mail.google.com
—- মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভূইয়া —
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, উপমহাদেশের মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এ অঞ্চলের সকল নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রবক্তা।

১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জনসম্মুক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না এবং এ ব্যাপারে কোন আপোষ সম্ভব নয়, আপোষ চলবে না।’’ সেদিন তাঁরই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশের আজাদী প্রিয় মানুষ ও ভাসানী অনুসারীরা স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুুতি নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেদিনের জনসভায় মওলানা ভাসানীর ‘‘পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন’’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেও জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আলোচনা চলতে থাকে। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই ২৫ মার্চ ৭১ এর কালো রাত্রিতে পাকিস্তানের সামরিকজান্তা ইয়াহিয়ার নির্দেশে নিরস্ত্র বাঙালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় আমাদের দেশের হাজার হাজার নারী পুরুষকে।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙ্গালীদের উপর যখন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন মওলানা ভাসানী অবস্থান করেছিল টাঙ্গাইলের সন্তোষে। সে সময় টাঙ্গাইলে সন্তোষ ছিল পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এ সম্পর্কে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম লিখেছেন ‘৩রা এপ্রিল হানাদার টাঙ্গাইলে এলে আমরা মাটিয়াচরায় বাধা দিলাম। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ওদের তিন/সাড়ে তিন শত সৈন্য আহত নিহত হলেও ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। মুক্তিবাহিনী ও আমাদের পক্ষীয় ইপিআর-এর ১৬ জন শাহাদাতবরণ করলো। হানাদাররা টাঙ্গাইলে ঢুকেই বদিউজ্জামান খান, আসাদুজ্জামান ও আমাদের আকুর টাকুর পাড়ায় বাড়ি ধ্বংস করলো। পরদিন গেল সন্তোষে, মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে গ্রেফতার অথবা হত্যা করতে।

টাঙ্গাইল থেকে হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের দৃষ্টি এড়িয়ে নানা কৌশলে মওলানা ভাসানী সিরাজগঞ্জ পৌঁছেন। বহু ঝুঁকি পার হয়ে মওলানা ভাসানী ও তার দুই সহযোগী ১৫/১৬ এপ্রিল ‘৭১ এর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত পৌঁছেন। ভারত পৌঁছার সপ্তাহ খানেক পর মওলানা ভাসানীর এক সুদীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ হয় ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার মাত্র তিন সপ্তাহ পরে তার এই বিবৃতি মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতের নাগরিকদের কাছে অসামান্য আবেদন সৃষ্টি করে। সীমান্ত অতিক্রম করে হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে একদিন থাকার পর মওলানা ভাসানী তার দুই সফর সঙ্গীকে নিয়ে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ওই দিনই মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় অর্থাৎ মুজিবনগরে শপথ নিয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ভারতে অবস্থানকালে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মাঝে মাঝে ভাসানীর বিবৃতি যখন প্রকাশিত হচ্ছিল তখন স্বাধীনতা সংগ্রামী উজ্জীবিত হতো। তবে মওলানা ভাসানীর বিবৃতি প্রচারিত হলে ও কলকাতায় কেউ তাকে স্বশরীরে দেখতে না পাওয়ায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে প্রচারিত হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে হত্যা করেছে কিংবা বন্দি করে রেখেছে। দেশ-বিদেশে খবরটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই সময় বাধ্য হয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী এক সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করতে বাধ্য হন যে, ‘‘মওলানা ভাসানী যেকোন মুহূর্তে দিল্লী আসতে পারেন।’’ ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী কখনো দীর্ঘ সময় এক জায়গায় ছিলেন না। কখনো কলকাতা, পুন্ডিবাড়ি, দিল্লী, দেরাদুন কখনো রানীক্ষেত, আলমোড়া, আসামের ভাসানচর প্রভৃতি স্থানে ছিলেন। তিনি যদিও নজরবন্দি ছিলেন, কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে জাতীয় নেতার মর্যাদা দিতে ভুল করেনি। তাঁর স্বাধীনভাবে চলাফেরা, সকলের সঙ্গে দেখা স্বাক্ষাতের অধিকার ছিল না। যাই হোক সেই সময় মওলানা ভাসানীর নজরবন্দির বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গড়ায়। ৭১-এর ২ জুনে দি টাইমস এর সংবাদদাতা পিটার হেজেরসাস্ট এক সংবাদ পাঠান এই মর্মে যে, ‘‘মওলানা ভাসানী ভারত সরকার কর্তৃক অন্তরীণ।’’ এমনকি এই সংবাদকে কেন্দ্র করে লন্ডনে তার মুক্তির জন্য কমিটি গঠিত হয়। জুন মাস থেকেই মওলানা ভাসানীকে নিয়ে বৃটেনে উদ্বেগ উত্তেজনা দেখা দেয়। মওলানা ভাসানীর অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য না থাকায় সেখানকার বাঙ্গালীরা শুধু নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান ও সেগুলোর সাথে জড়িত বিখ্যাত নেতারাও ভারত সরকারের ওপর তাঁর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।

এভাবেই মওলানা ভাসানী ভারতের মাটিতে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন। এরপর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধকে একটি সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার জন্য ৯ সেপ্টেম্বর ৭১-এ গঠন করেন উপদেষ্টা পরিষদ। যে পরিষদে চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়েছিল সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে। যদিও এক পর্যায়ে এই কমিটি একটি নাম সর্বস্ব ব্যাপারে পরিণত হয়। মওলানা ভাসানী চেয়েছিলেন এই কমিটিকে আরো একটু বড় ও বিস্তৃত আকারে দেয়ার জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির প্রতিনিধি রাখার পক্ষপাতি ছিলেন তিনি। কারণ, আওয়ামী লীগ বহির্ভূত সদস্য বেশি থাকলে প্রবাসী সরকার উপকৃতই হতো।

শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১২ দিন পর যখন ঢাকায় পত্রপত্রিকায় মওলানা ভাসানীকে নিয়ে নানা ধরনের লেখালেখি শুরু হয়েছে, তখন ভারতের সরকার মওলানা ভাসানীকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন। তখন তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিলো না। দিল্লী থেকে দেশে ফেরার আগে তিনি আসাম যান। সেখানে তাঁর পরিচিত জনদের সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলেন ভারত সরকারের কাছে। ভারত সরকার তাতে সম্মত হয়েছিলেন। ২১ জানুয়ারি ১৯৭২ আসামের ফরিগঞ্জে তিনি এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দীর্ঘ ইতিহাস, পাকিস্তানের বর্বরতা ও ২৩ বছরের শোষণের একটি চিত্র তুলে ধরেছিলেন। ২২ জানুয়ারি মেঘালয় থেকে তিনি ভারত সরকারের একটি জীপে বাংলাদেশের হালুয়াঘাটে পৌঁছেন। তাঁর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন চিকিৎসক ছিলেন। হালুয়াঘাটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মহান এই জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে মামুলি অভ্যর্থনা জানিয়েছিল ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক খসরুজ্জামান চৌধুরী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও তার ভক্তমন্ডলী।

সড়কপথে ক্লান্তশ্রান্ত দেহে ২২ জানুয়ারি ৭২-এ শেষ রাতে তিনি পৌঁছেন টাঙ্গাইলে। রাতে সার্কিট হাউসেই রইলেন তিনি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানী সেনারা তাঁর অসন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। পরদিন অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারি সকালে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাঁকে দেখতে সমবেত হন সার্কিট হাউসে। বহুদিন পর পরিচিত মানুষ ও সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেন মজলুম জননেতা। পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে একজনকে দিয়ে বললেন, সন্দেশ নিয়ে এসো। ওই ১০ টাকার সাথে আরো টাকা যোগ করে আনা হলো সন্দেশ। সকলকেই মিষ্টিমুখ করালেন তিনি।

দেখতে দেখতে অসংখ্য মানুষ জড় হল, যেন ছোটখাটো জনসমাবেশ। ফুটপাতের এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নাতিদীর্ঘ স্বভাবসুলভ ভাষণ দেন তিনি। বহুদিন পর টাঙ্গাইলবাসী শুনতে পায় তাদের পরিচিত কণ্ঠ। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে উপস্থিত জনতা। এরপর টাঙ্গাইল থেকে গেলেন সন্তোষের নিজ বাড়িতে। তাঁর পোড়া ভিটেয় গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন সব, কোথায় কি ছিল তা সনাক্ত করলেন। তাঁর যেসব প্রিয় বস্তু খোয়া গেছে সেগুলোর জন্য আপসোস করলেন। তাঁর গভীর অথচ চাপা দীর্ঘনিশ্বাস গোপন থাকলো না উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ : ‘‘দলে দলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভক্তারা এসে পা ছুঁয়ে সালাম করতে লাগলো তাদের প্রিয় হুজুর ও পীরবাবাকে। যেন মাটিরই পৃথিবীতে এই সদ্য এসেছেন পথ ভুলে এক মহামানব মাটির মানুষের পরমাত্মীয়। এলাকার কে কোথায় মারা গেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা কেমন আছে সে খবর নিলেন তিনি। ঘনিষ্ঠ কারো কারো নিহত হবার কথা শুনে তা চোখ অশ্রুসিক্ত ও কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হলো।’’

মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত তাঁরই স্বপ্নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো দালানের একটি কক্ষে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। ইতোমধ্যেই যথা পূর্ব খিচুরী রান্না শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। কলার পাতায় যার যেমন খুশি খাচ্ছে। সকলের সঙ্গে মওলানা ভাসানীও খেলেন বেশ পরিতৃপ্তি সহকারে। শীতের ছোট দিন, তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা এলো, দর্শনার্থীদের ভিড় কমলো কিছু। ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিছানা, মলিন কাথা-বালিশ পর্যন্ত ভস্ম করে দিয়েছিল ইয়াহিয়ার ফৌজ। তীব্র শীত পড়েছিল সেদিন। নেতার বিছানাপত্রের ব্যাপারে ভক্তেরা সত্যি সত্যি পুরু করে নাড়া বিছিয়ে তার ওপরে একটি চট দিয়ে বিছানা করে দিলেন তাঁকে। আশপাশের কারো বাড়ি থেকে যোগাড় হয়েছিল একটি জীর্ণ কাঁথা অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি সেদিন শুয়ে পড়লেন মওলানা। স্বাধীন দেশে ফিরে এসে মাটির শয্যায় প্রথমবার স্বাধীনভাবে পরম শান্তিতে ঘুমালেন এ মাটির এক উঁচু মানব।

পরদিন অবশ্য তার ভক্তরা একটি লেপ ও একটি তোষক তৈরি করে দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সেদিন এটাই কি প্রাপ্য ছিল মওলানা ভাসানীর? অনেকের প্রশ্ন বিষয়টি তাঁর অনেক রাজনৈতিক বিরোধীকেও বিদ্ধ করে। অথচ ভারতে নজরবন্দি থাকা অবস্থায় ও ইন্দিরা সরকার তাকে একজন মহান জাতীয় নেতার মর্যাদা, পক্ষান্তরে নিজের দেশে প্রত্যাবর্তন করে তাঁর সহকর্মী ও প্রিয়জনের দ্বারা গঠিত সরকার থেকে পেলেন যেন ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর একজন হয়েই ফিরলেন মওলানা ভাসানী।

প্রত্যাবর্তনের দু’দিন পর স্বাধীন দেশে প্রথম সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশবাসীকে আহবান জানান সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবার। তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যতদিন কাজ করবে এবং দেশের ও জনগণের কল্যাণের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেবে ততোদিন তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাবেন। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, অতীতের স্বৈরাচারী সরকারগুলোর মতো তাঁর সরকারেরও পতন অনিবার্য।’’

মজলুম জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানী আছেন এবং থাকবেন। যতদিন মেহনতি মানুষের সংগ্রাম চলবে ততদিন মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকবেন। মওলানা ভাসানী ক্ষমতায় যাননি বটে, তবে তিনি ছিলেন ক্ষমতার পালাবদলের অনুঘটক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ সফল নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। আর এ কারণেই ১৯৫৬ সালেই পাকিস্তানীদের প্রতি সালাম জানিয়েছেন যার বাস্তব রূপই হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ক্ষমতায় না গিয়েও কিভাবে দেশ-জাতির কল্যাণ করা যায় মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন তার প্রমাণ বহন করে। তাঁকে শুধুমাত্র মহাত্মা গান্ধীর সাথে তুলনা করা যায়। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার, তাঁতি-জেলে চিরকাল স্মরণ রাখবে তাদের এই আপন মানুষটির কথা। তাদের মুক্তির জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল যাঁর গোটা জীবন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ এবং দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য মওলানা ভাসানী যে ঐক্যের বাণী রেখে গেছেন তা আজও আমাদের কাছে অবশ্যই স্মরণীয়। মওলানা ভাসানী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখার দায়িত্বের কথা, বঞ্চিত জনগণের দরিদ্রের অন্ধকার থেকে তুলে এনে সমৃদ্ধির আলোকবৃত্তে প্রতিষ্ঠিত করার কাজের কথা।

পরিশেষে বলতে চাই এই কথাটিই যে, স্বাধীনতার ৪৪ বছরের সরকারগুলো তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন ব্যর্থ হয়েছে তার হাতে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ, আবার তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ব্যবহারকারী বিএনপি এমনকি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোও। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করলেও প্রকৃত অর্থে তাকে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার কোন কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি। আজ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার আহবান জানিয়ে বলতে চাই নিরপেক্ষ চিন্তায় অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা ভাসানীকে কেবলমাত্র জাতীয় নেতার গ্যালারিতে বসিয়ে রেখে তাঁর চেয়ে কম অবদানের ও স্বল্প মর্যাদায় জাতীয় নেতাদের বিভিন্ন মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার একপেশে যে কোন আয়োজন সমগ্র জাতিকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, উপমহাদেশের অত্যাচারিত ও নির্যাতিত মিহনতি জনগণের নয়নমণি, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি এবং মওলানা ভাসানীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্মসূচি গ্রহণের আহবান জানাই।

[লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *