আমাদের বাংলাদেশে অনেক রাজনীতিবিদেরা সারা বছরই শুনে আসছি ভারতের সাথে কথা হলেই প্রথমে আসে তিস্তা চুক্তি নিয়ে নানান কথা। কিছু লিখবেন তারও উপায় নেই হয়তো অনেক কষ্ট করে তথ্য উপাত্ত নিয়ে লিখছেন কিন্তু পত্রিকায় ছাপা হচ্ছেনা । আবার লিখছেন হয়তো কেউ শেয়ার করে বর্তমানের যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করল পুর্ন কাহিনী পড়ার আগেই পাঠকের মধ্যে জাত-পাত রাজনীতি,বিভিন্ন রাষ্ট্রের অনেক বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। সত্যিটা ত্যাগ করে বুঝে না বুঝেই অধিকাংশ সময় পক্ষপাতমুলক সমালোচনার তর্কবিতর্ক শুরু হয়। ফলে আলোচনার মৌলিকত্ব নষ্ট হয়ে যায়। আমার আজকের বিষয়ে পাঠকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এককালের আমার ঘনিষ্ট বন্ধু আমজাদ হোসেনও একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন তা হচ্ছে আমাদের দেশের প্রায় কবি সাহিত্যিক ঠিক একই কাজ করে গেছেন তা হচ্ছে তারা আসলে কি লিখতে গিয়ে কি লেখেন সেটা তারা নিজেরাও বুঝেনা। এটা যে সাহিত্যের জন্য চরম দুরাবস্থা এটাও বুঝেনা। কয়েকদিন আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক মানবজমিন পত্রিকা সহ কয়েকটি পত্রিকার সারমর্মে দেখা যায় তিস্তা চুক্তি নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমুন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ৩৬০ ডিগ্রী বা বৃত্তাকারে ঘুরছেন। পরিশেষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুষমা স্বরাজও একই পথে হাটছেন। সবাই তাদের আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক নিরীখে এক হয়ে তোর্ষা,গঙ্গাধার,কালজানী সগ অন্যান্য নদী খননের কথা বলছেন। কিন্তু দেহের তাপমাত্রা যখন বৃদ্ধি পায় তখন জ্বর নাশক প্যারাসিটামল না দিয়ে যদি পা কেটে সিঁধুর দেয়া হয় কেমন চিকিৎসা হবে? আর এটা কি কোন রোগীর অভিভাবক মেনে নিবে?অথচ সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কিন্তু জোর গলায় বলেছেন উভয় দেশের সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে। আমরা অতীতে দেশ বিভক্তি দেখেছি সেখানেও ভারত সরকারের একই নীতি কাজ করেছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদ করা দাদাবাবুদের জন্য খুব প্রয়োজন থাকলেও ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসুর অবিভক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব বাংলার দাবীদার সমর্থনে তারা একমত হতে পারেনি। দাদাবাবুরা ১৯০৫ সালে এক বস্ত্রে ব্রত পালনের মাধ্যমে গঙ্গা ¯œান করে হাতে রাখি বন্ধন পড়ে মাটির সরাতে অন্ন রান্না করে দাবি আদায়ের মাধ্যমে ব্রত ভঙ্গ করেন কিন্তু ১৯৪৭ সালে সব ভুলে গিয়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় মেতে যান এবং পুর্ব বঙ্গকে যবন(ম্লেচ্ছ),শুদ্র বলে বিভক্তির মাধ্যমে পরিত্যাগ করেন। বিচারে যেমনটি বলা হয় বিচার যাই হউক তালগাছ টা কিন্তু আমার। ঠিক তাই দেশ বিভক্তির পর পুর্ব বাংলার ভাগে না পেল আগা আর না পেল মাথা।
৫৫হাজার ৫শ ৯৮ বর্গমাইলে তখনকার দিনে লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২০ লক্ষ । শতকরা ৮০ ভাগই ছিল দরিদ্র ও সর্বহারা। এখানকার জমিদার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। ফলে ধনে সম্পদশালী ছিল তারাই। পুর্ব বাংলার বড় বড় ব্যবসায়ী ও মহাজন বংশ পরম্পরায় সব হিন্দু সম্প্রদায়েরই ছিল। তারা সকলে যা কিছু গড়ে বা বিনিয়োগ করতো তার প্রায় সবই কলকাতা,হুগলী ভিত্তিক এবং বাংলা ভিভক্তির পর তাদের পুঁজি সঞ্চিত মুল্যবান সামগ্রী সবই ভারতে চলে যায়। এ বঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের হাতে তেমন কোন মুলধন ছিলনা। একমাত্র অর্থকরি ফসল পাট ব্যবসাটিও মুলতঃ হিন্দু মাড়োয়ারীদের হাতে ছিল। কৌশলে মুনাফার টাকাটাও ভারতে বিনিয়োগ বা স্থানান্তরিত হত। পুর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। দেশ বিভক্তির পর কয়েক হাজার হিন্দু পরিবার পুর্ব বাংলা থেকে ভারতে যাওয়ার কারনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।সে বিপর্যস্ত অর্থনীতির পাশাপাশি ভারত থেকে আসতে থাকা লক্ষ লক্ষ নিঃস্ব বাস্তুত্যাগী মানুষের ঢল যার সংখ্যা সরকারী হিসাবে ৭ লক্ষ বলে ধরা হয়। পুর্ব বাংলার ভাগে চাষযোগ্য জমি সর্বমোট ২ কোটি ৪০ লক্ষ একর। যার মধ্যে ঐ সময় ১ কোটি ৮০ লক্ষ একরের মত চাষাবাদ করা যেত । এর মধ্যে ১৮ লক্ষ একর জমি পাট চাষাবাদ করা যেত। অর্থকরি ফসলের মধ্যে ছিল পাট কিন্তু ৬৮হাজার ২শ ৫৮ টি তাঁত সম্বলিত ১১৩ টি পাট কলের মধ্যে একটি পাট কলও পুর্ব বাংলার মাটিতে ছিলনা। শিক্ষায় পুর্ব বাংলার মুসলমানরা পিছিয়ে থাকায় চাকুরীতে হিন্দু সম্প্রদায় অগ্রগামী ছিল। সমগ্র পুর্ব বাংলায় সুপারিয়র সিভিল সার্ভিস কমিশনে মাত্র একজন মুসলমান কর্মচারী ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর প্রশাসন যন্ত্রে পুর্ব বাংলার জনগনের উপর চেপে বসে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের লোক ও বাস্তুত্যাগীদের মধ্য থেকেই। খনিজ সম্পদ বলতে পুর্ব বাংলা কিছুই পায়নি। তবে মৎস্য সম্পদ এবং ২ লক্ষ হস্তচালিত তাঁত ছিল। বনজ সম্পদের মধ্যে পশ্চিম বাংলা ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এবং পুর্ব বাংলা ২ লক্ষ টাকার রাজস্ব আদায়ের বনাঞ্চল পায় যার আনুপাতিক হার ছিল ১৩:৪। পুর্ব বাংলার স্থল পথ ছিল অত্যন্ত নি¤œমানের। উল্লেখ্য পরিমানের পাকা রাস্তা এখানে ছিল না। তবে ১হাজার ৬শ ১৯ মাইলের রেলপথ পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে রেলপথগুলি বেশী ব্যবহারের ফলে ইঞ্জিন ও গাড়ীর অবস্থা ভগ্নদশা ছিল। বৃটিশ ভারতের শতকরা ২০ ভাগ লোকের বাস ছিল বাংলায়। সমগ্র ভারতের শতকরা ৩৩ ভাগ শিল্প ছিল বাংলায়। তার মধ্যে শতকরা ২.৭ ভাগ পুর্ব বাংলায় আর ৩০.৩ ভাগ শিল্প ছিল পশ্চিম বাংলায়। শতকরা ৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সমগ্র পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। কলকাতা সমুদ্র বন্দরের পরিবর্তে চট্রগ্রাম বন্দর গড়ে দেয়ার কথা সেটাও হয়নি। মোট কথা ছিল না জমিদারী,অর্থ বিত্ত,শিল্প এবং ছিলনা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।
শরৎ বসুর ধারনা ছিল অবিভক্ত বাংলার দ্বি-জাতিতত্ব ভুল প্রমানিত করবে।
কিন্তু বাবুদের ধারনা ছিল কালে বিভক্ত বাংলা কলকাতা ছাড়া মাথা তুলে দাড়াতে পারবেনা। ফলে পুর্ব বাংলা কোন এক সময় বিনা রক্তপাতে তাদের হয়ে যাবে। এই বিভক্তি সুক্ষ্ম একটি পরিকল্পনার আভাস দেয়। আবুল মনসুর আহমদের লেখা”আমার দেখা পঞ্চাশ বছর”গ্রন্থে ১৯৪৭ সালেরর বাংলা বিভক্তি নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকির কথা বলেছেন। দুই বাংলার রাজধানী কলকাতা ছেড়ে দেয়ার অসংখ্য লাভ ও সুবিধা সম্পর্কে যুক্তিতর্ক দাড় করান। তাদের যুক্তিগুলির মধ্যে বড় যুক্তি ছিল কলকাতা ছেড়ে দিলে সমস্ত দায় শোধ করেও পুর্ব বাংলা নগদ ৩৩ কোটি টাকা পাবে। এই টাকা দিয়ে পুর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা শহরকে নিউইয়র্ক শহরের মত গড়ে তোলা সম্ভব।
বাবুরা খাঁজা নাজিমুদ্দিন ও চৌধুরী হামিদুল হকের বরাত দিয়ে আবুল মনছুর আহমদের সামনে কলকাতা হারানোর বক্তব্য পেশ করেন। অতঃপর কলকাতা ছেড়ে দিয়ে বাটোয়ারা কাউন্সীলের উপর নির্ভর করতে হয়।
পশ্চিম বাংলার পক্ষে নলিনী সরকার ও ধীরেন মুখার্জী,পুর্ব বাংলার পক্ষে খাঁজা নাজিমুদ্দিন ও সারোওয়ার্দী ।
কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সীলের চেয়ারম্যান ছিলেন স্বয়ং বড় লাট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন,ভারতের পক্ষে সর্দার প্যাটেল ও মিঃ এইচ,এম প্যাটেল এবং পাকিস্তানের পক্ষে লিয়াকত আলী খাঁ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। মুল ৪ টি বিষয়ের মধ্যে সরকারী বাড়ী-ঘরের মুল্য নির্ধারনের নীতিই ছিল প্রধান। পুর্ব বাংলার প্রতিনিধিরা দাবী করেন বর্তমান বাজার মুল্যে সরকারী বাড়ী ঘরের দাম নির্ধারণ করতে হবে। পক্ষান্তরে পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিরা দাবি করে আদি মুল্যে ও সবের দাম নিধারণ করতে হবে। কিন্তু আদি মুল্য যে নির্মান মুল্যেে চেয়েও কম তা স্পষ্ট। বাবুরা হিসাব ধরে দেয় সরকারী হিসাব মতে প্রথম শ্রেণীর ইমারত প্রতিবছর শতকরা ১ ভাগ হারে এবং দ্বিতীয় শ্রেনীর ইমারত সমুহ শতকরা ২ ভাগ হারে দাম কমে যায়। মেশিনারী সরঞ্জামের অবমুল্য যে নীতিতে ধরা হয় বাড়ী ঘরের অবমুল্যও সে নীতিতে ধরা হয়। পরিশেষে এর অর্থ দাড়ায় কলকাতার সরকারী বাড়ী ঘর ও যন্ত্রপাতি পশ্চিম বাংলা জিরো মুল্য পাবে। অবশেষে হামিদুল হক চৌধুরী বলেন হিসেবের হেরফেরে ৩৩ কোটি টাকা থেকে পুর্ব বাংলা নীট পাবে মাত্র ৯ কোটি টাকা।
এই কথাটি সকলের কাছে পৌছার আগেই নলিনী সরকার জানিয়ে দিলেন ভারত ও পশ্চিম বাংলার কাছে পুর্ব বাংলার পাওনা ৩ কোটি টাকা আর পুর্ব বাংলার কাছে ভারত ও পশ্চিম বাংলার পাওনা ৯ কোটি টাকা। পুর্ব বাংলা আগে পশ্চিম বাংলা ও ভারতের ৯কোটি টাকা পরিশোধ করবে তারপর পুর্ব বাংলা ৩ কোটি টাকা পাবে। সত্য যুগে ছিল শুভঙ্করের ফাকি ,৩৩ থেকে ৩০০ বাদ দিলে ৩০ থাকে বাকী। ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার মমতা ব্যানার্জীর সাথেই ৩৬০ ডিগ্রীর বৃত্তাকারে ঘুরে দাড়ানোর কথাই বলেছেন। ফলে তিস্তা চুক্তি আর একটি শুভঙ্করের ফাঁকির দিকেই ধাবিত হচ্ছে বলে মনে হয়।
###
মনজুরুল ইসলাম
লেখক,সাংবাদিক ও গবেষক