মোঃ মঞ্জুর হোসেন ঈসা
শিক্ষক দিবস হলো শিক্ষকদের সম্মানার্থে পালিত একটি বিশেষ দিবস যা বাংলাদেশ এবং ভারতসহ পৃথিবীর ১০০টি দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে উদযাপিত হয়। এদিন শিক্ষকদেরকে তাদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য সম্মাননা দেয়া হয়। ভিন্ন ভিন্ন দিনে উদযাপিত হলেও সেপ্টম্বরের ৫ তারিখ ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্ব শিক্ষক দিবস প্রচলিত হওয়ার পর থেকে এ দিনটি সারা পৃথিবীর শিক্ষকদের কাছে একটি মর্যাদার দিন।
২০০৩ সালে ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় শিক্ষক দিবস শুরু হয়।
আর ১৯৯৪ সাল থেকে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপিত হয়।
যদিও ১৭ সেপ্টেম্বর সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মহান শিক্ষা দিবস। শিক্ষার স্বার্থে রক্তে আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ইতিহাস। ১৯৬২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না-জানা অনেকেই। তাদের স্মরণে এই দিনকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
২০২০ সালের শিক্ষক দিবসটির প্রতিপাদ্য – ‘শিক্ষকঃ সংকটে নেতৃত্ব, নতুন করে ভবিষ্যতের ভাবনা’।

শিক্ষার অধিকার মানে হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়ার অধিকার’।
শুরু থেকে বাংলাদেশ এ দিবসটি পালন করে আসছে। যদিও সরকারিভাবে এখনবধি দিবসটি উদযাপিত হয়নি।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি আয়োজন করেছে।
বিশ্বের শিক্ষকদের অবদান স্বীকার, তাদের মূল্যায়ন এবং এগিয়ে নেয়াসহ শিক্ষক ও শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ইউনেস্কো দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেয়।
এবার এমন সময় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে যখন শিক্ষাঙ্গনে করোনার কারণে ছাত্রদের আনাগোনা নেই। নভেম্বরে করোনার সূচনা হয় সূদুর চীনে বাংলাদেশে তার ঢেউ আসে মার্চে। ১৭ই মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। যা বর্তমানে অব্যহত রয়েছে। অনলাইনে কিছু কিছূ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হলেও কিন্ডার গার্ডেন ও বেসরকারী ও তৃণমূল পর্যায়ের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন রকম শিক্ষা কার্যক্রম চলছে না। বাংলাদেশে ছোট ছোট অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কেউ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করার বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। হাজার হাজার শিক্ষক বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেই নিরুপায় হয়ে পেশাও বদল করে ফেলেছেন। কেউ কেউ অর্ধহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এযেন দেখার কেউ নেই। শিক্ষক নেতারা দীর্ঘদিন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় করণের দাবীতে আন্দোলন করছেন। এই ন্যায্য দাবী যদি সরকার আগেই বাস্তবায়ন করতেন তাহলে শিক্ষকের যেমন মর্যাদা বৃদ্ধি পেত তেমনি জাতীয় জীবনে আমরা অনেক গভীর সংকট থেকে মুক্তি পেতা্ম। দুঃখ জনক হলেও সত্য বাংলাদশের ৯৭% শিক্ষক বেসরকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর মাত্র ৩% সরকারী শিক্ষক এই ৯৭% শিক্ষকদের উপর কর্তৃত্ব করছেন। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে মহান শিক্ষকদের মর্যাদা তলানীতে চলে গেছে। ২০ বছর আগেও শিক্ষকদেরকে ছা্ত্ররা পিতার মত শ্রদ্ধা করতেন। বর্তমানে নানা কারণে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্র, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। লেজুর ভিত্তিক রাজনীতির কারণে এবং প্রাইমারীর প্রধান শিক্ষক, হাইস্কুলের প্রধান, মাদ্রাসার সুপার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রতিযোগিতায় মহান শিক্ষকরা এখন নগ্ন দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ভোটের রাজনীতিতে শিক্ষকদের কে আরো বেশী নগ্ন ভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। যে যখন ক্ষমতায় থাকেন সে তখন শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অযোগ্য এবং সুবিধাবাদী নামধারী শিক্ষকদেরকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সাড়ে বারটা বাজিয়ে ফেলেছে। রমরমা কোচিং বাণিজ্য কোন ভাবেই লাগাম দেয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকরাও ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে।কোন কোন শিক্ষকদের রোশানলের শিকার হচ্ছে ছাত্রীরা। এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপসংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষকদের উপর এখন অভিভাবকরাও আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এক সময় গ্রাম অঞ্চলে লজিং কিংবা জায়গির প্রথা প্রচলন ছিল। বর্তমানে এই প্রথা অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে।
আর এই কারণে অসহায়, গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাও অকালে ঝড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ভারতীয় চ্যানেল খুললেই দেখা যায় শিক্ষকরা ছাত্রীকে পড়াতে এসে অল্প সময়ের মধ্যে অনৈতিক প্রস্তাব দিচ্ছে এবং অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এর প্রভাব বাস্তব জীবনেও প্রচন্ড ভাবে দেখা দিয়েছে।
এখান থেকে মুক্তির উপায় আমরা খুজতে চাচ্ছি না। এছাড়া বর্তমান সময়ে বেসরকারী স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা যে সল্প বেতন পায় তাতে করে তার জীবন চলাই দূর্বিসহ হয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার অনৈতিক পথ বেছে নিতে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন।
করোনা কালীন সময়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে সব সরকারী, বেসরকারী, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান খূলে গেলেও এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটিও খোলা হয়নি। সরকারের বিধি নিষেধের কারণেই কেউ কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতেও পারে নি। বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস শুরু হলেও তৃণমূল পর্যায়ে এবং দারিদ্র সীমানায় অনেকে থাকার কারণে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে করে একদিকে একজন এগিয়ে যাচ্ছে অন্যজন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে। যদিও সরকার বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ের দরিদ্র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সহজ শর্তে ১০ হাজার টাকার ঋণ দেওয়ার যে ঘোষনা দিয়েছিলেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে নামের তালিকা করা হলেও সেই তালিকা নিয়েও প্রশন্ রয়েছে এবং কাউকে এ পর্যন্ত এই ঋনের টাকা প্রদান করা হয়নি।

ছাত্র শিক্ষকেদের সম্পর্ক পিতা পুত্রের চেয়েও বেশী পবিত্র। সেই পবিত্র জায়গা থেকেও আমরা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছি। এবার বিশ্ব শিক্ষক দিবস মুজিব বর্ষেই পালিত হচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। তিঁনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করার ঘোষনা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই ঘোষনা ও স্বপ্ন পূরণ করতে দেয়নি একদল হায়ানার দল। যারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নির্মম ভাবে হত্যা করেনি তাঁর গোটা পরিবারকেই নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিলো। মহান রব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আজো বেঁচে আছেন। এবং বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্যকন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তিঁনি গত বছর মহান সংসদে বলেছিলেন ”নির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হবে। তাঁর এই ঘোষনা শিক্ষক সমাজের হৃদয়ে নতুন আশা জাগ্রত হয়েছে। দেশবাসী সহ আমরা আশা করছি মুজিবর্ষের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদশের শিক্ষার ব্যবস্থা কে সহজ করে দেওয়ার জন্য এবং ঘরে ঘরে শিক্ষিত কর্মবীর তৈরী করার জন্য জাতীয় করণের ঘোষনা বাস্তবায়ন করবেন। শিক্ষক হোক সমাজ বদলে দেওয়ার হাতিয়ার। একজন শিক্ষক ছাত্রদের মূল্যবোধ শিখাবেন। ভালো মানুষ হওয়ার সুশিক্ষা দিবেন যাতে করে আর শুনতে না হয় সিলেটের এমসি কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রের কারণে মা-বোনদের ইজ্জত লুন্ঠিত হয়েছে।
লেখকঃ
চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন