তাজিদুল ইসলাম লাল,রংপুর ব্যুরো অফিসঃ
এইচএসসি পাশের পর ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স করে সরকারি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপ-সহকারী হিসেবে যোগদান করেন রেজাউল করিম। এরপর নিজের নামের পাশে ডাক্তার লাগিয়ে নিয়মিত রোগী দেখা শুরু করেন রংপুরের মেডিকেল মোড় এলাকায়। দিন দিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে শুরু করে দেন ভয়ঙ্কর প্রতারণা। কোটিপতি হওয়ার খায়েশে নিজে নিজেই বনে যান হাড়, জোড়, বাত-ব্যথা, পাইলস এবং দুর্ঘটনা জনিত রোগের বিশেষ অভিজ্ঞ ডাক্তার। পরে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সরকারি কর্মস্থলেও যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি। এবিষয়ে কৈফিয়ত তলবসহ কয়েক দফা নোটিশ করলেও কোন জবাব দেননি। রংপুর সিভিল সার্জনসহ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, রেজাউল করিম কোনভাবেই নামের পাশে ডাক্তার ও চেম্বার খুলে নিয়মিত রোগী দেখতে পারেন না। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের কথাও তারা জানান। এদিকে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকায় বেতগাড়ীসহ আশপাশে এলাকার প্রায় ৩০ হাজার দুস্থ্য ও অসহায় মানুষের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আবার এই ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দেখার কেউই নেই।
জানা গেছে, রেজাউল করিম দীর্ঘদিন ধরে ভূয়া ডাক্তার সেজে সাইনবোর্ড ও ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে দালাল নিয়োগ করে রংপুরের শত শত সহজ সরল নারী পূরুষদের চিকিৎসা সেবার নামে অপচিকিৎসা দিয়ে আসছেন। ভিজিটিং কার্ড ও প্যাডে তার নামের পাশে ডি.এম.এফ (ঢাকা) বি.এইচ.এস, হাড়, জোড়, বাত-ব্যথা, পাইলস এবং দুর্ঘটনা জনিত রোগের বিশেষ অভিজ্ঞ ডাক্তার। নাম লেখা রয়েছে ডাঃ মোঃ রেজাউল করিম (রিপন), উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গঙ্গাচড়া, রংপুর। তিনি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপ-সহকারী হলেও প্রতারণামুলকভাবে ভিজিটিং কার্ড ও প্যাডে মেডিকেল অফিসার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত বলে উল্লেখ করেছেন।
জানা গেছে, রেজাউল করিম ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) পদে রংপুরের পীরগঞ্জে টুকনিপাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০১৯ইং সালে গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে উপ-সহকারী হিসেবে বদলী হয়ে আসেন। এর আগেও সেখানে থাকাবস্থায় প্রায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ৬ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। সে রংপুর মহানগরীর ১৪নং ওয়ার্ডের মোঃ লোকমান হোসেনের ছেলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন চাকরিজীবীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কর্মচারী অফিস ফাঁকি দিয়ে প্রতারণামুলকভাবে চেম্বার খুলে রোগী দেখাসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করে এসেছেন। বেশ কয়েক বছর অবৈধভাবে আয়-রোজগার করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। পরবর্তীতে অসুস্থ্যতাসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে চাকরিতে যোগদান করে আবার অনুপস্থিতকালীন সময়ে বেতন/ভাতাদি একবারেই সরকারের কোষাগাড় থেকে তুলে নেন। একই পথে চলছেন স্যাকমো রেজাউল করিম।
স্থানীয় একাধিক ভুক্তভোগী রোগীরা জানান, এই ভুয়া ডাক্তার সিভিল সার্জন, সরকারি চাকরি ও প্রশাসনের উধর্বতন কর্তৃপক্ষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রংপুর নগরীর প্রাণকেন্দ্র (রংপুরের গুলশানখ্যাত) মেডিকেল মোড় ও টার্মিনাল এলাকায় পৃথক দুটি চেম্বার খুলে সাইনবোর্ড লাগিয়ে নিয়মিত রোগী দেখছেন। চিকিৎসার জন্য তার চেম্বারে প্রতিদিন দালালদের মাধ্যমে দূরদূরান্ত থেকে আসা সহজ সরল রোগীরা ভীড় করছেন।
সরজমিনে দেখা গেছে, রংপুর আরকে রোডের মিলেনিয়াম স্টারস/ক্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ এর বিপরীতে বড় করে টাঙ্গানো হয়েছে কোয়ালিটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার এর সাইনবোর্ড। একই ভবনে হলি ফ্যামিলি হসপিটাল, আনোয়ার ক্লিনিক এন্ড নার্সিং হোম। এই কোয়ালিটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে ৪ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগী দেখেন। সামনে রোগীদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ১০৯নং রুমে মাসে একদিন রোগী দেখেন হাড়, জোড়া, বাত-ব্যথা, বিকলাঙ্গ এবং দূর্ঘটনা জনিত রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুস সালাম। তিনি ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালের অর্থো সার্জন। ওই রুমটির দুইটি গ্লাসের দরজা রয়েছে। একটি দরজার উপরে অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুস সালামের নেমপ্লেট। রুমের ভিতর দুইটি টেবিল, কয়েকটি চেয়ার ও একটি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য ছোট বেড। এই রুমে বাকী সময় রোগী দেখেন ওই ভুয়া অভিজ্ঞ ডাক্তার মোঃ রেজাউল করিম রিপন। ১৩ ডিসেম্বর ২০ইং তারিখ সন্ধ্যায় ১০ বছর বয়সী আফসন মাসা নামে এক শিশু রোগী চিকিৎসা নেয়ার জন্য আসেন। শিশুটির এক পায়ের গোড়ালী ভাঙ্গা। গ্রামের নিরীহ শিশুটি ও তার পরিবার দালালদের মাধ্যমে জানেন, এখানে অভিজ্ঞ ডাক্তার আব্দুস সালাম বসেন। দীর্ঘ ৩ মাস যাবত চিকিৎসা সেবা নিয়ে ওষুধ খাচ্ছেন কোন কাজ হচ্ছে না। প্রথমে ৮শ টাকা ভিজিট দিয়ে দেখালেও পরবর্তীতে কয়েক দফা এসে ৫শ টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখান এবং প্রতিবারেই কয়েকটি টেষ্ট করার জন্য নিজস্ব ল্যাবে পাঠিয়ে দেন বলে জানান। শিশুটি নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে কিন্তু কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। এসময় ২৩ বছর বয়সী শাহিন নামে এক রোগী চিকিৎসাসেবা নেয়ার জন্য ঢুকেন ওই ভুয়া ডাক্তার রেজাউল ইসলাম রিপন এর ১০৯ নম্বর রুমে। ১০ মিনিট পর রুম থেকে বের হলে এ প্রতিবেদকের সাথে তাদের কথা হয়। রোগী শাহিন ও তার বয়স্ক অভিভাবক জানান- আমার ছেলের পাইলসের সমস্যা। দালালের মাধ্যমে এই ডাক্তারকে দেখাতে আসেন তারা। ডাক্তার ৭টি টেষ্টের জন্য তার প্যাডে লিখে দিয়েছেন। টেস্টগুলো করে আবার আসতে বলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল মোড় ছাড়াও আরকে রোডস্থ টার্মিনাল এলাকায়ও তার আরও একটি রোগী দেখার চেম্বার রয়েছে। কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল হতে শাপলা রোডস্থ আলহাজ্ব কালাম ভবন মার্কেটের নিচ তলার শেষের দিকে ট্রিটমেন্ট পয়েন্ট নামে দোকান ভাড়া নিয়ে চেম্বার খুলেছেন তিনি। এই মার্কেটের দ্বিতীয় তলার রোড সাইডে বড় করে সাইন বোর্ড ঝুলানো রয়েছে। সেখানে একজন কম বয়সী সহকারী/অফিস পিয়ন রয়েছে। রোগী সেজে কথা হয় তার সাথে। সে জানায়, ডাক্তার মোঃ রেজাউল করিম রিপন স্যার একদিন পর পর এখানে রোগী দেখেন। জরুরি রোগী আসলে মেডিকেল মোড়ের চেম্বারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সে আরও জানায়, একদিন পরপর ২০ থেকে ৩০ জন রোগী দেখেন স্যার। নতুন রোগী হলে ৮শ টাকা আর পুরাতন রোগীর কাছ থেকে ৫শ টাকা নেয়া হয়। স্যার হাড়, জোড়, বাত-ব্যথা, পাইলস এবং দুর্ঘটনা জনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগী দেখেন, ও অপারেশনও করেন তবে কি কি অপারেশন করেন, তা সে জানেনা বলে জানায়।
গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সুত্রে জানা গেছে, স্যাকমো রেজাউল করিম বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়ে গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ আসিফ ফেরদৌস গত ৮ই জানুয়ারি ২০২০ইং স্বাক্ষরিত উঃস্বাঃকমঃ/গংগা/রং/২০/২৬/৩৫/১ (৬) স্মারকমুলে কৈফিয়ত তলফ করেন। এরপর আরও ৪ বার কৈফিয়ত তলফ করা হয়। পরবর্তীতে গত ৭ই জানুয়ারি ২০২১ইং গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অননুমোদিভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিতির জন্য তার গ্রামের ঠিকানায় কৈফিয়ত তলব এর নোটিশ পাঠান। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি নিয়ম কানুনকে তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়াল খুশিমত চলাফেরার কারণে প্রশাসনিক কাজসহ বিভাগীয় কার্যক্রমের ভীষণ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি ২০১৮ ইং মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন কৈফিয়তেরই জবাব দেননি তিনি।
এদিকে, দীর্ঘ প্রায় ২ বছর যাবত অনুপস্থিত রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ী ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোঃ রেজাউল করিম এর সাথে রংপুরের মেডিকেল মোড়ের কোয়ালিটি ডায়াগনষ্টিকের ১০৯ নং কক্ষে রোগী দেখার এক পর্যায়ে সরাসরি কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, সরকারি চাকরিতে বেতন/ভাতাদি কম। এ কারণে অফিস করতে ইচ্ছে করে না। এখানে প্রতিদিন রোগী দেখছি আয় রোজগার ভালো হচ্ছে। আপনার নামের পাশে ডাক্তার এবং আপনি রোগী দেখতে পারেন কিনা এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাইকোর্টে একটি রীট হয়েছে, সেই মোতাবেক আমি রোগী দেখছি। সরকারি চাকরিতে অনুপস্থিত এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, এগুলো বিষয়ে নিউজ না করলে হয় না। আমি কালকে আপনার সাথে দেখা করবো।
গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ আসিফ ফেরদৌস অনুপস্থিতির বিষয়ে মুটোফোনে জানান, কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রেজাউল করিমকে গত ২ বছর থেকে কয়েক দফা কৈফিয়ত তলব করা হয়। তিনি কোন নোটিশের জবাব দেননি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। সেখান থেকে মতামত আসলে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
রংপুর সিভিল সার্জন হিড়ম্বর কুমার রায় জানান, রেজাউল করিম অনুপস্থিত থেকে চেম্বার খুলে নিয়োমিত রোগী দেখার বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।