স্টাফ রিপোর্টার
একটা নালা খনন নিয়ে খাল কেটে কুমিড় আনার ন্যায় কৃষকদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের আংগারদোহা থেকে ইটাকুমারী হয়ে চাকিরপশার ও মাঝপাড়া দলার কয়েক’শ কৃষকের। এতে করে দুই এলাকার প্রায় ৩শ একর জমি ইরি চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কিত রয়েছে কৃষকরা। তবে এই নালা খনন নিয়ে বর্তমানে দেখা দিয়েছে নানান জঠিলতা। তবে এলাকাবাসীর দাবী ব্যক্তি মালিকানা জমিতে নালা খননে ক্ষতিপূরণ ও মাঝপাড়ার নালার শেষ মাথায় একটা ব্রীজ নির্মান। তবে উপজেলা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই নালা খনন নিয়ে সচেতন মহলে তোলপাড়া শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) কুড়িগ্রাম জেলা ২০১৮ সালে রংপুর ভু-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন ও সেচ দক্ষতা বৃদ্ধি করণ প্রকল্পে প্রায় ৯০ কিলোমিটার খাল বিল খননের বরাদ্দ পায়। প্রথমে প্রকল্পটি উলিপুর এলাকার বুড়ি তিস্তাসহ আশপাশ খাল-বিল খনন প্রক্রিয়া শুরু হলেও সেখানকার স্থানীয় জনগণ বাঁধা দেয়। তারা সে সময় ওই পুরো বরাদ্দের কাজটি শেষ করতে পারিনি। পরে ওই বরাদ্দের কাজটি রাজারহাট উপজেলার চাকরিপাশার বিলে নিয়ে আসেন।
সুত্র মতে, রাজারহাটের ইটাকুমারী হয়ে চাকিরপশার দোলা দিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার নালা খনন এর কাজটি প্রথমে স্থানীয় ঠিকাদারকে করতে বলা হয়েছিল। ব্যক্তি মালিকানা জমি দিয়ে খাল খননসহ অন্যান্য সমস্যা থাকায় তারা অপারগতা প্রকাশ করেনে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই এলাকার ঠিকাদার আজিজ। পরে ২০২০-২১অর্থ বছরে ইটাকুমারী হয়ে চাকিরপশার দোলা দিয়ে বিল খননে কাজটি করেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মেসার্স আনসারী কন্ট্রাকশন। করোনাকালীন সময়ে কাজটির উদ্বোধন করা হলে সে সময়ে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন কেউই উপস্থিত ছিলেন না। কুড়িগ্রাম বিএডিসি নিজেরাই উদ্বোধন করেন। কাজটি শুরু হলে স্থানীয় জমির মালিকরা বাঁধা প্রদান করেন। অনেকটা বল প্রয়োগ করে তারা কাজটি সম্পন্ন করেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানা জমি দিয়ে খনন কাজ করায় কায়ুম নামে এক ব্যক্তি আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর আদালত নিষেধাজ্ঞা দিলে সেটা অমান্য করে আবারও খনন করতে থাকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। পরে বিষয়টি পুণরায় বিজ্ঞ আদালতের দৃষ্টি আনলে আদালতে স্থানীয় নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর থেকে কাজটি বন্ধ রয়েছে।
উপজেলার নাফাডাঙ্গা মৌজার বোতলা ব্রীজ এলাকার ওমর ফারুক মন্ডল জানান, আমার নামে রেকর্ডীয় প্রায় ১ এক জমিতে নালা খনন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কোন অনুমোদন তারা নেয়নি। এই প্রকল্পটি উলিপুরের ছিল। তারা টাকা ভাগবাটোয়ারা করে খাওয়ার জন্য এবং তুহিন নামে এক ব্যক্তি খাস জমি হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দুস্থ লোকজননের ব্যক্তি মালিকানা জমি দিয়ে নালা খনন করা হচ্ছিল। পরে কায়ুম নামে এক ব্যক্তি আদালতের স্মরনাপন্ন হলে কাজটি স্থগিত হয়ে যায়। আংরাদোহা ব্রীজ এলাকার
সরেজমিনে দেখা গেছে, আংরাদোহা ব্রীজ হতে বোতলা ব্রীজ পর্যন্ত ১ কিলোমিটার নালাটি খনন করা হয়েছে। এই ১ কিলোমিটারের কোন খাস জমি নেই। সকল জমি ব্যক্তি মালিকানা। যখন কাজটি শুরু হয় কাউকে কোন নোটিশ দিয়ে জানানো হয়নি। দু’বছর আগে কাজটি শুরু হওয়া উপজেলার নাফাডাঙ্গা, খালিশা, চাকিরপশা, তালুক চান্দামারী ও সওদাগর এলাকার প্রায় ৩ এক জমিতে গত বছর ইরি চাষাবাদ করতে পারেনি কৃষকরা। ইটাকুমারীসহ নাফাডাঙ্গার সকল পানি এসে চাকিরপশার মাঝপাড়া বিলে জমা হয়। সে কারণে কৃষকরা কোন চাষাবাদ করতে পারেননা। সাতমল্লিক বেগ নাফাডাঙ্গার আব্দুল আউয়াল (৭০) কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, আমার মাত্র ৩০ শতক জমি ছিল। সেই জমির ২৫ শতকেই নালা খনন করা হয়েছে। আমি এখন কি খেয়ে বাঁচবো। আমার সন্তানরা আমার দেখ ভালো করে না। আমি এই জমি সাফাতুল্লার কাছ থেকে দলা শ্রেণী হিসেবে ক্রয় করেছিলাম। খারিজ-খাজনাসহ সকল কাগজপত্রাদি সঠিক রয়েছে। তবুও জোড় করে আমার জমিতে নালা খনন করা হয়েছে। আমি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি জানাই।
কথা হয় ৩নং ইউপির ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল আউয়াল, শাহজাহান আলী, শাহিদুল ইলাম, শফিকুল ইসলাম ও তোফাজ্জল হোসেন এর সাথে। তারা জানান, উজান থেকে পানি এসে চাকিরপশা ও মাঝপাড়ার বিল ভরাট হয়ে যায়। এতে করে আশপাশের বাড়ি-ঘরেও পানি ঢুকে পড়ে। এই মাঝপাড়ায় এক ব্রীজ নির্মাণ করা হলে সেই পানি চান্দামারী ব্রীজ হয়ে উলিপুরের বুড়ি তিস্তায় সংযোগ পাবে। তখন আর জলাবদ্ধতা থাকবে না এবং চাষাবাদে সমস্যা হবে না।
এলাকাবাসী জানায়, সরকারের তথ্য মতে রাজারহাট এলাকার চাকরিপশারসহ আশাপাশ এলাকায় নদ বা নদীর কোন অস্তিত্ব নেই বা কোন সময়ে ছিল না। এই নদ বা নদী হিসেবে ওই এলাকাকে বাস্তবে রুপ দিতে একটি মহল অপতৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। এমনিতে কুড়িগ্রাম এলাকার মঙ্গা পীড়িত। নদী ভাঙ্গনসহ নানাবিধ সমস্যা জর্জরিত সাধারণ মানুষ।
সুত্র মতে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন স্মারক নং উল্লেখ করে ২০২০ সালে পৃথক ৩টি চিঠি দেয় কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে। তারা চিঠিতে উল্লেখ করেন, কুড়িগ্রামের রাজারহাটের চাকিরপশার বিলটি বিদ্যানন্দ ইউপি শুরু হয়ে উলিপুর উপজেলার কথিত বুড়ি তিস্তা নদীর সংযোগ ছিল। এই এলাকা এক সময় নদ ছিল। এরই প্রেক্ষিতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারক নং ৩১.৪৭.৪৯০০.০০৬ .০৪.০৫৮.২০-১০৯, তারিখ ১৯/০১/২০২১ইং এবং ৩১.৪৭.৪৯০০.০০৬. ০৯.০২৪.২০.৫৯, তারিখ ০৫/০১/২০২২ ইং মোতাবেক দুটি পৃথক চিঠিতে উল্লেখ করা হয় রাজারহাটের চাকিরপশার এলাকার প্রায় ৪-৫ কি.মি. জুড়ে বিলটির বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন থেকে শুরু হয়ে রাজারহাট ইউনিয়নের চান্দামারী মৌজায় শেষ হয়েছে। ওই এলাকার সম্পত্তিতে কোন প্রকার নদ বা নদী কখনই ছিল না। এগুলো বিল বা দলা শ্রেণীর জমি। অপর একটি চিঠিতে ওই এলাকাগুলোতে কিছু পরিমাণ খাস জমি রয়েছে এবং তা লীজ ভিত্তিতে কৃষকদের মাছ চাষের জন্য দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের ঢাকার ভুমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০২১ইং থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ওই এলাকার জমিগগুলো খাল বা বিল হিসেবে সেখানেও উল্লেখ রয়েছে।
কুড়িগ্রাম বিএডিসি’র উপ-সহকারী প্রকৌশলী দীপক চন্দ্র রায় মুঠোফোনে জানান, করোনাকালীন সময়ে খনন কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। সে সময়ে আমরা উপজেলা প্রশাসনকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম কিন্তু তারা আসেনিন। ব্যক্তি মালিকার রেকর্ডীয় জমিতে কিভাবে খনন করলেন এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
রাজারহাট উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, ইটাকুমারী হয়ে চাকিরপশার বিল খনন কাজের অনাপত্তিপত্র নেয়ার জন্য আসে কুড়িগ্রাম বিএডিসি। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন থেকে বলা হয় ব্যক্তি মালিকানা জমিতে কিভাবে বিল খনন করা হলো সে বিষয়ে বিস্তারিত কোন তথ্য নেই। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুরে তাসনিম। তিনি জানান, কৃষি খাস জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার জন্য একটা খাল খনন কাজ করা হয়েছিল। শুরুতে আমি ছিলাম না। তারা কিছুদিন আগে আমার কাছে এনওসি নেয়ার জন্য এসেছিল। পরে আমি বিষয়টি তদন্ত করে দেখি পুরোটা খাস জমির উপর ছিল না। ওখানে ব্যক্তি মালিকানা জমি রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই কিভাবে কাজটি শুরু হলো এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএডিসি’র যেহেতু উপজেলা পর্যায়ে কোন অফিস নেই, সে কারণে আমরা আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছি। তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।