আতাউর রহমান বিপ্লব : দীর্ঘ ১৪ বছর পর কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জমি দখল বুঝিয়ে দিলেন আদালত। আদালতের কর্মকর্তা ও পুলিশের উপস্থিতিতে ঢোল পিটিয়ে ও লাল নিশান উড়িয়ে দিয়ে জমির দখল বুঝিয়ে দেয়া হয়। আমিরুল ইসলাম গংয়ের দায়ের করা বাটোয়ারা মামলা দায়েরের ১৪ বছর পর ডিক্রি পাওয়া প্রায় ১১ বিঘা (৩.৬৮ একর) জমি প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ফেরত পেলেন আমিরুল ইসলামসহ তার পরিবারের সদস্যরা।
বুধবার (১৮ মার্চ) পঞ্চগড় জেলা জজ আদালতের নাজির তমিজ উদ্দিনসহ পুলিশ ওই জমিতে গিয়ে ঢোল পিটিয়ে লাল পতাকা তুলে দিয়ে মামলার বাদি আমিরুল ইসলামকে জমিটি বুঝিয়ে দেন।
এসময় জনপ্রতিনধিসহ স্থানীয় লোকজন উপস্থিত ছিলেন। তবে জমি দখলে রাখা কোন ব্যক্তিই সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
মোহাম্মদ আলী, ভাই আব্দুল জব্বার, বাবুল হোসেন, ফারুকসহ পরিবারের সদস্যদের ভোগদখলে থাকা ব্যক্তিরা কুড়িগ্রামের সদ্য প্রত্যাহারকৃত জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের বাবা, চাচা, ভাইসহ স্বজন হওয়ায় এতোদিন তাদের দাপটে জমিতে জেতে পারেননি বলে অভিযোগ জমি ফেরত পাওয়া আমিরুল ইসলামের। তারা জাল দলিল করে জমিটি ভোগদখল করে আসছিল।
দীর্ঘদিন ধরে চলা মামলার পর নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে আদালতের নির্দেশেই এই জমি মালিককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা জজ আদালতের নাজির মো. তমিজ উদ্দীন।
মামলা সুত্রে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসএ রেকর্ডীয় মালিক রমজানী ওরফে রমজাদী বিবি এর ছেলে বুধারু মোহাম্মদ মারা যাওয়ার পর ওয়ারিশ সূত্রে তার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে (ছেলে আমিরুল ইসলামসহ) উক্ত জমির মালিক হন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তাদের একই খতিয়ানের অংশীদার ইশার উদ্দিন ও তাঁর ওয়ারিশরাসহ স্থানীয় মোহাম্মদ আলী (ডিসি সুলতানার বাবা) ও তাঁর ওয়ারিশরা প্রায় ১১ বিঘা জমি জোরপূর্বক ভোগদখল করছিলেন। আমিরুল গং দলিলমূলে উক্ত জমির মালিক হওয়ায় ভোগদখল থাকাকালীন ইশার উদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী গং জাল দলিল দেখিয়ে কুড়িগ্রামের সদ্য সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের পরিচয় দিয়ে বাদীগণের উপর মামলা দিয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ৩.৬৮ একর জমি জোর পূর্বক দখলে নেন। আমিরুল গং এই জমি দখলে নিতে গেলে বিবাদীগণ বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে মামলা দিয়ে তাদের জমি থেকে তাড়িয়ে দেন। আমিরুল ইসলামসহ তার ওয়ারিশরা উপায়ান্তর না পেয়ে ২০০৬ সালে পঞ্চগড় সহকারি জজ আদালতে একটি বাটোয়ারা মামলা করেন। পরে ২০১০ সালে বাদি আমিরুল ও তার ওয়ারিশরা তাদের পক্ষে মামলাটির রায় পান। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ইশার উদ্দিন ও মোহাম্মদ আলীসহ তার ওয়ারিশরা জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। সেখানে তাদের আপিলটি খারিজ হয়ে গেলে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সেখানেও আপিলটি খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে চলতি বছরের ১২ মার্চ আবারও মামলাটি পঞ্চগড় জেলা জজ আদালতের তেঁতুলিয়া সহকারি জজ আদালত সর্বশেষ রায় চুড়ান্ত করে বাদিকে তার জমি বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ী বুধবার আদালতের লোকজন পুলিশের উপস্থিতে জমিতে লাল পতাকা তুলে ঢোল পিটিয়ে আমিরুল ইসলাম ও তার ওয়ারিশদের জমিটি বুঝিয়ে দেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাফিজাবাদ মৌজার জে-এল নং-১৯ এসএ খতিয়ান নং ৮৭ এর দাগ নং এসএ ২৬৯,২৭১,৩৬২,৩১৫ যার মোট জমির পরিমাণ ৯.৮০ একর জমির মধ্যে ৪ দাগে ৩.২৭ একর জমি এবং একই মৌজার এসএ খতিয়ান নং ৮৬ যার এসএ দাগ নং ৩২৭,৩৩০ এ ২ দাগে মোট জমির পরিমাণ ১.২৩ একর দেওয়ানি কার্যবিধ আইনের ২১ অর্ডার ৩৫ রুল অনুযায়ী বাদীকে ২ খতিয়ানে ৬ দাগে সর্বমোট ৩.৬৮ একর জমি বিজ্ঞ সহকারী জজ আদালত তেঁতুলিয়া দলিলমূলে আমিরুল ইসলাম গংকে দখলের আদেশ দেন।
জমি ফেরত পাওয়া আমিরুল ইসলাম জানান, রমজানী ওরফে রমজাদী বিবি আমার দাদী। দাদীর সম্পতির সুত্রে আমরা এই জমির মালিক। কিন্তু দখলিকারিরা প্রভাবশালী হওয়ায় এবং তাদের বংশে ডিসি এসপি থাকায় বার বার রায় পেয়েও আমরা জমিতে যেতে পারছিলাম না। তারা আমাদের নামে অনেক মিথ্যা মামলা দিয়েছে। ২০১৫ সালে একবার বিবাদি পক্ষরা আমাকে দুই বিঘা জমি আর দুই লাখ টাকা দিয়ে আপোসের প্রস্তাব দিয়েছিল। আপোষ মেনে না নিলে আমার অসুবিধা হবে বলে আমাকে হুমকি দিয়েছিল। এখন আদালতের মাধ্যমে জমি পেয়ে আমি খুশি।
তিনি আরও জানান, আমার দুই ভাই ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। তাদের জমি বুঝিয়ে না দিয়ে তারা জোরপূর্বক প্রভাব খাটিয়ে জমিগুলো দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখলে রেখেছেন।
এদিকে বেশিরভাগ জমি দখলে থাকা মোহাম্মদ আলীর ছেলে বাবুল হোসেন ও ফারুক হোসেন (কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের ভাই) জানান, আমার বাবা ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালে এই জমি ক্রয় করেন। সেই সুত্রে আমরা মালিক। এখানে প্রায় ৭ বিঘা আমাদের দখলে এবং এক বিঘার মত আমার চাচার দখলে আছে। এছাড়া অন্যান্য লোকজনের কাছেও আছে। মামলা চলাকালে আমাদের কিছু কাগজ পাওয়া যায়নি। এখন ওই খতিয়ানের অন্য অংশীরাও (বাদ পড়া অংশীরা) আবারও বাটোয়ারা মামলা করবেন বলে জানান।
পঞ্চগড় জেলা দায়রা জজ আদালতের নাজির মো. তমিজ উদ্দিন জানান, গত ১২ মার্চ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তেঁতুলিয়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের বিচারক লিটন চন্দ্র রায় রেকর্ড মূলে বাদী আমিরুল ইসলামের অনুকূলে রায় প্রদান করে। সেই রায় অনুযায়ী আদালতের নির্দেশে আমরা বুধবার ( ১৮ মার্চ) দলিলাদি ও প্রমানের ভিত্তিতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জমির প্রকৃত মালিকগণকে জমি বুঝিয়ে দিয়েছি।