বিশেষ প্রতিবেদকঃ
আজ দোল-পুর্ণিমা। আগামী কাল পালিত হবে হোলি উৎসব। দিবসটি উপলক্ষ্যে সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে জেগে উঠেছে হোলি উৎসবে আনন্দ। ফাল্গুন মাসের দোল পুর্ণিমা সম্পর্কে সনাতন ধর্ম মতে ইতিহাস বলে হিন্দু ধর্ম ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,কৃষ্টি ও উৎসবের আনন্দে মানবতার বাণীকেই ধারণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। বারো মাসে তেরো পার্বণের ন্যায় হিন্দু ধর্মে লেগে আছে ঋতু ভিত্তিক উৎসব। এই সকল উৎসব ধর্মের গন্ডী অতিক্রম করে সর্বমানবীয় ,উদার,দার্শণিক তত্ত্বে ঋদ্ধ। প্রাচীণ কালে ঋষিরা তাই হিন্দু ধর্মকে ক্ষুদ্র গন্ডীতে আবদ্ধ করেনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর ইতিহাস হিন্দু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোত জড়িত।
দোল পুর্নিমাকে ঘিরে হোলি উৎসবও তেমনি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির উত্থানের ইতিহাস।
হিন্দু ধর্মালম্বীরা সবাই দৈত্য হিরণ্যকশিপুর কাহিনী জানে। ভক্ত প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্ম নিলেও পরম ধার্মিক ছিলেন। তাকে যখন বিভিন্নভাবে চেষ্ঠা করেও হত্যা করা যাচ্ছিল না তখন হিরন্যকশিপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। কারন হোলিকা ঈশ্বরের নিকট এই বর পেয়েছিল যে,আগুনে তার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু অন্যায় কাজে শক্তি প্রয়োগ করায় হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করলে বালক প্রহ্লাদের কোন ক্ষতি হয়না কিন্তু হোলিকা আগুনে পড়ে ছাই হয়ে যায়। বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদের এই অক্ষত আনন্দ উৎসবে পরিনত হয়। এই দহনকে হোলিকা দহন বলা হয়।
অপরদিকে দ্রাপড় যুগে বসন্তের এই দিনে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেন। মনান্তরে অরিষ্টার নামক অসুর বধের কথাও আছে। অন্যায়কারী,অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করায় পর তার রক্ত ছিটিয়ে সকলে আনন্দ করে। এই অন্যায় শক্তিকে ধব্ংসের আনন্দ মহানন্দে পরিনত হয়।
তবে যাই ্হউক বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হোলির রীতি ও বিশ্বাস বিভিন্ন মতের। বাংলা অঞ্চলে বৈষ্ণব প্রাধান্য রীতি প্রচলিত। রঙ উৎসবের আগের দিন হোলিকা দহন হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে। শুকনো গাছের ডাল,কাঠ ইত্যাদি দাহ্য বস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করে হোলিকা দহন হয়। পরেরদিন রঙ খেলা।বাংলাদেশেও দোলের আগের দিন এই রকম হয় যদিও তার ব্যাপকতা কম,একে আমরা চাঁচর বলি। এই চাঁচরের অন্যরকম ব্যাখ্যা আছে। দোল আমাদের ঋতু চক্রের শেষ উৎসব। পাতা ঝরার সময়,বৈশাখের প্রতীক্ষা। এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা,তার ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিকতা তাৎপর্য রয়েছে। পুরনো জঞ্জাল,রুক্ষতা,শুষ্কতা সরিয়ে নতুনের আহবান হচ্ছে এই হোলি। বাংলায় দোলের আগের দিন চাঁচর উদ্যাপনকে এই ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। প্রাচীন ভারত উপমহাদেশে অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদ্্যাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু উদ্যাপনের রীতি এক।

ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন বিশ্বাস করেন পুর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে এর উদ্যাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। পুরাকালে বিবাহিত নারীরা তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পুর্ণিমায় রঙ্রে উৎসব করতেন।
দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ,ভবিষ্য পুরাণ ও জৈমিনি মীমাংসায় রঙ উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। ৭ম শতাব্দীর এক শিলা লিপিতে রাজা হর্ষবর্ধণ কর্তৃক ‘‘হোলিকোৎসব’’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধণ নাটক ‘‘রতœাবলী’’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। এমনকি আল বেরুনীর বিবরণে জানা যায় মধ্য যুগে কোন কোন অঞ্চলে হিন্দুদের সাথে মুসলমানেরাও হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হতো।
মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলোর অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণের রঙ উৎসব। এই রাধা-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে হোলির যে অতি বৈষ্ণবীয় আচার তা অবশ্যই প্রশ্নযুক্ত। কেননা এটি শ্রী কৃষ্ণের জীবন ইতিহাসের সাথে সঙ্গতি পুর্ণ নয়। শ্রী কৃষ্ণ ১২ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করার পর সেখানে আর যাওয়াই হয়নি। অন্যদিকে বহু গবেষক রাধার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন। শ্রী কৃষ্ণের ঝুলন থেকে দোল কথার উদ্ভব।
যে যাই বলুক রাধা-কৃষ্ণের তত্ত্বকে দাড় করিয়ে বিপরীত লিঙ্গের মাঝে অবাধ হোলি খেলা অবশ্যই ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে সমর্থন যোগ্য নয়। আবার বিষাক্ত রঙ ব্যবহারও উচিত নয়।
হোলি নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের অসামাজিকতা পরিহার করা জরুরী।
হোলি সম্পর্কে বড় একটি তথ্য সকলেই এড়িয়ে যায়। ধর্ম ও সমাজ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর একটি উৎসবের দিন আরও পবিত্র হয়ে উঠে যদি উক্ত দিনে ধরণীতে মহান পুরুষেন জন্ম হয়। বাঙ্গালী তথা হিন্দু সমাজের অন্যতম মহাপুরুষ যাকে কলি যুগের অবতার হিসাবেও অনেকে মনে করে তিনি হলেন শ্রী কুষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম তিথি হচ্ছে ফাল্গুন পুর্ণিমা নিশি উদয় হলেন নিমাই শশী। এই মহান পুরুষের জন্ম উৎসবের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পৃথিবীতে যখন পাপাচার বৃদ্ধি পায় তখন ঈশ্বর সেই পাপাচারকে দুর করতে অবতাররুপে মানবকুলে জন্ম নেয়। বর্তমান পৃথিবী এমন অন্যায়ভারে ভারাক্রান্ত তাই মানুষের মধ্যে প্রয়োজন শুভবোধ,প্রতিবাদী শক্তি,সংগ্রাম ও সত্যের প্রতি সমর্পন। ধর্মীয় গন্ডী ছাড়িয়ে হোলি উৎসবের এই দিনে মহান আদর্শে আমাদের পাপ-পঙ্কিল ধরণীকে পরশ পাথরে সত্য করে তুলুক। অন্যায়কে পরাজিত করার আনন্দে সকলের মন রাঙিয়ে উঠুক। মহা পুরুষের আবির্ভাবে সকলের মন আনন্দে নেচে উঠুক এই কামনায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *