ফারহানা আক্তার, জয়পুরহাটঃ

জয়পুরহাটের কালাইয়ে কিছুতেই থামছেনা কিডনি বেচাকেনা ও দালাল চক্রের অপতৎপরতা, নিঃশ্ব হয়ে যাচ্ছেন এলাকার সহজ-সরল অভাবি মানুষ।

কালাই উপজেলার প্রায় ৪০ টি গ্রামের সহজ সরল দরিদ্র মানুষদের কৌশলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য করছেন দালাল চক্রের সদস্যরা। সংসারের দারিদ্রতায় দালালদের প্রলোভনে মোটা অংকের টাকার চুক্তিতে কিডনি বিক্রির পর তাদের চুক্তির টাকা না দিয়ে উল্টো ঐই দালাল চক্রই তাদেরকেই দিচ্ছেন নানা রকম হুমকি। অনেকেই নিজ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনো কোনো পরিবার আবার দালালদের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করতে মাসের পর মাস বাড়ি থেকে উধাও হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দালাল চক্ররের সদস্যরা ধরাও পড়ছেন মাঝে মাঝে। কেউ আইনের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছেন। কিডনি বিক্রির পর নিজেই অপরাধী হওয়ায় প্রশাসনের কাছে মুখ খুলতে পারছেন না তারা।

১৯৯৯ সালের অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনের ২ বৎসর থেকে ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অনধিক ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এমন আইনের বিধান আছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সাল থেকে কালাই উপজেলার মাত্রাই ও উদয়পুর ইউনিয়নের প্রায় ৪০ টি গ্রামে বেকার, দিন মজুর, ভ্যান চালক, হতদরিদ্র সহজ সরল মানুষ গুলোকে টার্গেট করে দালাল চক্র ও দাদন ব্যাবসায়ীরা। তাদের সংসারের অভাবের কারণে কিছু টাকা চড়া সুদে ধার দেন দালাল চক্র ও দাদন ব্যাবসায়ীরা। তাদের ধার ও সুদের টাকা সময় মতো না দিতে পারলে, শুরু হয় তাদের শরীর থেকে কিডনি খুলে নেওয়ার অভিনব সু-কৌশল। কাউকে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি, কাউকে রিক্সা চালানো, কাউকে মিল ফ্যাক্টারিতে কাজের বেশি বেতনের লোভ দেখায়। তারপর তাদের ঢাকায় নিয়ে যায়। তাদের সু-কৌশলে দালাল চক্রের চুক্তি করা ক্লিনিক ও হাসপাতাল গুলোতে তাদের কে কিডনি দেওয়ার জন্য ৩ থেকে ১০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে বলে পরীক্ষা করান। তার পরেই তাদের নির্ধারিত জায়গায় রেখে বিভিন্ন জেলা থেকে পাসপোর্ট ও ভিসা সম্পূর্ন করে তাদের ভারতে দালালদের চুক্তিকরা হাসপাতালে কিডনি ট্রান্সফারের জন্য পাঠান। কিডনি দেওয়ার পর হাসপাতালের ব্যবস্থাপত্র বা অন্য কোনো কাগজপত্র না দিয়ে শুধু পাসপোর্ট দিয়ে তাদের কে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। দেশে আসার পরই শুরু হয় তাদের শারীরিক নানা অসুস্থতা ও তারা নিজেই পড়েন আইনি নানা জটিলতায় এবং স্থানীয় প্রভাবশালী দালালদের কাছে টাকা চাইলে চুক্তির টাকা না দিয়ে, দেন নানা রকম হুমকি। এ পর্যন্ত ৬ থেকে ৭ টি মামলা হয়েছে। তারা অনেকে জামিনে আছে।

কালাই উপজেলার মাত্রাই মদনাহার গ্রামের আজিজুল ইসলাম বলেন, সংসারের অভাবের কারণে আমি ২০ হাজার টাকা হামিদুল নামে এক প্রতিবেশির কাছে ধার নেই। তার পরে আমি ধারের টাকা দিতে পারি না তখন সে আমাকে টাকার জন্য চাপ দেয়। তখন হামিদুল বলেন টাকা না দিতে পারলে তোর কিডনি বেচ ১০ লাখ টাকা পাবি । আমি বাধ্য হয়ে ও হামিদুলের চাপে ঢাকাতে যায়। তারা এক হাসপাতালে আমার পরীক্ষা করে কিছু দিন এক ঘরে রেখে (৪১৮৬৩৩৭৮৭১ নাম্বার) পাসপোর্ট করে পরে ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে ভিসা করে আমাকে ভারতে পাঠায় অপারেশন করে কিডনি খুলে নেয়। ভারতে ৭-৮ মাস থেকে ২২ জুলাই ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ পাঠায়। দেশে এসে দালাল হামিদুলের কাছে ১০ লাখ টাকা চাইলে সর্বমোট সাড়ে ৩ লাখ টাকা আমাকে দিয়েছে। বাকি টাকা চাইলে আমাকে হুমকি দেয়। আমার ডান ধার ব্যাথা করে। আমি কাজ করতে পারি না ।

কালাই উপজেলার কুসুমসাড়া গ্রামের অটোরিক্সা চালক মোঃ মোস্তফা বলেন,আমার ১ শতক জমি জমা নেই। আমি খুব গরিব মানুষ। কয়েক বছর আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি কলকাতায় কিডনি বিক্রি করেছি। এখন কোনো মতো অটোরিক্সা চালাই শরীরটা ভালো নয় ব্যাথা করে। কি করবো ভাই অভাবের তাড়নায় করেছি।

কালাই কুসুমসাড়া এলাকার রাজমিস্ত্রীর হেলাপারের স্ত্রী কারিনা বেগম বলেন, আমাকে ঢাকায় গার্মেন্টসে ভালো বেতনে চাকরির কথা বলে প্রতিবেশী এক দালাল আমাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। সেখানে গার্মেন্টসে কাজ করা অবস্থায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা দিবে ছোট একটা কিডনির অপারেশন করলে, এমন প্রলোভন দেখিয়ে আমার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ভারতে নিয়ে গিয়ে কিডনি খুলে নেয়। তার কাছে টাকা চাইলে উল্টো দিকে আমাকেই হুমকি দেয়। পরে বাধ্য হয়ে চেয়ারম্যান মেম্বার এর কাছে দাড়ে দাড়ে ঘুড়ে বিচার বা টাকা না পেয়ে আদালতে মামলা করেছিলাম মামলার পর আসামীরা কেউ গ্রেফতার হয়নি। পরে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে ৩ লাখ টাকা দিয়ে আপোষ করতে বাধ্য করে। আপোষের পর এই মামলার আসামীরা প্রকাশেই ঘুরছেন ও আমাদেরকে হুমকির মধ্যে রেখেছে। আমরা গরিব মানুষ ১ শতক জমিও নেই আমার স্বামীর, পরের জায়গায় থাকি।

স্থানীয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলেন, দিন দিন দালালদের দৌড়াত্ত ও কিডনি বিক্রেতা বাড়ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কালাই উপজেলার ২০/৩০ জন মহাজন প্রকৃতির দালাল ও দাদন ব্যাবসায়ী একটি কিডনি বিক্রি চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে ৫ শতাধিক কিডনি এই এলাকা থেকে বিক্রি করেছে। আগে দালালদের ধরতে হবে ও শাস্তি দিতে হবে। এছাড়াও এলাকাবাসীরা জানান কুসুমসাড়া , মদনাহার, দিঘীপাড়া, গ্রামের পরিবারসহ বসতবাড়িতে তালা দিয়ে কিডনি বিক্রি করতে গেছে। এছাড়াও মদনাহারের হামিদুলের ছোট ভাই আমিনুর কিডনি বিক্রি পর সে নিজেই দালাল চক্রের সদস্য হয়েছে। এমন অনেকেই কিডনি বিক্রির পর হয়ে যাচ্ছেন দালাল।

কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের মদনাহার গ্রামের গ্রেফতারের আগে দালাল হামিদুল ইসলাম বলেন, আজিজুলের কিডনি বিক্রি অস্বিকার করেন। আমার বিরূদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। উদয়পুর ও মাত্রাইয়ের বিভিন্ন্ গ্রামের অনন্য কিডনি বিক্রেতারা ও দালাল চক্রের সদস্যরা এলাকায় গাঁ ঢাকা দেন, তাদের পাওয়া সম্ভব হয় নাই।

কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ ন ম শওকত হাবীব তালুকদার লজিক ও উদয়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী দাদা বলেন, যারাই কিডনি বিক্রি করছেন তারাই আবার দালাল হয়ে যাচ্ছেন। হটাৎ করে কিডনি বিক্রির প্রবনতা বেশি শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও আমরা জনপ্রতিনিধিরা তাদের সচেতন ও কিডনি বিক্রি বন্ধ করতে সভা সেমিনার সহ নানা কর্মসূচি নিয়মিত করা হয়। এছাড়াও কিডনি বিক্রি দালাল চক্রের কোনো তথ্য পেলেই আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়।

কালাই উপজেলার পরিষদের চেয়াম্যান মিনফুজুর রহমান মিলন বলেন, আমি মনে করি দালাল চক্রের জন্য কঠোর আইন করা দরকার তেমনি দালালরা প্রতারিত করে যাদের কিডনি নিচ্ছেন তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়া দরকার।

কালাই থানার অফিসার ইনচার্জ সেলিম মালিক বলেন, কিডনি বেচাকেনা যে কোনো অভিযোগ বা তথ্য পেলেই আইনগত ব্যাবস্থা নেওয়া হয়। কালাই থানার উপ-পরিদর্শক এস এম জোবায়ের হোসেন বলেন, সম্প্রতি নভেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখে ডিবি পুলিশ ফিরোজ ও হামিদুল নামে ২ জনকে গ্রেফতার করে। সেই মামলার তদন্ত করছি মূলত ফিরোজ ও হামিদুল কিডনি পাচার বা বিক্রি চক্রের সক্রিয় সদস্য। এছাড়াও অনেক দালাল চক্র আছে যা তদন্ত চলছে।

জয়পুরহাট সিভিল সার্জন ডাঃ ওয়াজেদ আলী বলেন, একটি কিডনি বিক্রি করলে ২ কিডনির বদলে ১ টি কিডনির উপর চাপ পড়ে শরীরে নানা রকম ক্ষতি ও সমস্যা হতে পারে। সরাসরি আইন প্রয়োগ করা আমাদের সুযোগ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *