ষ্টাফ রিপোর্টারঃ
সাত বছর আগে ভারতীয় গরু আনতে বিএসএফ’র গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল বাবার আর একই কাজ করতে গিয়ে বিএসএফ’র হাতে ধরা পড়েছে আশরাফুল। এদিকে ৫সদস্যের সংসারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে সংসার চালাতে তার ছোট্্র ভাই নেমেছেন রাখালের কাজে।
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার শিলখুড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ ধলডাঙ্গা গ্রামের মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে আশরাফুল (২০)। বিয়ে করেছে তিন মাস আগে। অভাবী সংসারের হাল ধরতে একটি বেসরকারী সংস্থা ঠেঙ্গামারা থেকে ঋণ নিয়ে অটোরিক্সা কিনে চালাচ্ছিল। এরমধ্যে তার বিদ্যুতের বিল বাকী পড়েছে প্রায় সাড়ে ১০হাজার টাকা। অফিসের লোকজন চাপ দিচ্ছিল এ টাকা শোধ না করলে তার সংযোগ কেটে দেয়া হবে। এদিকে অটোরিক্সাসহ সপ্তাহে ৫টি কিস্তি শোধ করতে হয় প্রায় ৭হাজার টাকা। সব মিলিয়ে দিশেহারা আশরাফুল গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে ভারত থেকে গরু আনতে যায়।দক্ষিণ বাঁশঝানি সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় ভারতের দীঘলটারী বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাকে আটক করে। এ সময় তাকে নির্যাতন করে বিএসএফ। পরে আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে তারা। গত শুক্রবার তার পরিবারের লোকজন জানতে পারে বিএসএফ তাকে কোর্টে তুললে ৫ বছরের জেল দেয় ভারতীয় আদালত। এ খবরে পরিবারের সদস্যদের আহাজারীতে ভারী হয়ে এসেছে এলাকার পরিবেশ। সোমবার আশরাফুলের বাড়িতে গেলে কান্নার রোল পড়ে যায়।
আশরাফুলের মা আমেনা বেগম বলেন, পোলাডা টাকার চাপে গেছে সীমান্তের মধ্যে কি হয়া গেইল। এ্যাহন কী করে এই ছোট বাচ্ছাদের পালমু।
আশরাফুলের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সাথী জানায়, বিসসুধবার সন্ধ্যার পরে অটো চালায়া আইয়া কইলো ভাত দে। আমি ভাত বাউড়া রাখলাম। হেয় কইলো দোকান থেকে আহি। আর আহে নাই। কী হইবো আমার। স্বামীরে বাঁচানোর ব্যবস্থা কইরা দেন। এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কম বয়সী এ গৃহবধূ। আশরাফুলের মা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩ শতক জমিতে কোন রকমে তিনটি ঘর তুলে সবাইকে নিয়ে থাকছেন। ছোট বোন আল্পনার বিয়ে দিয়েছিল তিন মাস হয়ে গেল। ছোট দুটি ভাই আল আমিন (৯) ও সুমন (৭)। সুমন স্কুলে যায়।
বড় ভাই না থাকায় এরমধ্যেই সংসারে হাল ধরেছে আল আমিন। ভারত থেকে পাচার হওয়া গরু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভূরুঙ্গামারী হাটে নিয়ে যাচ্ছে। একটি গরু নিয়ে গেলে আড়াইশ টাকা পাওয়া যায়। এ টাকায় কোন রকমে চলছে তাদের সংসার।
ছোট ভাই আল আমিন বলে, স্কুলে যেয়া কি করমু। হামারতো পেটে ভাত নাই। মা,নানী,হোডো ভাই আর ভাবী কী খাইবো। এজন্য গরু নিয়্যা আহি।
আশরাফুলের নানী জোহরা বেওয়া বলেন, সাত বছর আগে জামাইটাকে বিএসএফ মাইরা ফ্যালাইলো। তিনদিন পর লাশ পাইছি দুধকুমার নদীতে। এ্যাহন নাতীন ডারে জেলে দিছে। কী হইবোআমগোরা এই সংসারটার। প্রতিবেশী হযরত আলী বলেন, ছেলেটা অটোরিক্সা চালাতো। অভাবী সংসার কিস্তির চাপে গেছে বাড়তি আয় করতে। গিয়ে আটকে গেছে। সে ছাড়া না পেলে বাড়ির লোকজন না খেয়ে মরবে। আনোয়ারা বলেন, এ্যাহনতো খাইয়া, না খাইয়া দিন যাচ্ছে। কিস্তি গুলো দিবে ক্যামন কইরা? হেই চিন্তায় করতাছি। স্থানীয় জিয়ারুল হক বলেন, সবাই চায় সীমান্তে না যাইতে। কিন্তু এখানে একদিনে ৩/৪ হাজার টাকা কে দিবে। বাংলাদেশে এমন কোন কাজ নেই একদিনে এত টাকা আয় হবে। এজন্য অনেকে যায়। কাজ থাকলে যাইত না।
শিলখুড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদ আলী বলেন,আমরা সীমান্তে সীমান্তে লোকজনদের সচেতন করতে সভা সমাবেশ করছি প্রতিনিয়ত। এখানকার সবাই অভাবী। নদী ভাঙ্গন আর চরাঞ্চল এলাকা। সংসার চালাতে তারা গরু আনতে যায়। যদি এখানে সরকারী ভাবে গরু পালনের ব্যবস্থা করা যেত। সহজ শর্তে ঋণে যুবকদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহন করা গেলে এ ঘটনা গুলো ঘটতো না। তবে বিজিবির ধলডাঙ্গা বিওপির কমান্ডার হাবিলদার আলমগীর হোসেন বলেন, আশরাফুল নামের কাউকে বিএসএফ ধরেছে। এমন খবর আমরা পাইনি। তবে এখন যেহেতু জানা গেল তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে।
কুড়িগ্রাম ৪৫ বিজিবির অধিনায়ক লে.কর্ণেল জাকির হোসেন বলেন,গত ছয় মাস থেকে ৫০টির বেশি সীমান্ত এলাকাবাসীদের নিয়ে আমরা বিভিন্ন সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছি। কিছু মানুষ তারা লোভে পরে বিজিবি’র চোখ ফাঁকি দিয়ে গরু নিয়ে আসে। আশরাফুলের বিষয়টি আমাদের জানান নেই তবে আমরা খোঁজ নেবো।