মনজুরুল ইসলাম,এশিয়ান বাংলা নিউজঃ
বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির। অনেক মন্দির কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও কালের স্বাক্ষী মাদাইখাল কালী মন্দিরে ২৫৭তম বার্ষিক পুজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সনাতন ধর্মের মানুষের নিকট বার্ষিক সাংস্কৃতিক মহা উৎসবের অন্যতম পীঠস্থান হিসাবে রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার কালীগঞ্জ ইউনিয়নের মাদাইখাল কালী মন্দিরের বার্ষিক মেলা যা মাদাইখালের মেলা নামে বাংলাদেশের অন্যতম পরিচিত একটি মেলা।
বাংলাদেশে সনাতন হিন্দুদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন,প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান অবহেলা প্রভৃতি কারনে আজ বিলুপ্তির পথে প্রায় ২২৯ বছর মনান্তরে ২৫৭ বছরের প্রাচীণ ঐতিহ্যবাহী মাদাইখালের মেলা। মাদাইখাল মেলার উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে পয়ড়াডাঙ্গা গ্রামের শ্রী গজেন্দ্র নাথ বর্ম্মণ(৫৫),মাদাইখাল গ্রামের ৮৩ বছর বয়সী প্রবীণ সাইদুর রহমান , ৮২ বছর বয়সী মোহাম্মদ হানিফ আলী সহ অন্যান্য প্রবীণ স্থানীয়দের দাবি, তারা তাদের দাদার মুখে শুনে ছিলেন, দাদার দাদারাও নাকি জানতেন না আসলে এর উৎপত্তি কি বা কোথা থেকে। মাদাইখাল মন্দিরে তৈরি হওয়া নতুন দরজায় এর উৎপত্তি সাল ১২০০ বঙ্গাব্দ লেখা হলেও স্থানীয় বাসিন্দা যাদের বয়স ৮০ থেকে ৯০ এর কোঠায় এমনকি মেলার সেবায়েত ৯৩ বছর বয়সী মনাই চন্দ্রও জানেন না এর উৎপত্তি আসলে কয়শো বছর পূর্বে , তবে তাৎক্ষণিক একজন প্রহরী জানালেন, যে ফটকটি দেখতে পাচ্ছেন এ ফটকের আগে আরেকটি ফটকে এর প্রতিষ্ঠাকাল লেখা ছিল ১১৭২ বঙ্গাব্দ, সে হিসেবে এটি প্রায় ২৫৭ বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে ।

মাদাইখাল কালীমন্দির ও সংশ্লিষ্ট মেলার উৎপত্তি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, তৎকালীন বা আদিকালের মানুষের বিশ্বাস ছিল যে, রোগ থেকে বা যেকোনো ধরনের বিপদ থেকে মুক্তির জন্য মান্নত বা মনসা করলে মানুষের ইচ্ছা পূরণ হয়। ২৫৭ বছর পূর্বে মাদাইখাল নামক এই বিলের পাশের গ্রামে ‘পৌষনাথ’ নামে একজন কবিরাজ ছিলেন, তার কাছে কেউ রোগমুক্তি বা অন্য কোন সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি মাদাইখাল মন্দিরের এই স্থানটিতে মানত বা মনসা করতে বলতেন, সে বিশ্বাসে রোগ মুক্তি ও সমস্যা সমাধান হলে তারা এসে এখানে সেই মান্নতের বস্তু বা জন্তু দিয়ে যেতো, তখন থেকে এর প্রচলন ঘটে, এবং সে সময়ে ওই স্থানে ঠাকুরদা রসরাজ সরকার নামে এক সনাতন ধর্মালম্বী উক্ত স্থানটিতে এই কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, আর মাধাইখাল বিলের নামানুসারে এই মন্দিরের নাম এবং মেলার নামটি যুক্ত হয়ে যায়। নুনখাওয়া নদীতে পঞ্জিকা অনুযায়ী টিথি দেখে পুণ্যস্নানের দিনে শনিবার বা মঙ্গলবার পড়লে সেই দিন থেকেই এখানে মেলা শুরু হতো।
সেই থেকে প্রচলিত বিশ্বাস শুরু হয়ে তখন থেকে এই কালী মন্দিরে পূজার্চনার পাশাপাশি প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ দিন ধরে পঞ্জিকা তিথি দেখে এ মেলা হতো। যাতে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সনাতন ধর্মের লোকজন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল,ভুটান থেকেও সনাতন ধর্মালম্বী লোকজন আসতো, তবে এখন বাইরের দেশ থেকেও যেমন লোকজন আসে না। স্বাধীনতার পর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও লোকজন আসার পরিমাণটা অনেক কমে গেছে এবং মেলায় যে পরিমাণ মানুষ হওয়া কথা এখন আর তা হয় না। এমনকি বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মেলায় বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী সম্বলিত দোকান গুলিও ক্রেতা শূন্যতায় ভুগছে,এখন আর সেটাকে মেলা হিসেবে মনে হয় না জানান স্থানীয় কয়েকজন। মূল মন্দিরের ভিতরে বিশালাকৃতির একটি কালী মূর্তি রয়েছে, যার উচ্চতা সাড়ে ১৮ ফিট বলে জানান মন্দির কমিটির সেক্রেটারি সুভাষচন্দ্র, এর পাশাপাশি নিচে আরো ৬ থেকে ৭ টি দুর্গা ও অন্যান্য মূর্তি রয়েছে।
মন্দির কমিটির সভাপতি স্থানীয় কালিগঞ্জ হাই স্কুলের শিক্ষক কৃষ্ণ সরকার, সেক্রেটারি সুভাষ চন্দ্র সরকার, সেবায়েত মনাই চন্দ্র ও পুরোহিত স্বপন চক্রবর্ত্তী(৫০)। কথা হলে মনাই চন্দ্র(৯৩) বলেন, মেলা ছাড়াও শনিবার, মঙ্গলবার পূজা হয়, মেলা আর আগের মত নেই, মন্দির কমিটির সেক্রেটারী সুভাষ চন্দ্র জানান, আগে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার এত বেশি পরিমাণ মানুষ হতো যে চোখের পলকে একজন আড়াল হলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না, মন্দিরের মাইকে মাইকিং করে নির্ধারিত স্থানে আসতে বললে তাকে পেতেও অনেক সময় লেগে যেত, আর এখন তাকালে মন্দিরে কতজন মানুষ আছে, মেলায় কতজন এসেছে তা দেখাই যাচ্ছে। এর পরিধি ও ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, সাড়ে তিন বিঘা জমির উপর এটির অবস্থান। তবে অবতারবাদীরা মনে করেন মাদাইখাল কালী মন্দিরটিতে এখনও দেবী জাগ্রত এবং মহামায়া ভক্তদের প্রতিবছর দেবী স্বয়ং আবির্ভুত হয়ে মনোবাসনা পুরন করেন। এখনও এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটিকে ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুললে দেশে বিদেশের হাজার হাজার মহামায়া ভক্তদের আগমন ঘটবে বলে বিশ্বাস। তবে আগে ৭দিন ব্যাপী মেলা ও বলির সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ,যাত্রা,সার্কাস,পুতুল নাচ প্রদর্শনী,জুয়ার আসর জমতো। এখন যাত্রা,সার্কাস নিষিদ্ধ হওয়ার কারনে মেলায় লোকজনের সমাগমও কমে যাচ্ছে। পুর্বে মন্দিরের জমি ছাড়াও পতিত জমি থাকার কারনে পুজা ও মেলার লোকজনের সমাগম বেশী থাকতো। তবে পতিত জমি না থাকায় শুধুমাত্র মন্দিরের জায়গায় মেলা বসার কারনে ক্রমশঃ লোকজনের সমাগম কমছে। মন্দিরে পুজা ও উন্নয়নে সরকারী কোন সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সেক্রেটারি জানান, আমার জানামতে একসময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছিল।
পূর্বের মত মেলায় জুয়া বা অনৈতিক কর্মকান্ড চলে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক প্রধানি বলেন, মেলা-ই তো ঠিক মত চলে না, জুয়া তো দূরের কথা, এখন আর এই বিষয়গুলো মেলায় নেই, আগে হয়তো একসময় ছিল। মেলার নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নাগেশ্বরী থানার অফিসার ইনচার্জ নবিউল হাসান বলেন, মেলায় এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি, আশাকরি, আগামীকাল রবিবার শেষ হওয়া পর্যন্ত কোন সমস্যা হবে না।
ঐতিহ্যবাহী মাদাইখালের কালীর মেলা এক সময় সারা বাংলায় সুপরিচিতি লাভ করলেও আগের ঐতিহ্য আর নেই। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় মাদাইখাল কালী মন্দিরের উন্নয়ন ও পুজার সময় সরকারী পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করে আবার পুর্বের মত জাকজমকপুর্ন পুজা ও মেলার আয়োজন হউক এই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *