হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম থেকে:
কুড়িগ্রামে শিল্প ও বাণিজ্যমেলায় চলছে র্যাফেল ড্র’র নামে রমরমা জুয়া বাণিজ্য। উঠতি বয়সী যুবকেরা এবং সাধারণ মানুষ লোভে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে লটারী নামক জুয়ার খপ্পরে। শিল্প ও বাণিজ্যমেলায় নেই কোন স্থানীয় শিল্পের সমাহার। গতবাঁধা জুতা, স্যান্ডেল,কাপড়, আচাড়, খেলনা,চটপটি আর পকেট কাটার নানা কৌশল। লটারীসহ মেলার ভিতর টিকেট কাটার (যাদু,সার্কাসসহ ১২টি ইভেন্ট) নানা আইটেম থাকলেও সরকারি কোষাগারে একটাকাও রাজস্ব জমা হয়নি। অথচ মেলা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান দারিদ্র পীড়িত কুড়িগ্রাম থেকে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় কুড়িগ্রাম চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও প্রিন্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট যৌথভাবে এসব অপকর্ম করলেও যেন দেখার কেউ নেই। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি চলছে উচ্চ স্বরে মাইক বাঁজিয়ে মেলার কার্যক্রম। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় মেলার সামনের সড়কে যানবাহনের জটলা লেগেই আছে। ফলে ফুলবাড়ী, নাগেশ^রী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় যাতায়াত বিঘ্নিত হয়ে পরছে।
কুড়িগ্রাম চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন ধরলা ব্রিজের পূর্বমাথায় ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২মার্চ পর্যন্ত এই মেলা পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি মাসিক ১৫ লাখ টাকার চুক্তিতে প্রিন্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে মেলা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মেলা অনুমোদনের ৩০টি শর্তাবলীর মধ্যে অধিকাংশ শর্ত ভঙ্গ করে প্রিন্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট মেলা থেকে কোটি টাকা লুটে নেয়ার ফন্দি এটেছে। ১৪নং শর্ত ভঙ্গ করে মেলায় প্রবেশের টিকিটের উপর লটারি করা হচ্ছে। লটারির লোভনীয় পুরস্কারের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে টাকা। প্রতিদিন শহর ও গ্রামাঞ্চলে করা হচ্ছে লটারির মাইকিং। প্রতিদিনই মেলায় বিশাল প্যান্ডেল করে স্টেজে পুরস্কারের মোটর সাইকেলসহ আকর্ষনীয় পুরস্কার প্রদর্শন করা হচ্ছে। ফলে লোভে পড়ে একজন দর্শনার্থী একা মেলায় প্রবেশ করলেও টিকিট কাটছেন একাধিক।
মেলায় শাহাবুদ্দিন নামে এক দর্শনার্থী আক্ষেপ করে বলেন, বাণিজ্য মেলার গেটের দু’পাশে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশাল ছবি টাঙিয়ে মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে। দূর থেকে দেখলে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানই মনে করবে সাধারণ মানুষ। এই মেলার সাথে এমন ছবি টাঙানোতে আমরা মর্মাহত।
হাবিবুর রহমান নামে অপর একজন বলেন, আমি একজন মেলায় প্রবেশ করলেও পুরস্কারের আশায় ৪টি টিকিট কেটেছি। গৃহিনী সেলিনা জানান, মেলায় ঘুরতে এসেছি আর লটারির টিকিট কেটেছি, যদি কিছু পাই।
মেলা প্রবেশ করেই বেশ কয়েকটি টিনের বাক্স রয়েছে যেখানে নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভীড়। সবাই টিকিটের পেছনে নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লিখে নির্দিষ্ট অংশ সেই বাক্সে ফেলছেন। তাদের ভাষ্য এটি লটারির টিকিট। ভাগ্যপরীক্ষার জন্য এসেছেন এবং সে কারণে টিকিট কেটে তা বাক্সে ফেলছেন।
অন্যদিকে মেলা প্রবেশের জন্য ধরলা ব্রিজের পূর্বমাথায় সড়ক ও জনপথের রাস্তার সিসি ব্লক দিয়ে মেলা প্রবেশের সিড়ি তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তানভিরুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তৈরিকৃত সিসি ব্লক সেখানে ব্যবহারের বিষয়টি আমরা অবহিত হয়েছি। মেলা শেষে মেলা কর্তৃপক্ষ রাস্তার ঢাল তৈরি করে দেবেন মর্মে অবহিত করেছেন।
মেলায় উল্লেখযোগ্য শর্তাবলী ভঙ্গ করে রহস্যজনক কারণে মেলা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। ৯ নং শর্ত ভঙ্গ করে অনুমোদন ছাড়াই চলছে সার্কাস। ১৫ নং শর্ত ভঙ্গ করে মেলা সংলগ্ন প্রধান সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন দোকানপাট। ১৬ নং শর্ত ভঙ্গ করে প্রধান সড়কের দুইদিকে মোটর সাইকেলসহ যানবাহন রেখে জনদুর্ভোগ বাড়ানো হয়েছে। ২৭ নং শর্ত ভঙ্গ করে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সরকারি নির্দেশনা প্রতিপালন হয়নি।
২৮ নং শর্তে প্রতিদিন রাত ৮টার মধ্যে মেলা শেষ করার কথা থাকলেও মেলা চলছে মধ্য রাত অব্দি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেলা পরিচালনাকারী প্রিন্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর চেয়ারম্যানের বাড়ি রংপুর গুপ্তপাড়ায়। কিন্তু মানুষজনের কাছে নিজেকে ক্ষমতাধর প্রমাণ করতে মেলার সর্বত্র তার ঠিকানা ব্যবহার করেছেন প্রিন্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, রংপুর পুলিশ লাইন্স, রংপুর ঠিকানা। এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব খেলা ১২টি। এরমধ্যে ওয়াটার বোট ও চড়কের টিকিট প্রতিজন ৫০টাকা এবং অন্যান্য ১০টি খেলার জন্য টিকিট প্রতিজন ৫০টাকা। শুক্র ও শনিবার অন্যান্যদিনের চেয়ে দ্বিগুণ দর্শনার্থীর সমাগম হয়। গড়ে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টি করে টিকিট বিক্রি হয়। গড়ে একটি আইটেমের ৪৫০টিকিট এর মূল্য ৩০টাকা হারে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে ১০টিতে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা প্রতিদিন আয় হয়। বাকি ২টি আইটেমে ৪৫০টিকিটের মূল্য ৫০টাকা ধরে ৪৫ হাজার টাকা আয় হয়। মোট ১২আইটেমে প্রতিদিন ১লক্ষ ৮০ হাজার টাকা আয়। এবার শুক্র শনিবার ২দিনে দ্বিগুণ লোকসমাগম হয়। সে হিসেবে ১ লাখ ৮০ হাজার দ্বিগুন ২দিনে ধরলে আরও ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। সে হিসেবে সপ্তাহে ৫দিন ১লক্ষ ৮০ হাজার টাকা করে ৯ লাখ টাকা এবং শুক্র ও শনিবার ২দিনেরসহ মোট ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা সাপ্তাহিক আয়। এই আয় গড়ে প্রতিদিন ২ লাখ ৩১হাজার টাকা। অন্যদিকে মেলা প্রাঙ্গণে অর্নামেন্টস, কোট,মেয়েদের বিভিন্ন পোষাক, খাবারের দোকানসহ মোট ৬৫টি দোকান থেকে প্রতিদিন ২/৩ হাজার টাকা যা গড়ে ১ লাখ ৬২হাজার টাকা প্রতিদিন। এরপর বেলুন বিক্রিসহ অন্যান্য হকার ১০জন থেকে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা করে কমপক্ষে ১০হাজার টাকা আয়। এর বাইরে মোটর সাইকেল গ্যারেজ ভাড়া। অন্যদিকে প্রবেশের টিকিট লটারিতে লোভনীয় পুরস্কারের আশায় প্রতিজন একাধিক কেনায় গড়ে ৭০০০ টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা প্রতিদিনের আয়। এ হিসেবে মাসিক আয় ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ থেকে স্টাবলিশমেন্ট খরচ ২০ লাখ, মেলা পরিচালনায় প্রতিদিনের ৩৫হাজার টাকা খরচ বাবদ বাদ যাবে মাত্র ১০ লাখ ৫০হাজার টাকা। চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিকে পাবে ১৫ লাখ, বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ দেওয়াসহমেলা পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের খরচ মাত্র ৫০ লাখ টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে একমাসের মেলা থেকে তার আয় হবে প্রায় সোয়া কোটি টাকা।
মেলা পরিচালনা প্রতিষ্ঠান প্রিন্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর মালিক আরিফুল ইসলাম আঙ্গুর মেলার অনিয়ম বিষয়ে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, দেশে কোথায় এতো নিয়ম মেনে সবাই চলে? এগুলো এভাবেই চলছে এভাবেই চলবে। আপনার তাতে কী? যা দেখার পৌর মেয়র দেখবেন।
কুড়িগ্রাম সদর থানার অফিসার ইনচার্জ খান মোহাম্মদ শাহরিয়ার মেলায় শর্তভঙ্গের বিষয়ে বলেন, এখন মেলার শর্তাবলী ভঙ্গের বিষয়গুলো জানলাম। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সামিউল হক নান্টু বলেন, জুয়া মানুষের একটি নৈতিক অধিকারকে নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো কুড়িগ্রামে যে শিল্প ও বাণিজ্য মেলা হচ্ছে, সেখানে র্যাফেল ড্র বা জুয়ার আসর বসছে এটা ঠিক না। র্যাফেল ড্র করলে সরকারকে ট্যাক্স দিতে হবে। অন্যথায় এটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। একটি সামাজিক অবক্ষয়। মেলা প্রাঙ্গণে টিকিটের নাম এসব চলতে পারে না।
মেলা কমিটির আহ্ববায়ক ও কুড়িগ্রাম পৌরসভার মেয়র কাজিউল ইসলাম বলেন, মেলা সুন্দরভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। নিয়ম মেনে করা হচ্ছে। সমস্যা থাকলে আসেন সামনাসামনি কথা বলি।
কুড়িগ্রাম চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল আজিজ জানান, মেলা পরিচালনায় যে সমস্ত শর্ত দেওয়া আছে তা পুরোপুরি মানা সম্ভব না। সব কাজের সব শর্ত মানলে রাস্তায় চলাচল মুশকিল হবে। রাত ৮টায় মেলা বন্ধ করলে তো মেলা হবে নাআর টিকিটের জন্য সরকারকে আলাদা রাজস্ব দিতে হয় না। প্রবেশমূল্য দিয়ে লটারি হচ্ছে তাতে সমস্যা দেখি না। আর সরকারকে প্রতিদিন ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ১০০০ টাকা করে জমা দেওয়া হয়। এরপরও জনগণ সমস্যা মনে করলে মেলা বন্ধ করে দেয়া হবে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, নীতিমালা অনুযায়ী শিল্প ও বাণিজ্য মেলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেখানে অনিয়ম যদি কোনো হয় বা সরকারের রাজস্বের কোনো ক্ষতি হয়, সেক্ষেত্রে আমরা যাচাইবাচাই করে দেখবো, প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেখানে জনসাধারণের বা সরকারের কোনো ক্ষতি না হয় বা ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন না হয় সেব্যাপারে পদক্ষেপ নেবো।