ভূরুঙ্গামারী(কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধিঃ ২৭-১১-১৯
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী সাব-রেজিষ্টার অফিসে টাকা দিলেই জাল দলিলের মাধ্যমে জমি লিখে নেয়া যাচ্ছে। দলিল লেখক আর সাব-রেজিষ্টার যোগসাজসে ভূয়া জমিদাতা দিয়ে রেজিষ্টার হয়ে পরিবর্তন হচ্ছে জমির মালিকানা। আর এসব কর্মকান্ড জানতেও পারছেনা জমির আসল মালিক। জমি বেদখল হবার পর ঘটনা প্রকাশ পেলেও তখন আর কিছু করার থাকে না। ফলে মামলা মোকাদ্দমায় দীর্ঘ প্রতিক্ষার দিন পার করতে হয় আদালতের দোরগড়ায়।
অভিযোগ সুত্রে জানাযায়,কাঞ্চন বিবি(৯০),স্বামী মৃত: জছিম উদ্দিন। বাড়ি ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় ইউনিয়নের বামুনেরকুটি গ্রামের বাসিন্দা। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। তিনি ৮ সন্তানের জননী। নিজের নামে ২৪ শতক জমি এবং স্বামীর দেয়া সম্পত্তির অংশ সন্তানদের নামে লিখে দেন। সম্পত্তি বন্টন হয়ে গেলেও ২০১৭ সালে মায়ের নামে ২৪ শতাংশ জমি নিজের নামেই জাল দলিল করে নেয় বড় ছেলে আব্বাস আলী(৬২)। সে শ্বাশুড়ীকে নিজের মা বানিয়ে দলিল লেখক সমিতির সম্পাদক মিজানুর রহমানের যোগসাজসে এই জাল দলিল করে নেন। একই পন্থায় ২০১৮ সালে ছোট দু’বোনের নামে ৩৯শতাংশ জমিও জাল দলিল করে নেন দলিল লেখক হারুনের সহযোগিতায়। বিষয়টি দীর্ঘদিন গোপন থাকলেও চলতি মৌসুমে ওই সব জমির আবাদ করা ধান কেটে নেয় আব্বাস আলী এবং সাথে জমিও দখল করে নেন। কিছু অংশে দুই বোনের বাড়ি থাকায় উচ্ছেদের হুমকি দেয় সে। ঘটে বাড়ি পোড়ানোর ঘটনাও। পরে জাল দলিলের বিষয়টি সবার নজরে চলে আসে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে গ্রাম আদালতের দ্বারস্ত হয় ভুক্তভোগিরা। একাধিকবার নোটিশ দিলেও আব্বাস আলী হাজির হননি গ্রাম আদালতে।
বৃদ্ধা কাঞ্চন বিবি বলেন,বাবা মুই বুড়া মানুষ। মোর ব্যাটা আব্বাস ভুয়া দলিল করি নিছে। ঐজমি মুই দু’বেটিক অনেক আগত নেখি দিছং। কেমন করি ওই দলিল করিল মুই কবার পাংনা। মোর কাছত কোনদিন টিপ নিবারও আসে নাই আব্বাস। মোর অসহায় বেটি দু’টার জমির ধান কাটি নিয়া গেছে। মোক ধাক্কে ফেলে দিছে। কাই এলা রাইতত আসি একটা ঘর পোড়া দিছে বাবা কবার পাংনা।
সোনাভান ও মনোয়ারা বেগম বলেন,বড় ভাই আব্বাস আলী কসাই আমাদের মায়ের ভোটার আইডি ঠিক রেখে তার শ্বাশুড়ির ছবি বসিয়ে মায়ের নামের ২৪শতাংশ জমি জাল দলিল করেছে। একই কায়দায় এলাকার মুরুব্বির মাধ্যমে আমাদের দু’বোনকে সরকারি ঘর পাইয়ে দেবার কথা বলে ভোটার আইডির কপিসহ ছবি নিয়ে যায়। আইডি নম্বর ঠিক রেখে ছবি নকল করে দু’বোনের ৩৯শতাংশ জমির জাল দলিল করে নেয়। তারা বলেন, স্বাক্ষী এবং মুহুরির মাধ্যমে জানতে পেরেছি এসব দলিল পার করতে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করেছে আমার ভাই। চেয়ারম্যানসহ থানায় অভিযোগ দিয়ে কোন প্রতিকার পাচ্ছি না। আমার দুটি প্রতিবন্ধি সন্তান। একটি মেয়ে কানে শোনে না কথাও বলতে পারে না এবং ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই তাকে রশি দিয়ে বাঁশের সাথে বেধে রাখি। এখন ভাইয়ের এমন অত্যাচারে আমরা কোথায় যাবো কোন কুল পাচ্ছি না। বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েও কোন লাভ হয়নি।
স্বাক্ষী প্রদানকারী মমিনুল বলেন,আব্বাস আলী আমাকে বলেন ভাই শ্বাশুড়ির আমাকে দেড় বিঘা জমি লিখে দেবে তুই একটু থাকিস স্বাক্ষী হতে হবে। সেই হিসেবে আমি স্বাক্ষী হই। কিন্তু পরে জানতে পারি তার শ্বাশুড়ির জমি নয় নিজের মায়ের জমি শ্বাশুড়িকে মা বানিয়ে পার করে নিয়েছে।
নিজের শাশুড়িকে মা বানিয়ে জাল দলিল করার কথা স্বীকার করেন আব্বাস আলী। এই জন্য সে মিজানুর মহুরিকে ২৮হাজার টাকা দিয়েছেন বলেও জানান। এছাড়াও তিনি ছোট ভাইয়ের ১০শতাংশ জমি ক্রয় করে নেবার সময় দু’বোনের সম্পত্তিও ক্রয় করে নিয়েছেন বলে জানান। তবে তার বোনরা দলিল পার করার সময় উপস্থিত ছিলেননা। কিন্ত কিভাবে দলিল পার করে দিল হারুন মহুরি সে বিষয় তিনি চুপ থাকেন। কোন উত্তর দেননি।
দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান এবং হারুন মহুরি অর্থের বিনিময়ে দলিল জালিয়াতির ঘটনার কথা অস্বীকার করেন। তারা দোষ চাপালেন জমি গ্রহিতার উপর।তারা বলেন,ভোটার আইডির কপি,ছবি এবং সাব-রেজিষ্টারের কাছে দাতাদের উপস্থিতিতে দলিল করা হয়। এখানে অনিয়ম করার কোন সুযোগ নেই। ভূরুঙ্গামারী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক মন্টু জানান,কিছু অসাধু দলিল লেখকের কারণে উপজেলায় প্রায় সময়ই এমন জাল দলিল হওয়ার ঘটনা ঘটছে। শুধু এই দুটি দলিলই নয় ২০১৭ সালে বলদিয়া ইউনিয়নের রাঙ্গালীরকুটি গ্রামের জনৈক ছমির আলীর জমি একই পন্থায় জাল দলিলে পার হয়। এতে করে এই উপজেলায় পারিবারিক কোন্দলসহ আদালতে মামলা মোকাদ্দমাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মামলা সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি অভাবি এই অঞ্চলের গরিব মানুষ গুলোও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন বলে জানান।
ভূরুঙ্গামারীর সাব-রেজিষ্ট্রার নাবীব আফতাব জাল দলিলের বিষয়ে নিজের দায় এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ১০০/১৫০ দলিল পার করতে হয় আমাকে। এগুলো যাচাই-বাছাই করার সুযোগ কম থাকে। দলিল বাতিল করার ক্ষমতা আমাদের নেই। একমাত্র আদালতের মাধ্যমে সেটি হয়। তবে জাল দলিল বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।