কলমে -রাধা রানী বিশ্বাস
তিতিরের বাবা যতীন বসু চাকুরিজীবি,মা গৃহিণী । যতীন বসুর ছোটবেলা কাটে গ্রামে । পড়াশুনার জন্য ঢাকা আসেন তিনি । পরে চাকুরী নিয়ে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন । তিতির এর জন্ম হয় ঢাকায় ।
তিতির এর মা লালুর আত্মীয় । লালুর নানান অপকর্মের জন্য যতীন বসু যোগাযোগ কম করেন । যতীন বসু লোক হিসাবে সাদাসিধে এবং ভদ্র ।
পিঞ্জর দুইদিন মায়ের সাথে বেশ ভালোই কাটাল ।অনেক দিন পর দুঃখ আর হাসির গল্প করতে করতে মায়ের সাথে রাতের খাবার খেল । মা তার পছন্দের খাবার গুলো রান্না করেছেন বেছে বেছে।ছেলের পাশে বসে চামচ দিয়ে বড় মাছের টুকরো তুলে দেন পাতে । যতক্ষণ পর্যন্ত পিঞ্জর মায়ের হাত না ধরতো বাম হাতে, ততক্ষণ মা আর থামতেন না । দুধের সর দিয়ে ঘি তুলে রেখেছেন সুমতি দেবী । পিঞ্জর গরম ভাতে ঘি খেতে পছন্দ করে। তাই
পিঞ্জর ফিরে যাওয়ার দিন ছোট ছোট প্লাস্টিকের পাত্রে শুকনো খাবার দিয়ে দিল । ঘিয়ের পাত্রটাও বাদ গেল না । পিঞ্জর কে এগিয়ে দিতে এসে সুমতি দেবী বাড়ির পিছনে আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল । পিঞ্জর সরু রাস্তা ধরে যেতে যেতে গাছের আড়ালে মিলিয়ে গেল যখন, এরপরেও সুমতি দেবী দাঁড়িয়ে রইল । চোখের থেকে নাকের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল । আঁচলে মুছে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে ।
ক্লাসে এক সাথে বসে এখন তিতির আর পিঞ্জর ।নোট আদান প্রদান করে, একজন আরেক জনকে পড়ালেখার বিষয়ে সাহায্য করে, একসাথে বসে আড্ডা দেয় তারা। হাসি আনন্দের গল্প করে তিতির আর পিঞ্জরের দিন ভালোই কাটছে।
এখন আর সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্ব আর ভালোলাগার জায়গায় নেই । তার উর্ধ্বে আরও গভীর সূক্ষ্ম অনুভূতিতে পরিণত হয়েছে । আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে পিঞ্জর জানতে পারল, লালু মাতবর তিতিরদের আত্নীয় । পিঞ্জরের মাথায় যেন বাজ পড়ল । কারণ তার মা একথা শুনলে কিছুতেই মেনে নিবেন না তাদের এই সম্পর্ক। অথচ দুজন মিলে কত পরিকল্পনা করে রেখেছে । পাশ করে দুজন গ্রামে ফিরে যাবে । পিঞ্জরদের বেশ কিছু জমি পতিত পড়ে রয়েছে। যেগুলে সারাবছর জলের নিচে থাকে । সেই জমিতে মাছের খামার গড়ে তুলবে । উঁচু জমিতে ফসল বুনবে । তাতে মা আর তিতিরকে নিয়ে একসাথে সুখেই থাকতে পারবে পিঞ্জর । তিতিরও তাকে সহযোগিতা করতে পারবে । তাহলে মাও খুশি হবে । পিঞ্জর গ্রামের কিছু বন্ধুদের সাথে কথা বলেছে । তারা রাজি আছে তার সাথে কাজ করতে ।
যথারীতি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল । তিতির বাসায় পিঞ্জর এর কথা জানাল তার মা বাবাকে । যতীন বসু ছোট বেলা থেকে তিতিরকে প্রচন্ড ভালোবাসেন । মেয়ের ইচ্ছাকে তিনি প্রাধান্য দেন সব সময় । বাঁধ সাধলো তিতির এর মা । তার বড়লোক বান্ধবীর ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিবেন বলে কথা দিয়ে রেখেছেন, স্বামীর অনুমতি ছাড়া । মেয়েকেও কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না ।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এই বিষয় নিয়ে তুলুম কথা কাটাকাটি হল । কিছু সময় পর যতীন বসু থেমে গেলেন । কিন্তু তিতির এর মা একা একা বকবক করতে লাগলেন । কিছুতেই পিঞ্জর এর সাথে বিয়ে দিবেন না । কাজ করছেন আর জিনিস আছড়ে শব্দ করছেন । তিতির এর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন , “গ্রামের ছেলে, ভালো ঘর নেই, বাবা নেই। শুধু গোলা ভরা ধান থাকলে হবে ? মেয়ে আমার শহরে বড় হয়েছে । “
যতীন বসু কোন কথা বলছেন না । মাথা নিচু করে
চোখের সামনে পেপার খুলে মুখ আড়াল করে পেপার পড়ছেন । এক সময় তিতির এর মাও চুপ হয়ে গেল ।
ঝগড়ার ঘন্টা খানেক পর তিতির পিঞ্জরকে নিয়ে বাসায় ঢুকল । তিতির জানে তার মা পিঞ্জর এর সাথে ভালো ব্যবহার করবেন না । তাই বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে বিদায় দিল পিঞ্জরকে। যতীন বাবু পিঞ্জর এর সাথে কথা বলে বুঝেছেন । ছেলেটা ভদ্র এবং মেধাবী । সে গ্রামে গিয়ে মাছের খামার আর ফসল উৎপাদন করে উন্নতি করতে পারবে । তাছাড়া পড়াশোনা করেছে এই বিষয় নিয়ে । তিতির এর মা পিঞ্জরকে দেখেও না দেখার ভান করল ।
পিঞ্জর গ্রামের বাড়ি ফিরে গেল। বাড়ি গিয়ে শুধু মন মরা হয়ে বসে থাকে । সুমতি দেবী বিষয়টি খেয়াল করে চিন্তায় পড়ে গেলেন । তার ছেলেটা এমন চুপচাপ হয়ে গেল কেন ।
বুঝতে পারছেন না ।
ভালোবেসে কাছে টেনে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে
জিজ্ঞেস করল, ” পিঞ্জর, তোর কি হয়েছে বাবা?
আমাকে বল । তুই কোনদিন আমাকে কোন কিছু লুকাসনি । আমি তোর মা । আমাকে খুলে বল।”
মায়ের কথা শুনে ছেলের চোখে জল চিকচিক করছে । পিঞ্জর মায়ের হাতটা থাবা দিয়ে ধরল ।
মায়ের কথা শুনে যেন মনের চাপা কথা গুলো প্রকাশ করার প্রয়াস খুঁজে পেল ।” মা আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি । তোমাকে না জানিয়ে লালুর এক আত্মীয়…. ।” আর বলতে পারছে না পিঞ্জর মায়ের ভয়ে । শুধু কান্না করছে । সুমতি দেবী এবার ছেলেকে জড়িয়ে ধরল । কথা আদায় করার জন্য বলল,”বাবা তুই বল আমাকে । আমি তোর মা । আমকে তোর ভয় নেই । “
মায়ের আশ্বাসে ছেলে স্বস্তি পেল । সুমতি দেবীকে সব কথা খুলে বলল । সব শুনে সুমতি দেবী হেসে বললেন, “তুই আমার একমাত্র ছেলে । তোর পছন্দই আমার পছন্দ । তুই তাদেরকে বল প্রস্তাব পাঠাতে।” পিঞ্জর বলল, ‘মা সেটা বোধ হয় হবে না । তিতির এর মা এই বিয়েতে রাজি নন ।’ এই বলে ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল ।
এবার সুমতি দেবী চিন্তায় পড়ে গেল । একে তো লালু মাতবর বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করবে । তারপর মেয়ের মা রাজি না । ছেলের বিয়ে কি ভাবে সম্ভব হবে । ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে আবছা আলোয় পেন্ডুলাম ঘরির কাটার দুলুনির দিকে চেয়ে আছেন । কাঁটাটা বিরামহীন ভাবে দুলছে । সুমতি দেবীও ভাবনার কোন কূল পাচ্ছেন না ।
এক সময় চিন্তা করতে করতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেন ।
(চলবে)…..