ফারহানা আক্তার,জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ
গত বছর শাহজাহান আলীর গভীর নলকূপের তিনটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। এর কিছু দিন পর একই নলকূপের মিটারও চুরি হয়। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। উদ্ধার হয়নি ট্রান্সফর্মার ও মিটার।

শাহজাহান আলীর ছেলে আব্দুল মোমিন বলেন, গত বছর আমাদের গভীর নলকূপের তিনটি ট্রান্সফর্মার চুরি হয়। সেগুলো লাগাতে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়। থানায় অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এরই মধ্যে আবার মিটার চুরি হয়। এতে আমি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ি। মিটার চোররা চুরির সময় একটি নম্বর দিয়ে যায়। সেই নম্বর থেকে হুমকি দেয়। তারা টাকা না পেলে আবারও মিটার, ট্রান্সফর্মার চুরির হুমকি দেয়। এতে নলকূপ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু কৃষকদের অনুরোধে আবার শুরু করি।

একইভাবে পোল্ট্রি-হ্যাচারি থেকে মিটার চুরির পর বেকায়দায় পড়েন কবির আহম্মেদ রোকন নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি সাংবাদিক কে বলেন, জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে দুপুরের দিকে মিটারের নতুন সংযোগ লাগানো হয়। সেই দিন রাতেই মিটারটি চুরি হয়। সে সময় চোররা একটি চিরকুটে বিকাশ নম্বর রেখে যায়। সেই নম্বরে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে বিকাশে ১২ হাজার টাকা দিতে বলে। আমি দিতে না চাইলে পরে কথাবার্তা বলে ৬ হাজার টাকা দিতে বলে। সেই টাকা দিলে তারা একটা লোকেশন দেয়। ওই লোকেশন মতো হ্যাচারির পাশেই একটি আবর্জনার মধ্যে মিটারটি পাওয়া যায়।

ট্রান্সফর্মার চুরিতে সূত্র না থাকলেও মিটারের ক্ষেত্রে থাকছে

আব্দুল মোমিন বা কবির আহম্মেদ রোকনই নয়, তাদের মতো জয়পুরহাট জেলার অনেক গ্রাহকের ট্রান্সফর্মার ও মিটার চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ জেলায় গত এক বছরে বিভিন্ন ফসলি মাঠ থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপের ১৩২টি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার চুরির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের থ্রি-ফেজের বৈদ্যুতিক মিটার খুলে নিয়ে জিম্মি করে রেখে টাকা আদায়েরও ঘটনা ঘটছে। অনেকেই মিটার রাখার স্থানে পাওয়া মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে বিকাশে চাহিদা মতো টাকা পাঠিয়ে মিটার ফেরত পেয়েছেন আবার কেউ টাকা দিয়েও মিটার ফেরত পাননি।

ট্রান্সফর্মার চুরির ঘটনায় কোনো সূত্র না থাকলেও মিটারের ক্ষেত্রে থাকছে মুঠোফোনের নম্বর। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চুরি যাওয়া একটিও ট্রান্সফর্মার উদ্ধার করতে পারেনি কিংবা চোরদের ধরতে পারেনি। তবে কয়েকজন মিটার চোরের সদস্য ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে মূল হোতারা। মুঠোফোন নম্বর থাকা সত্ত্বেও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় কেন মিটার জিম্মিকারীরা ধরা পড়ছেন তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে।

বছরে ১৩২ ট্রান্সফর্মার চুরি, উদ্ধার হয়নি একটিও

জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কাছে গত এক বছরে গভীর নলকূপের ট্রান্সফর্মার চুরির হিসাব থাকলেও গভীর-অগভীর নলকূপের মিটার চুরির কোনো তথ্য নেই। তবে সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রান্সফর্মারের চেয়ে মিটার চুরির ঘটনা দুই থেকে তিনগুণ বেশি।

জয়পুরহাট বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডি) তথ্যানুযায়ী, তাদের আওতাধীন ৩৫৯টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এতে মোট ১ হাজার ৭৭টি ট্রান্সফর্মার রয়েছে। এর মধ্যে গত বছর চারটি গভীর নলকূপের ১২টি ট্রান্সফর্মার চুরির ঘটনা ঘটেছে।
জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দেওয়া তথ্য মতে, জেলার পাঁচ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের ১ হাজার ৮৭৫টি গভীর, ৩ হাজার ৫১৭টি অগভীর ও ২টি এলএলপি নলকূপ রয়েছে। এসব বিদ্যুৎচালিত মোট ৫ হাজার ৩৯৪টি নলকূপের জন্য প্রায় ৯ হাজার ট্রান্সফর্মার রয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২০টি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার চুরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে চুরি হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ৩টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩টি, মার্চে ২টি, এপ্রিলে ৩টি, মে মাসে চুরি নেই, জুন মাসে ৫টি, জুলাই মাসে ১১টি, আগস্ট মাসে ১২টি, সেপ্টেম্বরে ১৬টি, অক্টোবরে ৩১টি, নভেম্বরে ২০টি এবং ডিসেম্বরে ১৪টি ট্রান্সফর্মার চুরি হয়েছে। চুরি যাওয়া এসব বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার ৫ ও ১০ কেভি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন।
ট্রান্সফর্মারের তামার তার বিক্রি হচ্ছে ক্যাবল কোম্পানির কাছে
জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা জানান, ৫ কেভি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারের দাম ৩৫ হাজার টাকা আর ১০ কেভি ট্রান্সফর্মারের দাম ৬৫ হাজার টাকা। প্রথমবার চুরির ঘটনা ঘটলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ৫০ শতাংশ দামে ট্রান্সফর্মার সরবরাহ করে। দ্বিতীয়বার চুরির ঘটনা ঘটলে পুরো টাকা গ্রাহককে বহন করতে হয়। ৫ কেভির একটি ট্রান্সফর্মারে ১০-১২ কেজি এবং ১০ কেভির একটি ট্রান্সফর্মারে ১৪-১৬ কেজি তামার তার থাকে। প্রতিটি ট্রান্সফর্মার থেকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার তামার তার বিক্রি হয়। এসব তামার তার পল্লীবিদ্যুতের কোনো কাজে লাগে না। এ কারণে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা ছাড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *