কলমে -রাধা রানী বিশ্বাস

——————————————————————–
রাতিনপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বালুনদী।
একদিকে গ্রাম অন্যদিকে প্রবহমান নদী। রাতে চাঁদের আলোয় চিকচিক করে নদীর ঢেউ গুলো। দূর থেকে রাতে মাছ ধরায় মত্ত জেলেদের কথোপকথন ভেসে আসে কানে।
ঢেউ গুলো তীরে আছড়ে পরে আর ছলাৎছলাৎ
শব্দ করে।
পিঞ্জরদের বাড়িটা তাদের পাড়া থেকে একটু দূরে। বাড়ির চারধারে বড় বড় তাল গাছে ।
উঠোনের অদূরে আম -কাঁঠাল গাছ। অন্য পাশে
খোলা মাঠ। অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা তাদের বাড়িটা।

পিঞ্জর ছোটবেলা থেকে একটু ডানপিটে। তবে পড়ালেখায় মেধাবী। কিন্তু পড়ালেখা করতে চায়না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বন্ধুদের নিয়ে খেলা আর দুষ্টুমি চলে তার সন্ধ্যা অবধি। মুঠোয় করে মাটির কলসি ভাঙা চারা নিয়ে, নদীর তীরে বসে বন্ধুদের নিয়ে।
জলে ঢিল ছুড়ে আর চারা ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে তলিয়ে যায়। তলিয়ে গেলে সবাই হাততালি দেয়।
যার ঢিল কম দূরে যাবে। সে সবার কিল খাবে।
এটা চারা ঢিল খেলার আগে বাজি ধরা থাকে।

তবে পিঞ্জর কখনো কিল খায় না কিল দেয়।
গাছের মগ ডালে উঠে পাখির বাসা থেকে বাচ্চা
নামিয়ে দেখায় বন্ধুদের। এই জন্য বন্ধুরা তাকে খুব ভালোবাসে। আর তার সব কথা শুনে। পুকুরে নেমে পানিফল তুলে বন্ধুদের নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে বসে খায়।
ছোট বেলায় বাবা মারা গেছে। বাবাকে তার মনে নেই। মায়ের মুখে বাবার গল্প শুনে কল্পনায় বাবার ছবি আঁকে।
বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। এলাকায় ভালো মানুষ হিসাবে নাম ডাক আছে তার বাবার । পিঞ্জর তার বাবার মত পরোপকারী।

পিঞ্জরের মা তার আত্মার মত। বাবার মৃত্যুর পর
তার মাকে সে সব সময় পেয়েছে। বাবার অভাব কখনো বুঝতে দেয়নি তার মা। টিনের চৌচালা
ঘরের পাটাতনে তাদের ধানের গোলা। আর নীচে
থাকেন মা ছেলে। বিছানার এক পাশে পড়ার টেবিল। পিঞ্জর যতক্ষণ পড়ে তার মা জেগে থাকে। মা ঘুমিয়ে গেলে সেও ঘুমিয়ে যায়। এজন্য প্রায়ই মায়ের বকুনি খায়।

মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে,ঢাকায় কৃষি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হল পিঞ্জর ।
গ্রাম থেকে শহরে এসে প্রথম প্রথম, শহুরে বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক অবজ্ঞা পেয়েছে।
পিঞ্জর খুব বুদ্ধিমান ছেলে। সে কিছু বলত না।

একদিন খুব ইনসাল্ট করলো বন্ধুরা। ওর হাতে
ফেটে যাওয়া বাটন মোবাইল ফোন দেখে। খুব কষ্ট পেয়েছে ও । আবার রাগও হয়েছে বন্ধুদের আচরণে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল,” তোদের প্রতিশোধ নিব, ভালো রেজাল্ট করে। ”
আস্তে আস্তে শহুরে হাবভাব বুঝে গেল পিঞ্জর।

মাকে খুব মিস করে। রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের সাথে কথা বলে। মোবাইল নিয়ে বন্ধুদের অপমানের কথা মাকে জানায়। মা হাসি মুখে ছেলেকে আশ্বস্থ করেন। তার বাবার পেনশনের টাকা তুলে আগামী মাসে বিকাশ করবে বলে। যেই কথা সেই কাজ। মায়ের পাঠানো টাকা তুলে টাচ্ মোবাইল কিনে খুব খুশি পিঞ্জর। এখন ভিডিও কলে মাকে দেখতে পায়। তার মাও শান্তি পায় পিঞ্জরকে দেখে। মা দূরে থাকলেও এখন মাকে খুব কাছে মনে হয়। যখন মন চায় দেখতে পারে।

বন্ধুদের প্রতিশোধ নিতে পিঞ্জর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করে। মায়ের কথা যখন মনে পড়ে তার। তখন আরও সিরিয়াস হয়ে যায়।কারণ
মা তাকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে, প্রতিবেশীরা তার মাকে অনেক অপমান করেছে। তার মা কান্না করে বলত, “বাবা তুই পড়াশোনা করে অনেক বড় হবি।” তখন আমার আর এই কষ্ট থাকবে না। ”

স্যার ক্লাশে প্রশ্ন করলে পিঞ্জর এখন সারা দেয়।
আস্তে আস্তে সকল স্যারদের নজরে এল পিঞ্জর।
যখন স্যাররা প্রশ্ন করেন,বন্ধু গুলো কেমন বেলুনের মত চুপসে যায়। পিঞ্জর সাবলীল ভাষায়
খুব সুন্দর করে উত্তর দেয়। শিক্ষকরা খুব খুশি হন।

পিঞ্জর এখন শুধু বন্ধু নয়,বান্ধবীদেরও ক্রাশ রীতিমতো। বড় লোকের আদুরে দুলালরা এখন তার কাছে ভিড়ে নোট বই নিতে। সেও দিয়ে দেয়।এটা তার মায়ের শিক্ষা।
পিঞ্জর ফর্সা না হলেও কাল নয়। শহরে এসে তার গায়ের রং কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছে। লম্বা সুঠাম দেহ, কোঁকড়া চুল, হাসি দিলে সাদা দাঁতগুলো খুব সুন্দর লাগে।

তিতির মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। প্রতিদিন রিক্সায় এসে ইউনিভার্সিটির বিশাল বড় গাছটার নিচে নামে। পিঞ্জর ক্লাস দেরি তাই গাছে হেলান দিয়ে, এক পা পিছনে গাছের গোড়ায় ভর দিয়ে দাড়িয়ে নোট গুলো দেখছে।
তিতিরের লম্বা ওড়নার এক আঁচল রাস্তায় গড়িয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে পিঞ্জর তিতিরকে বলবে কিনা বুঝতে পারছে না। হাতে নোট খোলা সে তিতির এর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিতির খেয়াল করেনি। পিঞ্জর বলবে কি বলবে না, এটা ভাবতে ভাবতে তিতির চলে গেছে।

তিতির এর এই বেখায়লিপনা পিঞ্জর এর মনে গেথে রইল। সারাদিন থেকে থেকে তিতির কে মনে পড়ছে। কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করছে।
পিঞ্জর রাতে পড়তে বসলে একই দৃশ্য মনে আসে বারবার। হঠাৎ তার মোবাইলে এলাম বেজে উঠলো। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ধুত্তরি কি সব ভাবছি কত পড়া আছে। বলে খেতে চলে গেল পিঞ্জর।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *