ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলায় যতসংখ্যক জার্নাল নিয়মিত প্রকাশিত হয় সেগুলোর মধ্যে ‘উদার আকাশ’ অন্যতম। এ জার্নালে মুক্তবুদ্ধি চর্চা, উদার মানবিকতার প্রসঙ্গ, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন, বাঙালির বাঙালিত্ব রক্ষা, বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম এবং বাঙালিয়ানার চিত্র অটুট রাখার ব্রত নিয়ে এটির পথচলা। বিশেষত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখার নিমিত্তে উভয় বাংলার সেতুবন্ধন হিসেবে লেখক পরিবার ও লোকসমাজে জার্নালটি সমাজ-সংস্কৃতির নৈতিক আনুকূল্যে সমাদৃত। জনসমাজে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির আবেদন বজায় রাখা ও সাম্যমৈত্রীর অভেদ চিত্র তুলে ধরার ব্রত নিয়ে সম্পাদক ফারুক আহমেদ এখন ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সরকারি ও অন্যান্য কোনও সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই প্রায় তিনদশক ধরে দেশ-বিদেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও তরুণ প্রজন্মের লেখকবৃন্দের মানসম্মত লেখা সম্পাদনা করে আসছেন। তাই প্রকাশনা শিল্পের জগতে ‘উদার আকাশ’ এখন সংস্কৃতি চর্চার এক অন্যতম উৎস-ভূমি। উভয় বাংলার জনপ্রিয় লেখক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজচিন্তক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসবিদ, কথাসাহিত্যিক, গল্পকারসহ প্রভৃতি মননশীল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তির লেখা জার্নালটিতে প্রকাশিত হয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও অনুশীলনের মুখপত্র সদৃশ জার্নালের প্রকাশক ও সম্পাদক ফারুক আহমেদ মানুষের মত-অভিমত প্রকাশের নিমিত্তে নিরলভাবে মনন ও মেধার অনুশীলন অব্যাহত রেখেছেন। এরই নিদর্শন ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা সংখ্যা ২০২৩’-এর অনন্য প্রবণতা। যা সৌন্দর্যবোধে অন্তর্হিত আনন্দের মূল্যবোধ ও অভীপ্সার রূপান্তর।
স্মর্তব্য যে, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও সমাজ— এ তিনটি বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর এসবের প্রতিফলন ঘটে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ রূপস্বরূপে। তাই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে সাহিত্য ও শিল্পে নানা ধাপের সৃষ্টি ও পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। আর এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া যায়, সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তন ও মানুষের চিন্তাচেতনার রূপান্তর। তাই শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে জানতে হলে সমাজ-সংস্কৃতির পরিবেশ জানা অত্যাবশ্যক। আর এই আবশ্যকীয় জীবনের প্রতিফলন শিল্পসাহিত্যের উপকরণে ‘উদার আকাশ’ জার্নালে শিক্ষালব্ধ আবিষ্কারে নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনায় সম্পর্কযুক্ত। সে কারণে সর্বস্তরের শিল্পী-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সমান মর্যাদায় উদার ‘আকাশ জার্নালে’ লেখা প্রকাশের সুযোগ পেয়ে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে লেখাটি হতে হয় শিল্পগুণ সমৃদ্ধ। এরই দৃষ্টান্ত মেলে ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা সংখ্যা ২০২৩’-এর সারাৎসারে।
সংখ্যাটির সূচিপত্রে স্থান পেয়েছে কবি সুবোধ সরকার ও কবি তৈমুর খান-এর গুচ্ছ কবিতার সম্মিলন। অতঃপর ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ-এর দেশকাল, সমাজ ও সময় সম্পর্কে এক অতলান্তিক জীবন অভিজ্ঞতার উন্মুক্ত ঝাঁপি প্রকাশিত হয়েছে মনোমুগ্ধকর সাক্ষাৎকার হিসেবে। জার্নালটির ‘গ্রন্থবীক্ষণ’ পর্বে বিভিন্ন গ্রন্থ নিয়ে নির্মোহ পর্যালোচনা করেছেন কতিপয় সাহিত্য সমালোচক। তাঁদের মধ্যে শোভন গুপ্তর সম্পাদিত ‘ব্রাত্য’ গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে তাঁর এই ‘গ্রন্থবীক্ষণ’ পর্বটি সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে অভিনেতা, চিত্রপরিচালক, সামাজিক সংবেদনশীল মানুষ এবং সর্বোপরি পশ্চিমবাংলার বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর জীবনকর্ম নিয়ে স্বল্পবিস্তর আলোচনার রূপ ‘ব্রাত্য’। মইনুল হাসান লিখেছেন ‘দো লোগ : গুলজারের একমাত্র উপন্যাস’ শিরোনামে। দেশভাগ ও দেশভাগ পরবর্তী মানুষের জীবনাচার ও তাদের বেঁচে থাকার আকুতি ও সংগ্রাম পর্ব মর্মস্পর্শী আবেদনে বিম্বিত হয়েছে। মীর রেজাউল করীম তাঁর পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ ও ‘বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম’ গ্রন্থ নিয়ে যথার্থভাবে স্বাধীনতা-উত্তর জীবন-সংস্কৃতির পরিমাঠামোকে অকৃত্রিম আবেদনে রূপরেখা দিয়েছেন। অনিকেত মহাপাত্র ‘দোজখনামা’ গ্রন্থ নিয়ে নির্মাণ ও বিনির্মাণে কথনশৈলীর যোজনা করেছেন।
ইসলাম চর্চা নিয়ে মহিউদ্দিন সরকার লিখেছেন হজরত ইউসুফ (আ.) এর তাকওয়া বা খোদাভীতির প্রসঙ্গ। এসকে সিরাজ আলি লিখেছেন Situation of Oldest Old Men in a Municipal Town শিরোনামে- পৌরসভায় বসবাসরত একজন বৃদ্ধ মানুষের যাপিত জীবনের কথা নিয়ে। শেখ মোঃ মাকতুবুল ইসলাম লিখেছেন অমর্ত্য সেনের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার তত্ত্বের সমস্যা নিয়ে বিশেষ নিবন্ধ। শ্রাবন্তী রায়, শুভেন্দু মণ্ডল, শান্তনু প্রধান ও সাইফুল্লা লিখেছেন কথাসাহিত্য নিয়ে জীবন দর্পণের নানা কথা। নজরুল চর্চা ও নজরুল কেন আজও প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে লিখেছেন ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, চৈতী চক্রবর্তী, জহির-উল-ইসলাম ও সুরূপা ভোল। কবি আমিনুল ইসলামের কাব্য ভাবনার প্রকরণ নিয়ে বিশেষ আলোকপাত করেছেন তিতুমীর ঋষভ। এছাড়াও নানা আঙ্গিক ও শিল্প-সংস্কৃতির বোধ নিয়ে লিখেছেন পাপিয়া ব্যানার্জি, মশিহুর রহমান, তানজিলা বিনতে নূর, মিজানুর রহমান, গোলাম রাশিদ, আমজাদ হোসেন, অমরনাথ বসু, সুধানাথ চট্টোপাধ্যায়, শেখ মইদুল ইসলাম ও ফারুক আহমেদ। আরও উল্লেখ্য যে, ‘উদার আকাশ’ আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা সংখ্যা ২০২৩’-এ গুচ্ছ কবিতা ও স্বরচিত কবিতাসহ মোট ৭২ জনের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার প্রাসঙ্গিকতায় অনুশীলনের কোনও বিকল্প নেই। তাই বলা হয় যিনি যত অনুশীলন করবেন, তিনি তত জ্ঞান আহরণে সমৃদ্ধ হবেন। অনুরূপ কথা লেখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেক ক্ষেত্রে একজন পাঠক অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করে থাকেন। তবে লেখার ক্ষেত্রে কেবল অনুশীলন করে দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একজন সাহিত্যিকের লেখনী শক্তি থাকতে হয়। লেখনী শক্তি না থাকলে কেবল কলম চালিয়ে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই দেখা যায়, লোকজীবনে অনেকেই কলম চালিয়েছেন, কিন্তু সফলতা পাননি। এক্ষেত্রে তাঁর স্বীকৃতির স্মারক জনসম্মুখে উপস্থাপিত নয়; অথবা পাঠক হৃদয়ে তা স্থান করে নিতে পারেনি। তাই লেখার ক্ষেত্রে লেখকের সৃজনশীলতার প্রসঙ্গটি অত্যাবশ্যক। একজন সৃজনশীল ও মননশীল মানুষের দক্ষতার সূচক হল তারই সৃজিত প্রকাশনা। এক্ষেত্রে তাই প্রকাশিত পত্রিকা বা জার্নালের আবেদন ও অবদান উল্লেখযোগ্য আবেদনে অপরিসীম। যাঁর যত সংখ্যক লেখা জার্নাল বা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে তাঁর পরিসর ততটা উন্মুক্ত। এমন উন্মুক্ত আবেদন প্রকাশ করার একটি শক্তিশালী মাধ্যমের নাম ‘উদার আকাশ’ জার্নাল। এটির নামকরণের মধ্য দিয়ে জ্ঞান অন্বেষার বিষয়টি উদার জীবনের মহানুভবতাকে চিহ্নিত করে। প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে পত্রিকা বা জার্নাল যিনি সম্পাদনা করেন তিনি হলেন সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অন্বেষার ধারক ও বাহক। ‘উদার আকাশ’ জার্নালের সম্পাদক বিশিষ্ট কবি ও গবেষক ফারুক আহমেদ তাঁদেরই একজন।