বিশেষ প্রতিনিধি
চট্রগ্রাম থেকে শিশুসহ এক রোহিঙ্গা নারী, উখিয়া, কক্সবাজার। জানুয়ারি ১৮, ২০১৭।
পর্যাপ্ত খাবার নেই, নেই ঘরবাড়ি বা শৌচাগার। মিয়ানমার থেকে আসা বহু রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন স্থানীয় লোকজনকে বিয়ে করছে নাগরিকত্ব অর্জনের আশায়। তারা মনে করে এই বিয়েই হয়তো তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের সিঁড়ি।
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘুরে ঘুরে নারী–শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছে বেনারনিউজ। জানা গেছে নারী-শিশুরা বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহের মতো আইনগতভাবে নিষিদ্ধ সম্পর্কে হরহামেশাই জড়াচ্ছেন। অনেকে আশা করে বাংলাদেশি বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু স্বামীরা তাঁদের ছেড়ে চলে গেছেন।
এইসব বিয়ের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি, দুই পক্ষেরই ভূমিকা রয়েছে।
টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ২৯ বছর বয়সী সুলতান আহমেদ বিয়ে করেছেন ১৬ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী সমুদা বেগমকে। সমুদা সাত-আট বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছেন । থাকেন মুছুনি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে।
“এই বিয়েটা আমি শখে করেছি। তবে প্রথম স্ত্রীর সম্মতি নিয়েছি,” তিন সন্তানের জনক সুলতান বেনারনিউজকে বলেন। তিনি আরও বলেন, “আমি বড় স্ত্রীর সঙ্গেই থাকি। মাঝে মাঝে সমুদার কাছে যাই। বাজার-সদাই করার জন্য তাকে কিছু টাকা–পয়সা মাঝে মাঝে দেই।”
সহিংসতা আর ক্ষুধার জ্বালায় বছর তিনেক আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন রাজু বেগম (২৫)। এক বাংলাদেশিকে বিয়েও করেছিলেন। এখন তিনি স্বামী পরিত্যক্তা।
“আমি নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় নোয়াখালীর এক লোককে বিয়ে করেছিলাম। সংসারে শান্তিও ছিল। কিন্তু দুই সন্তান জন্মের পর আমার স্বামী টেকনাফ ছেড়ে চলে যায়”, রাজু বলছিলেন।
রাজু এখন মিয়ানমারের মংডু জেলার ঠিক উল্টো দিকে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর কচুবুনিয়ায় থাকেন।
রাজু বলেন, তাঁর স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি। টেকনাফে কাজ করতে এসেছিলেন। কাজও শেষ, পরিবারের প্রতি স্বামীর ভালোবাসাও শেষ। সমুদার মতো তিনিও আর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাননি।
তবে রাজু আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান না। তিনি হোটেল ও বাড়িতে ঠিকে ঝি এর কাজ করেন।
“আমি এখানেই থাকব। ছেলে–মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে এখানেই থিতু হব” বেনার কে বলেন রাজু।
‘এক নম্বর পছন্দ’
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছেন। রোহিঙ্গা চরমপন্থীরা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর চৌকিতে হামলা চালিয়ে নয়জন কর্মকর্তাকে হত্যার পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর মারাত্মক নির্যাতন শুরু হয়।
বহু নারী বলেছেন, তাঁদের স্বামীদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে বা হত্যা করেছে। তারপরই তাঁরা ছেলেমেয়েসহ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এ ছাড়া বেনারনিউজ যে ৫৪ জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাদের ১৭ জনই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
তবে বাংলাদেশেও তাদের জীবন সুখের নয়। কষ্টে দিন কাটে।
এ দফায় মিয়ানমার থেকে বড় সংখ্যায় অনুপ্রবেশের আগে কক্সবাজারের জাতিসংঘ অনুমোদিত শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার। এর বাইরেও শরণার্থী শিবির সংলগ্ন এলাকায় আরও প্রায় তিন লাখ শরণার্থী থাকছেন। তাঁরা বাঁশ ও প্লাস্টিক দিয়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি তুলেছেন। বেনারনিউজ প্রতিনিধি দেখেছেন ওই এলাকায় পাঁচ হাজার মানুষের জন্য চাপকল আছে একটি, শৌচাগারও একটি।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ সরকার বলছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। অন্যদিকে মিয়ানমার দাবি করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক। অবৈধভাবে তারা মিয়ানমারে প্রবেশ করেছে। তাই মিয়ানমারে তারা নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারছে না কয়েক দশক ধরে।
রোহিঙ্গারা এখন নাগরিকত্বের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা মনে করছে, একবার নাগরিকত্ব পেলেই তারা শরণার্থী শিবির থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে, মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করতে পারবে, বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পাবে। পরিবারগুলো তাই বহুবিবাহ বা বয়স্ক লোকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়া, সবকিছুই মেনে নিয়েছে। কারণ তারা মনে করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই বিয়েই হবে তাদের রক্ষাকবচ।
এ প্রসঙ্গে লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন “এখানে লেখাপড়ার কোনো সুযোগ নেই। অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমরা একটা ঘরে কোনোমতে থাকি। তাই ছেলে মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি পাত্র বা পাত্রী আমাদের প্রথম পছন্দ।”আইন মানছেন না কেউ’
কিন্তু বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা মিলছে না কোথাও।
বাংলাদেশে অন্য দেশের নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। যেহেতু বিয়ে নিবন্ধনের সুযোগ নেই তাই কর্তৃপক্ষ চাইলে যে ব্যক্তি রোহিঙ্গা কোনো নারীকে বিয়ে করেছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
টেকনাফের সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী বেনারনিউজকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের বিয়ে করা আইনত নিষিদ্ধ, কিন্তু কেউ নিয়ম মানছে না। রোহিঙ্গারা মনে করে এদেশে একটি সন্তানের বিয়ে দেওয়া মানে নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ সহজ হওয়া। সে কারণেই তারা বাচ্চা মেয়েকে বয়স্ক বাংলাদেশি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। এই সুযোগ স্থানীয় লোকজনও কাজে লাগাচ্ছে।”
তবে বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ হয় না বলে বেনারকে জানান টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক। তবে তাঁর মতে, বিয়ে করলে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়াটা সহজ হয়।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, একজনের যখন বাংলাদেশি স্ত্রী বা স্বামী থাকে তখন তাঁরা সহজেই ভোটার তালিকায় নাম ওঠাতে পারেন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে পারেন। কারণ দুই জনগোষ্ঠীকে আলাদা করা কঠিন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশি বিয়ে করেছেন বা কতজন এর মধ্যেই নাগরিকত্ব পেয়েছেন সে হিসাব তাঁদের কাছে নেই।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের মধ্যে বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছি। এ ধরনের বিষয়ে খবর শুনলেই আমরা পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। কিন্তু বিয়ে তো পারস্পরিক