লেখক -রাধা রানী বিশ্বাস
+++++++++++++++++

অভিমান রায় শার্ট-প্যান্ট পড়ে তৈরি হচ্ছেন বাইরে যাবেন বলে। আয়নার সামনে রাখা চিরুনী দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে নিলেন। টাকার ব্যাগ পেন্টের পকেটে নিতে নিতে বললেন,” গাড়ির চাবি কোথায়?”
বলে নিজেই আবার গাড়ির চাবি খুঁজতে লাগলো ড্রয়ের টেনে টেনে । আর স্ত্রীকে বললেন,”কাকা কেমন আছেন?
অলংকারকে বলো রাতে এসে টাকা দিব। ” ইতিকা দেবী কোনো জবাব দিলেন না। খাটের এক কোনায় বসে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে নখ কাটছে।
অভিমান শুধু তাকিয়ে দেখে বের হয়ে গেল। সেও কোন কথা বলেনি। সে জানে বলে কোন লাভ হবে না। বিয়ের পর থেকে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে । স্ত্রীর এই ব্যবহারের জন্য লজ্জায় সে সহসা বিশ্বমহিম এর সামনে আসে না।
যা বলার বুলবুলিকে বলে চলে যায়।

বুলবুলি এখন এই সংসারের যোগাযোগ করার মাধ্যম হয়ে গেছে । অলংকার এসে বলে, “বুলবুলি মাকে বলিস আজ বাসায় খাব না। ”
তার মা এসে বলে,” তোর কাকা আসলে বলিস, আমি আজ মায়ের বাসায় যাব। রাতে ফিরব না। ”
অভিমান বের হওয়ার সময় বলে,”তোর কাকিমাকে বলিস
ডান পাশের ড্রয়ারে টাকা রেখে গেছি । ”
এমন ভাবে বলে যেন তার স্ত্রী সব শুনতে পায়।

বুলবুলি বিরক্ত হয়ে একা একা বকবক করতে থাকে,” আমি এই বাসার খবরের কাগজ । আমার কাছে সবার খবর। বাড়ির মানুষ গুলো দিন দিন আধা পাগল হয়ে যাচ্ছে ! আমার দুখানা হাত। একটু সময় বিরাম নাই । একটার পর একটা কাজ। তার উপর মাথাটা ভরে যাচ্ছে তাদের খবর সাজিয়ে রাখতে রাখতে। মরণ……।”

বিশ্বমহিম আগের মত চলতে পারে না । বারান্দায় আসতে হয় বুলবুলির সাহায্য নিয়ে । এই কারণে প্রতিদিন বারান্দায় বসেন না।
বিশ্বমহিম চুপ করে শুয়ে আছেন । ঘুম আসছে না। বুলবুলি ঝাড়ু দিতে গেলে মহিমবাবু বললেন, ” আজ আমাকে একটু বারান্দায় নিয়ে যাবি? ”
বুলবুলি মায়া ভরা কন্ঠে বলল,”দাদু তুমি অমন করে বলছ কেন? আমি বারান্দাটা ঝাড়ু দিয়েই তোমাকে নিয়ে যাব। ”

আজকাল বুলবুলি দাদুকে টেনে তুলতে কষ্ট হয়। বিশ্বমহিম এখন আর আগের মত ভর দিয়ে উঠতে পারেন না ।
চেয়ারটা ঠিক করে রেখে এসে, অনেক কষ্টে দাদুকে টেনে তুলল বুলবুলি । চাদর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় নিয়ে বসাল। ভিজে তোয়ালে দিয়ে পা ভালো করে মুছে, তেল মালিশ করে দিল বুলবুলি ।

বড় গাছটার দিকে তাকিয়ে আছেন বিশ্বমহিম । এখন আর স্পষ্ট দেখতে পায় না। চশমা খুলে মুছে নিলেন । হাত দিয়ে চোখ দুটো কচলে নিলেন। তবুও আবছা দেখেন।
একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পা দুটোর দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছোট বেলায় মা তেল নিতে না চাইলে তাকে একটা থাপ্পড় দিতেন । তারপর জোর করে তেল মালিশ করে দিতেন। বিশেষ করে শীতের রাতে ঘুমানোর আগে । এই কাজটা করতেন তার মা।

মনে করে বিশ্বমহিম এর চাপা কষ্টটা বুকের ভিতর কেমন চিন চিন করে ব্যাথা করছে। সমস্ত ঘটনা উত্তাল ঢেউ এর উপর কচুরিপানা যেমন করে ভাসে, তেমন করে চোখের সামনে ভাসতে লাগলো ।

গহনাকে সহ চোখ বেঁধে যেদিন নিয়ে যায়,সেদিন তার মা নাকি চিৎকার করে কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন, “বিশ্ব…… বিশ্ব….! তুই কোথায় বাবা! আর বোধ হয় তোর সাথে দেখা হবে না। ”
গহনা…গহনা…বলেও চিৎকার করেন। তখন বন্দুকের বাট দিয়ে তার মায়ের মাথায় মিলিটারিরা আঘাত করে। মা সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন । আর উঠে দাঁড়ায়নি,চিরকালের জন্য বিদায় নেন।

গহনা পিছনে ফিরে গগনবিদারী চিৎকার করে ডাকে,
” মা….মা….! আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও মা। ”
অনেক প্রতিবেশী দেখেছে এই দৃশ্য । কিন্তু কিছুই করতে পারে নাই । নিরবে চোখের জল মুছছে তারাও। বিশ্বমহিমের দাদা বৌদিকে দরজা খুলতে দেরি করার অপরাধে সাথে সাথে গুলি
করে । তারা মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। অভিমান ভয়ে খাটের তলায় লুকায়। বাবা মায়ের তাজা রক্ত গড়িয়ে খাটের নিচে চলে যায় আর কেঁদে উঠে শিশু অভিমান।
ততক্ষণে মিলিটারি গহনাকে ধরে নিয়ে চলে গেছে । যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে,বিশ্বমহিম উদ্ধার করেন অভিমানকে। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে । সব হারিয়ে অভিমান মৌন হয়ে গিয়েছিল। কাকাকে দেখে চিনতে পেরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে আর সাথে সাথে বিশ্বমহিম এর কোলে জাপিয়ে পড়ে।

শত্রু পক্ষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তরণী বসু আর বিশ্বমহিমের যুদ্ধে যাওয়ার খবর। ঝুমকা আর গহনা তাদের তাদের সাহায্যকারী।
বিশ্বমহিম পরে জানতে পেরেছে গহনা আর ঝুমকাকে ধরে নিয়ে তারা পাশবিক অত্যাচার করেছিল।

মিলিটারিদের ঘাঁটির কাছে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে রেখে তাদের অত্যাচার করেছে দীর্ঘ দিন । তার অদূরে একটা ডোবায় বিবস্ত্র লাশ নাকি পাওয়া গিয়েছিল । ধারণা করা হয় সেই লাশ গহনার । ঝুমকা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গলায় শাড়ি পেচিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।

কথা গুলো মনে করে বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বিশ্বমহিম । তার কান্না শুনে বুলবুলি দৌঁড়ে এসে পায়ের কাছে বসে হাঁটুতে হাত রাখলো । বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে আজ বিশ্বমহিম বাবুর ।

বুলবুলি কাতর সুরে বলল,” দাদু তোমার কি হয়েছে! আমার কথায় কোন কষ্ট পেয়েছ? ”
বিশ্বমহিম আজ যেন কান্নাটা থামাতে পারছেন না। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, “আমি জীবনে কি পেলাম রে বুলবুলি!
কষ্ট ছাড়া কি পেলাম? ”

এবার বুলবুলিও কাঁদতে শুরু করল,”দাদু তুমি এমন করে কান্না করলে, আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি মরে গেলে আমার কি হবে দাদু। ”

বিশ্বমহিম কাঁপা কাঁপা হাতে বুলবুলির মাথায় হাত রাখলেন । কোন কথা বললেন না ।
দুজন স্তব্ধ হয়ে বারান্দায় বসে রইলেন । উঁচু গাছের উপরে
নীল আকাশে দুটো চিল চি…..চি…করে ডাকছে আর গোল করে ঘুরছে।
বিশ্বমহিম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ঐ দিকে। বুলবুলি পায়ের কাছে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে । তারও ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে। কিন্তু দাদুর মনের দিকে তাকিয়ে পারল না।
চোখ বেয়ে কষ্টের দরিয়ার উত্তাল ঢেউ উপচে পড়ছে।
(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *