোমাকে ভাল ছেলে বলে জানি। তাই মাঝে মধ্যে তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। জালি লোকে দেশ ভরে গেছে। মিশব কার সাথে? তা তুমি আবার বিরক্ত হচ্ছ নাতো বাবা?
সাজিদ প্রমাদ গোণে। কৃত্রিম ভদ্রতা দেখিয়ে বলে ‘না না ঠিক আছে।’ মনে মনে অবশ্য গালি দেয়। শালা বাচাল।
সিরাজ আড়চোখে আর একবার বিবিসির দিকে দেখে তাকে তাড়াতে ইচ্ছে করেই ক্যাসেটের ভলিয়মটা বাড়িয়ে দেয়। মমতাজের হিট গান ‘টাইম হলে যাইতে হবে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই’ বাজতেই বিবিসি হুংকার দেন।
—সিরাজ মিয়া ক্যাসেটটা বন্ধ কর। দেখছনা গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করছি। কমনসেন্সের অভাব। স্টুপিড। ধমকে চুপসে যায় সিরাজ। ভলিয়মে হাত রেখে সাউন্ডটা একেবারে কমিয়ে দেয়।
—হ্যা যা বলছিলাম। তুমিতো জান আমার মেয়ে জামাই শিয়ালকোর্টে থাকে। কাল মেয়ের একটা চিঠি পেলাম। বোম ফাটানো তথ্য। লাদেন আর মোল্লাহ ওমর নাকি আবার তালেবোনদের সংঘটিত করছেন। পারভেজ মোশারফের অবস্থা এমনিতেই কেরোসিন। তার উপর তালেবানদের ঠ্যালায় এবার তার গদিই উলটে যেতে পারে। মুসলমান হয়ে ইহুদি নাসারার দালালি ? আল্লাহ্র গজব কত প্রকার ও কি কি এবার ব্যাটা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
— চাচা এবার উঠব।
— আরে উঠবে কি। আসল কথাইতো বলাই হয়নি। আমার বড় ছেলে— চেনতো? সফিউর রহমান চৌধুরী। এবার রাষ্ট্রপতি পদক পেতে যাচ্ছে।
— কি বিষয় চাচা।
— ভেরি ইন্টারেষ্টিং বিষয়। সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরছিল সফিউর। তখন দিনের আলো কেবল নিভে আসছে। এরই মধ্যে তিন ছিনতাইকারী তার পথ আগলে দাঁড়ায়। সফিউর জীবনবাজী রেখে একজনকে ঘাড় মটকে ধরে ফেলে। অন্য দ’ুজন ভয়ে প্রস্রাব করতে করতে পগারপাড়। সা¤প্রতিক ইতিহাসে এমন বিরত্ব বিরল। আমি ছেলের এই বিরত্বে মুগ্ধ। বীর পিতার মহাবীর পুত্র। এবার পুরস্কারটা হাতছাড়া না হলেই হয়। দেশের যা অবস্থা। সিরাজ মিয়া পাতি মেরে আরো দু’কাপ চা লাগাও।
সিরাজ মিয়া আড়চোখে দেখে। আগুন ঝড়া দৃষ্টি। ভাবছে আপদটা কখন বিদেয় হয়। আট আনার চা খেয়ে এক কোটি টাকার গপ্পো হাকায়। এরই মধ্যে অল্প বয়সী কয়েকটা ছোকরা উঁকি মেরে চলে গেছে। আর কতক্ষণ ব্যবসার বেইজ্জতি হয় কে জানে। ঠিক সেই সময় দূরে কোথাও চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল। আগুন আগুন বলে চিৎকার কানে আসছে। সাজিদ এই সুযোগে উঠে দিল দৌড়। বিবিসি তখন দাঁড়িয়ে বোকার মত। দৌড়াতেও পারছেন না। আবার বসে থাকতে পারছেন না। ভাবছেন এটা ট্রানজিট টাইম। হৈ—হল্লা কমলে আবার শিকারে বের হতে হবেন। দেখা যাক, নতুন কাউকে পাওয়া যায় কিনা।
****লেখক-কবি,সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *