তাজিদুল ইসলাম লাল, রংপুর
রংপুরে বৈধ ও অবৈধ মিলে প্রায় সাড়ে ২শ ৫০টি ইট ভাটা রয়েছে। এসব ভাটার গর্ভে চলে যাচ্ছে কৃষি জমির টপ সয়েল (উপরিভাগের মাটি)। পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন ও কাঁচা ইট পোড়ানোর লাইসেন্স ছাড়াই বেশির ভাগ ভাটা স্থাপন করা হয়েছে আবাদী জমি, গ্রাম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁষেই। মানসম্মত পিট কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ খড়ি, টায়ারের ছাই ও আংশিক পরিমাণের নিম্নমানের কয়লা। ফলে কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ ও কৃষি ফসল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবুজ বেষ্টনীর বনাঞ্চল। আবার অনেক ভাটা মালিক কৌশলে হাইকোর্টে রীট করে অব্যাহত রেখেছেন ইট পোড়া। ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ১৯৯২ সালের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ‘কৃষি-জমিতে ইটভাটা নির্মাণ দণ্ডনীয় অপরাধ’। কিন্তু রংপুরে তা কেউই মানেনি। এদিকে, রংপুরের ইট ভাটাগুলো সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য কোন দপ্তরে পাওয়া যায়নি। তবে উন্নয়নমূলক কাজের স্বার্থে অবৈধভাবে ইট ভাটাগুলো চালানো হচ্ছে তা স্বীকার করেছেন রংপুর ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রংপুরে ২শ ৪২টি ইট ভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ফিক্সট চিমনী ৫৬টি, জিকজ্যাক ১শ ৭৮টি ও অটো ইট ভাটা ৮টি। ২০২১ সালে মাত্র ২৮টি ভাটা নবায়নের ছাড়পত্র পেয়েছিল। নভেম্বর মাস ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত রংপুরের ১৫টি ভাটা নবায়নের ছাড়পত্র পেয়েছে। কাউনিয়ার ফাইব স্টার ব্রীক্স ও কুতুবপুরের সম্রাট ব্রীক্স হাইকোর্টে রীট করে চলমান রয়েছে। এছাড়াও নতুন ভাবে ৪টি ভাটা আবেদন পড়েছে এবং বদরগঞ্জের চাদনী ব্রীক্স নামে ১টি ভাটা বন্ধে লিখিত অভিযোগ এসেছে। তারা আরও জানায়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে ২০২০ইং সালে ৩২টি ইট ভাটায় ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ৪৫লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ২০২১ইং সালে ৭০টি ভাটায় ভ্রাম্যমান আদালত দিয়ে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তবে রংপুরে কয়টি অভিযান ও টাকার পরিমাণের তথ্য আলাদাভাবে দিতে পারেনি।

রংপুর জেলা প্রশাসনের হিসাবে ইটভাটার সংখ্যা ২১৭টি। সদর উপজেলায় ২৭টি, গঙ্গাচড়ায় ৩টি, পীরগঞ্জে ৪২টি, বদরগঞ্জে ৫৫টি, পীরগাছায় ৩৫টি, তারাগঞ্জে ২০টি, মিঠাপুকুরে ২৭টি ও কাউনিয়ায় ৮টি। এর মধ্যে সকল কাগজপত্রাটি সঠিক আছে এমন ভাটার সংখ্যা ৭১টি, জিকজ্যাক চিমনী আছে কাগজ নেই ৩৮টির, স্থায়ী চিমনী আছে কাগজ নেই ৮৮টির এবং রীট মামলায় চলমান ভাটার সংখ্যা ২০টি। চলতি মৌসুমে কাঁচা ইট পোড়ানোর জন্য ৭৬টি ভাটা আবেদন করেছে কিন্তু বিভিন্ন সমস্যা থাকায় একটি ভাটাও অনুমোদন পায়নি।

সরেজমিনে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বড়বিল ইউনিয়নে গেলে দেখা যায় আশপাশে ৩টি ইট ভাটা অবস্থিত। এর মধ্যে উত্তর পানাপুকুর কাচারীপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১শ গজের মধ্যে এমভিবি ব্রিক্স নামে ইট ভাটা। গ্রামের চিকন রাস্তার এক পাশে প্রাইমারী স্কুল ও অপরপাশে ইট ভাটা। ওই এলাকার বদরুলের ছেলে দুলু চৌধুরী জানান, প্রাইমারী স্কুলে পাশে দীর্ঘ ২০ বছর থেকে ভাটাটি ব্যবহার হয়ে আসছে। স্কুলটিতে আশপাশ এলাকার ছোট ছোট বাচ্ছারা লেখাপাড়ার জন্য আসে। মাঝে মধ্যে বাতাসে এমন কালো ধোঁয়া আসে চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

উত্তর পানাপুকুর কাচারীপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহরাব হোসেন লিখন জানান, অনেক আগে উপজেলা প্রশাসনকে মৌখিকভাবে বিষয়টি অবগত করা হয়েছিল। যেহেতু আপনি (সাংবাদিক) জানালেন এখন লিখিতভাবে অভিযোগ করবো। কালো ধোঁয়ায় সমস্যা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, টুকটাক সমস্যাতো হয়, সবাই পরিচিত কাকে কি বলি।

সরকারি প্রাইমারী স্কুলের সাথেই ইটভাটার কার্যক্রম কিভাবে চালিয়ে আসছেন জানতে চাইলে এমভিবি ব্রিক্স এর মালিক জোনায়েদ চৌধুরী জানান, যেহেতু স্কুলের আগেই ভাটাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র না দেয়ার কারণে হাইকোর্টে রীট করি। রীট অনুযায়ী ভাটাটি চলমান রয়েছে।

একই এলাকার এসএবি ব্রিক্স লাঙ্গলের হাটের ঘাঘটটারীর আবাদী জমিগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে ভাটাটি। এই ভাটাটির চতুরপার্শ্বে আবাদী জমি। দেখা যায়, কেউ নতুন করে ধান রোপন করছেন আবার কেউ আলুর পরিচর্যা করছেন। এর পাশেই ছালাপাকের দোলায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবিসি ভাটা। এর মালিকের নাম দীপ চৌধুরী। তিনি এবার বড়বিল ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ভাটাটি কৃষি জমিতে বানানো হয়েছে। ঢুকতেই দুই পাশে বড় স্তুপ করে রাখা আছে কাঠ খড়ি। সিমেন্টের ফিক্সট চিমনী দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এসময় মালিককে পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে মুঠোফোনে কথা হয় দীপ চৌধুরীর সাথে। তিনি জানান, কাঠের খুড়িগুলো ওখানকার লেবাররা ভাত ও তরকারি রান্না করে খাবেন। পরিমাণে এতো বেশি কেন? বললেই বলেন, আমি ব্যস্ত আছি, আসেন সাক্ষাতে কথা হবে।

সরজমিনে দেখা গেছে, রংপুরের বদরগঞ্জ ও পীরগঞ্জে প্রায় ১৫০টি ভাটা রয়েছে। রংপুর সদরসহ তারাগঞ্জ, মিঠাপুকুর, পীরগাছা, কাউনিয়া ও গঙ্গাড়ার উপজেলার এই ইটভাটার বেশির ভাগেই স্থাপন করা হয়েছে আবাদী জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গ্রাম ঘেঁষেই। গ্রাম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁষে ইটভাটা স্থাপন করায় ভাটা মালিকরা এবার পরিবেশ ছাড়পত্র পায়নি। আর পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে মেলেনি কাঁচা ইট পোড়ানোর লিখিত অনুমতি।

বদরগঞ্জের কালুপাড়া ইউনিয়নে বিআরবিএল নামে একটি ইটভাটায় কাঁচা ইট পোড়ানো হচ্ছে। ইটপোড়ানোর অনুমতি পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে ওয়াজেদ আলী বলেন, সরকারকে যথাযথ ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আবেদন করেছি। রামনাথপুর ইউনিয়নে রয়েছে ১৩টি ইটভাটা।

চলতি মৌসুমে পীরগঞ্জের কাদিরাবাদের মাজহারুল হক ও গোপীনাথপুরে মাবু মিয়া ফিক্সড চিমনির ভাটায় ইট পোড়াচ্ছেন। ভাটার আশপাশে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিশাল মজুদ করা হয়েছে। ভাটা মালিকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউই আইন মানছেন না। দেদারছে কাঠ পোড়ানোর কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ।

পীরগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও এমআরবি ব্রীক্স এর মালিক শাফিউর রহমান মন্ডল মিলন মুঠোফোনে জানান, কয়েকদিন আগে আমার ভাটায় ৫লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাছাড়া বৃষ্টি বাদলে অনেক ক্ষতি হয়েছে এখন কথা বলতে পারছিনা, পরে আসেন কথা হবে। পরিবেশ নবায়ন সনদ ও কাঁচা ইট পোড়ানো সনদ নেই বলে তিনি জানান।

মিঠিপুর ইউপি আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও এসএবি ব্রীক্সের মালিক সাদেকুল ইসলাম সাদা জানান, চলতি মৌসুমে ১ রাউন্ড ইট কাটছি। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ভাটার অনেক ক্ষতি হয়েছে। কাগজপত্রাদি না থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতা দেখিয়ে ভাটা চলমান রেখেছেন বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, সবকিছু দাম বেশি ইটের ব্যবসা করে এখন লাভ হচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বদরগঞ্জের এক ইটভাটা মালিক জানান, ২০২১ সালের মে মাসে কয়লা ক্রয় করা হয়েছিল ৮ হাজার থেকে ৮ হাজার ২’শ টাকায়। অথচ এ বছর কয়লার বাজারে আফ্রিকা ও অষ্টেলিয়ার কয়লা না পাওয়ার কারণে চলমান ইট তৈরীর মৌসুম নভেম্বর মাস থেকেই প্রতি টন ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ২২ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। যার দাম গত বছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। তিনি বলেন, এক টন কয়লা পুড়িয়ে ২ হাজার ৫’শ থেকে ৩ হাজার ইট তৈরী করা সম্ভব। এতে করে বর্তমান সময়ে এক টন কয়লা ২২ হাজার টাকা দরে কিনে ইট তৈরী করলে তাদের প্রতি হাজার ইটের উৎপাদন ব্যয় পড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকার মতো। যা গত বছর উৎপাদন ব্যয় ছিল ৭ হাজার ৫’শ থেকে ৮ হাজার টাকা।

কাস্টস অফিস সুত্র মতে, রংপুর জেলার ইট ভাটাগুলোকে ৪টি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২শ ২৯টি ভাটার মধ্যে কোতয়ালী সার্কেলে ২৭টি, বদরগঞ্জ সার্কেলে ৮৬টি, হারাগাছ সার্কেলে ৩৮টি ও মিঠাপুকুর সার্কেলে ৭৮টি। রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ছিল ১০ কোটি ৩২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, আদায় হয়েছে ৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ২শ ৩৪টি ভাটায় রাজস্ব টার্গেট ছিল ১০ কোটি ৬৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯ কোটি ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাস্টমসের এক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কিছু ভাটা মালিকের কাছ সরকারি ট্যাক্স আদায় করা খুব যন্ত্রনাদায়ক। তারা আমাদেরকে মূল্যায়নে করে না।

রংপুর জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বদরগঞ্জের আরবিএল ব্রিক্স এর মালিক এম আজিজুল হক জানান, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বর্তমানে ভাটাগুলো চলমান রাখার নিয়ম নেই। তবে সকলেই জানে এগুলো বে-আইনীভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ভাটাগুলো বন্ধ হলে টাকা দিয়েও ইট পাওয়া যাবে না, তাহলে উন্নয়ন মূলক কাজ কিভাবে হবে। কাঠ পোড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পীরগঞ্জের কিছু ভাটায় কাঠপোড়ানো হয়, আমরা এগুলো বন্ধে প্রশাসনকে অভিযানের জন্য মাঝে মাঝে অনুরোধ জানাই।

রংপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন জানান, রংপুরের ইট ভাটাগুলোর সঠিক পরিবেশ ও কাগজপত্রাদির তদারকির জন্য আমরা যাই। কোন কিছুর কমতি থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়।

রংপুর কাষ্টম্স এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ সাজ্জাদ হোসেন জানান, অনেক প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে ইট ভাটায় অভিযান চালাতে হয়। আমাদের জনবল সংকট। এরপরও ভাটা মালিকদের কাছ থেকে ৩ কিস্তিতে বার্ষিক ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছে।

রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান মুঠোফোনে বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে আমরা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অনেক ভাটাকে জরিমানা করেছি আর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *