মোঃ মনির হোসেন ঝালকাঠি :
‘‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদেরকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হচ্ছে। দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে। তবে হতাশা জনক এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র সরকারী কর্মকর্তা নয়, বেসরকারী পর্যায়ের সকল ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে একত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে, নিজ পরিবারকে দিয়ে শুরু করতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান।’’ বৃহঃবার (০৯ ডিসেম্বর ) সকাল সাড়ে ১০টায় আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২১ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন, টিআইবি’র সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও দুদক’র দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) যৌথ আয়োজনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় উক্ত সভা।
টিআইবি’র এরিয়া কোঅর্ডিনেটর মিজানুর রহমানের সঞ্চালনায় ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন সনাক ঝালকাঠির সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন হিমু, দুপ্রক’র সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার, ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের সভাপতি চিত্তরঞ্জন দত্ত, জেলা তথ্য কর্মকর্তা মো. আহসান কবীর, ঝালকাঠি টিটিসি’র অধ্যক্ষ আবুল বাসার আল মামুন প্রমুখ।
এর আগে ঝালকাঠি জেলা প্রসাশকের কার্যালয়ের সামনে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কার্যালয়ের সামনের সড়কে মানববন্ধন করেন অংশগ্রহণকারীগণ।
আলোচনা সভায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামাল হোসেন বলেন, একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মানে সু-নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতার পরিবর্তন না হলে দুর্নীতির পরিবর্তন হবেনা। আমাদের মটো হওয়া উচিত, শুধু শিক্ষিত নয় আমরা মানুষ হবো। সরকারী কর্মকর্তার পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ের সকল শ্রেনী পেশার মানুষকে যার যার স্থান থেকে একত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এখানে আমরা যারা উপস্থিত হয়েছি সকলেই যদি দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করি, মন থেকে প্রতিজ্ঞা করি যে, আমরা দুর্নীতি করবো না এবং আমাদের পরিবারের সদস্যসহ সকলকে নিয়ে মনে প্রানে তা ধারণ করবো, তাহলেই সত্যিকার অর্থে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হবে।
সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে দুপ্রক’র সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, সকল অনিয়ম-দুর্নীতির মূল হচ্ছে মিথ্যা। সুতরাং মিথ্যার আশ্রয় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে হবে। যে ধর্মেরই লোক হই না কেন, নিজ নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। সম্মিলিতভাবে সকলকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে।
দুর্নীতিবিরোধী শ্লোগান ও মতামত তুলে ধরার পাশাপাশি দিবসটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব সম্বলিত ধারণাপত্রে উল্লেখিত টিআইবি’র দাবীসমূহ সভায় তুলে ধরেন সনাক ঝালকাঠির সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন হিমু। সভায় উপস্থাপন করা দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য টিআইবি’র প্রস্তাবকৃত সুপারিশসমূহ:
১. সকল স্তরে স্বচ্ছ, কার্যকর ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অভীষ্ট অর্জনে সকল অভীষ্টের কার্যকর বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে অভীষ্ট-১৬ এর ওপর সর্বাধিক প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে এবং এ লক্ষে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে;
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না” এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে;
৩. দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনসমূহ যাতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
৪. প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনতে স্বচ্ছতায় অগ্রাধিকার, দুর্নীতিবিরোধী কৌশল অবলম্বন, প্রশিক্ষণ, নজরদারি ও কার্যকর জবাবদিহির মতো প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে;
৫. সকল নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ এর নিবর্তনমূলক ধারাসমূহ বাতিল করতে হবে;
৬. সেবাখাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় ও সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং উপাত্তভিত্তিক মনিটরিং জোরদার নিশ্চিত করতে হবে;
৭. সরকারি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ এর বিতর্কিত ধারাসমূহ বাতিল করতে হবে। এছাড়া, শিক্ষাখাত ও বিভিন্ন চাকুরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি ও দুর্নীতি রোধে কার্যকর উদ্যোগের পাশাপাশি পূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করতে হবে;
৮. ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা বৈধ করার দুর্নীতিসহায়ক, বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক সুযোগ না দিয়ে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ বন্ধ করতে হবে;
৯. বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় পেশাদারি উৎকর্ষ ও কার্যকরতা বৃদ্ধির লক্ষে একটি সমন্বিত ও পরিপূরক কৌশল গ্রহণ করতে হবে; এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;
১০. তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯Ñ এর কার্যকর প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে তথ্যের আবেদনকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; এবং
১১. দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদককে শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির ওপর সকল প্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সরকারি এবং রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে দুদকে নেতৃত্ব পর্যায়ে অকুতোভয় সৎসাহস, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে এর ওপর অর্পিত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে দৃষ্টান্তমূলক কার্যকরতা নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার নেলী রুদ্র, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম, সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আজাহার আলী, দুপ্রক সদস্য কাজী শফিকুল ইসলাম, ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়কারি মো. মোতাহার হোসেন, টিএমএমএসএস’র ম্যানেজার মো. ছেকেন আলী, পৌরসভার কাউন্সিলর সাবিনা ইয়াসমিনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ, সনাক ও দুপ্রক সদস্যবৃন্দ, ইয়েস সদস্যবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।