বিশেষ প্রতিনিধি.
রংপুর ডিসি অফিসের জিএম শাখা থেকে জেলা প্রশাসকের সই জাল করে একজন অফিস সহকারী ও পিয়ন ঢাকার একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তার সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় গত তিন বছরে প্রায় ৪০০ অস্ত্রের ভুয়া লাইসেন্স প্রদান করার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই কর্মচারীকে জেলা প্রশাসন বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা করেছে। ঘটনার দুই নায়ককে গ্রেফতার করতে দুদকসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।
ডিসি অফিস সূত্র জানায়, ডিসি অফিসের জিএম শাখার অফিস সহকারী সামসুল ইসলাম ও পিয়ন পান্নু ঢাকার একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তার সমন্বয়ে দীর্ঘ দিন থেকে ডিসি এবং সংশ্লিষ্ট সব সই জাল করে অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়ে আসছিল। সম্প্রতি বিষয়টি দালিলিকভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। এতে দেখা যায় ওই দুই কর্মচারী ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যারা ডিসি ছিলেন তাদের সই জাল করে চার শতাধিক অস্ত্রের ভুয়া লাইসেন্স দিয়েছেন। প্রতিটি অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য তারা ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন এবং টাকা দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়। এভাবে সিন্ডিকেটটি ২০০ কোটি টাকারও বেশি অবৈধভাবে আয় করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ব্যাকডেটে সই জাল করে দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্সগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের শেখ জহুরুল ইসলামকে দেয়া একটি ৩২ বোর পিস্তল, এফ৯৯৭৯৯ডব্লিউ, ইতালি, কার্তুজ ২৫ রাউন্ডসহ অস্ত্রের লাইসেন্স। যার নং০ ০৪/২০০০। অস্ত্রটি তিনি ক্রয় দেখিয়েছেন মেসার্স মাহবুব আর্মস কোং লিমিটেড, গনেশতলা দিনাজপুর থেকে। তিনি লাইসেন্স নেয়ার সময় রংপুর মহানগর শালবন এলাকার সোনালি এন্টারপ্রাইজের ঠিকানা দিয়েছেন। কিন্তু সেটা ছিল ভুয়া। এ ছাড়াও রংপুরের বদরগঞ্জের দামোদারপুর এলাকার রাজু আহমদের ছেলে সুমন আলীকে ২০০৬ সালে একটি ১ নালা বন্দুক, বেলজিয়াল ৫৫২১৬, কার্তুজ ১০ রাউন্ডসহ অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। যার নং ০২/২০০৬। ওই অস্ত্রটি কেনা হয়েছিল বগুড়া খান মার্কেটের খান আর্মস কোং লিমিটেড থেকে। এই লাইসেন্সটি রিনিউ করা হয় ২০১৫ সালে। অন্য দিকে রংপুরের তারাগঞ্জের ইকরচালী গ্রামের মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের পুত্র মনোয়ারুল ইসলামকে ২০০৯ সালে একটি এক নালা বন্দুক, আমেরিকা পিডটওয়াই-১৬ এর লাইসেন্স দেয়। যার নং ০৯/২০০৯। এই তিনটি লাইসেন্সই দেয়া হয় ডিসিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সই নকল করে। এভাবে ৪০০-এর বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বলে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি চ্যানেলের জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক প্রমাণপত্র নিয়ে ডিসি অফিসের সংশ্লিষ্ট দফতরে অনুসন্ধান চালাতে যান। সেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হলে বিষয়টি দালিলিকভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। ডিসি অফিসের জিএম শাখায় অভিযান চালানোর সময় অফিস সহকারী সামসুল ইসলামের আলমিরা থেকে ১১ লাখ নগদ টাকাও উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ডিসি অফিসের জিএম শাখার সব কাগজপত্র তাৎক্ষণিকভাবে সিলগালা করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন এবং অভিযুক্ত অফিস সহকারী সামসুল আলম ও পিয়ন পিন্টুকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় রংপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিন্টু বিশ^াস বাদি হয়ে সামসুল আলম ও পিন্টুর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন এবং সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারবিষয়ক আইনে দু’টি পৃথক মামলা করেছেন। অবৈধ অর্থ উপার্জনের জন্য মামলা হয়েছে দুদকে।
অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, রংপুর মহানগরীর খোর্দতামপাট এলাকার ছবিল মেম্বারের পুত্র সামসুল ইসলাম গত ১৫দিন আগেও খোর্দ তামপাট মধ্যপাড়া এলাকায় সেকেন্দারের বাড়ির কাছে ১ কোটি টাকা দিয়ে ১ একর জমি ক্রয় করেছেন। সরেয়ার তল এলাকায় তার একটি বিলাসবহুল তিনতলা এবং একতলা ছাদ পেটানো বাড়ি আছে। তিনি জিয়াদপুকুর এলাকায় একটি খানকা শরিফ দিয়েছেন। সেখানে ২০-৩০ জন অপরিচিত লোকসবসময় আসা-যাওয়া করেন। সেখানে খানকা শরিফের নামে ভিন্ন মতাবলম্বী চিন্তা-চেতনার শিক্ষা দেয়া হচ্ছেও বলে জানান এলাকাবাসী। তিনি ধাপ এলাকায় জমি ক্রয় করার জন্য বায়না করেছেন। আশরতপুর ঈদগাহ পাড়া এলাকায় মেয়ের জামাইয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় করেছেন। তার পিতা সবিল মেম্বারের নামে কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাংক ব্যালেজ ও জমি রয়েছে। এছাড়াও নামে-বেনামে তার প্রায় শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ আছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। অফিস সহকারী হয়েও তিনি প্রাইভেটকারে চলাফেরা এবং বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন।এর মধ্যে এক জামাই ঘরজামাই হিসেবে থাকেন তার বাড়িতেই। অথচ তার আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই আছেন যারা অর্থের অভাবে কোনো কিছু করতে পারছেন না। এ বছর তিনি কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে প্রচার প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। তার একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে। প্রায়ই তিনি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সফর করেন বলেও জানা গেছে।
এ দিকে তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ১১ দিন আগে ডিসি অফিস থেকে কৌশলে পালিয়ে যায় সামসুল আলম ও পিন্টু। তাদের গ্রেফতারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দুদক কম্বিং অপারেশন চালাচ্ছেন। গতকালও সরেয়ার তলে তার বাড়িতে অভিযান চালায় দুদুক ও পুলিশ। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী মঙ্গলবার তাকে ধরতে অভিযান চালায় দিনাজপুরেও।
রংপুরের ডিসি মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান জানান, বিষয়টিতে আমরা তাজ্জব বনে গেছি। ব্যাকডেটে এভাবে সই জাল করে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টি আমাদের হতবাক করেছে। আমরা তাদের সাসপেন্ড করেছি। তদন্ত করা হচ্ছে। মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনার সাথে আরো কেউ জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন