নুর
সাক্ষাৎকার গ্রহন ও অনুলিখনঃ নুরে আলম মুকতা
প্রিয় বন্ধু চলুন,
জীবন্ত কিংবদন্তির গল্প শুনি ।
ভিডিও তে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু লোকেশন আর যুদ্ধের বিশদ বর্ননা বোঝা কষ্টকর হবে এজন্য অনুলিখনের আশ্রয় নিতে হল। আশা করি ত্রুটি বিচ্যুতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
একদম প্রতিবেশি হওয়া সত্বেও এ যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কথা বলা হয়নি কেন আমি জানি না। আল্লাহর নিকট শুকরিয়া যে সেটি আজ সম্ভব হয়েছে ।
বিষয়টি আমার কাছে এমন হয়েছে যে গুরুর সাথে আমি একদম একমত ।
” বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (স্ফুলিঙ্গ)
জনাব মোঃ ওবায়দুল মোখতার , পিতাঃ মৃত শেখ রসুল মোহাম্মদ গ্রাম, ডাকঘর উপজেলাঃ ভোলাহাট জেলাঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জন্মঃ ০৮ জুলাই ১৯৪৭
দূরন্ত ডানপিটে একজন যুবক। বর্তমান চাঁপাই নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন তিনি । ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের রিক্রুটমেন্ট কমিটির পরীক্ষায় উপস্থিত হন। তাঁর স্বপ্ন আকাশে উড়বেন। জিডি পাইলট হবেন। চমৎকার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। কিন্তু বাঁধা হয়ে গেল ইংরেজি কথোপকথন ।
শুধু ইংরেজি বলতে না পারার কারনে তখন পূর্ব পাকিস্তানে ঐ রিক্রুটমেন্ট পরীক্ষায় প্রথম হয়েও হল না পাইলট হওয়া। রিক্রুটমেন্ট কমিটি মোখতার ভাইকে হতাশ করতে চাইল না। কিন্তু নিতেও পারছিল না।
অবশেষে ওদের সমস্ত বৈষম্যমূলক আচরণ ব্যর্থ করে পূর্ব পাকিস্তান রিক্রুটমেন্ট কমিটি বলল, তুমি এয়ারফোর্সে এয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করতে পার। একদিকে দরিদ্রতা অন্যদিকে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দুটোই বেঁচে যাবে এ মনে করে মোখতার ভাই এয়ারম্যান পদে যোগদান করে এয়ারফোর্স হিসেবে চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য। সুদর্শন মেধাবী সৈনিক একজন সফল এয়ারফোর্স হয়ে উঠলেন। তিনি সব সময় প্রতিবাদি আর নিজ অঞ্চল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি টনটনে আবেগ আক্রান্ত ছিলেন।
প্রশিক্ষণ শেষে করাচীর এয়ারফোর্স বেজে পোস্টেড হলেন।
রাজনীতি সচেতন হওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে তিনি ভালো জানতেন। চাকুরিতে গিয়ে এর প্রত্যক্ষ শিকার হলেন পদে পদে ।
একদিন এক বেলুচ সৈনিকের সাথে বাঙ্গালি এক সৈনিকের কি এক অজানা কারনে বচসা চলছিল। এ বচসা গুলোতে তখন বাঙ্গালিদের প্রচন্ড রকম হেয়
করা হত । মোখতার ভাইএর মত অন্য সৈনিকেরা দূর থেকে দেখছিলেন বেজ এর গ্রাউন্ডে বসে । হঠাৎ ঐ বেলুচ একটি বিশাল পাথর তুলে বাঙ্গালি সৈনিককে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে মোখতার ভাই মনে করেন যে , জাতিভাই নিশ্চিত মারা পড়বে। এজন্য তিনি কালবিলম্ব না করে ব্যালকনি থেকে প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে বেলুচ সৈনিকটির মাথা বরাবর ভয়ানক এক ঘুষি মারেন। তৎক্ষনাৎ বেলুচের হাত থেকে পাথর পড়ে যায়। বেলুচ সৈনিকটি এক ঘুষিতেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
দুই বাঙালি গলা জড়াজড়ি করে কাঁদে।
ঘটনা চাওর হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় কোর্ট মার্শাল।
কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতি ঘটনা ঘটে। সাক্ষ্য নেয়ার সময় হাসপাতালে ভর্তিকৃত বেলুচ তখন চোখে সঠিক দেখতে পাচ্ছিল না।
ও বলে , ম্যায় ত এক ই দো দেখতা হে ,
সামাঝ নেহি ম্যায়নে কোন মারা ?
বেঁচে যান ঐ যাত্রায় মোখতার ভাই । তাঁকে বদলি করা হয় ঢাকায়। কিন্তু হায় বিধি !
এবার পড়বি ত পড় মালির ঘাড়ে । ঢাকায় এক পাঞ্জাবি অফিসার প্রায়ই বাঙালি সৈনিকদের হেয় করে কথা বলত। পূর্ব পাকিস্তানে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে ।
মেধাবী মোখতার ভাই জানতেন যে, এ কাজ করলে চাকুরি ও জীবন দুটোই যেতে পারে। তারপরও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। একদিন ঐ পাঞ্জাবি অফিসার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেই প্রচন্ড শারিরিক আঘাত করে বসলেন ।
কেঁপে গেল এয়ারফোর্স বিভাগ । এবার ত আর সৈনিক না ! সরাসরি অফিসার !
বিচার বোর্ড সনদ দিল যে উনি উন্মাদ ,
বোর্ড বলেছিল ,
হারবার ত সাব লোগ কি ও মারতা হ্যায়,
খোদ নোকরি কি কেয়ার নেহি কিয়া !
ও পাগাল হে !
এজন্য গেট আউট । চাকুরি থেকে বহিস্কৃত হয়ে এলাকার গর্বিত সন্তান ফিরে এলেন বাড়ি কপর্দকহীন অবস্থায় ।
৭১ এর রনাঙ্গনের অনেক বীর লড়াকুদের জীবন কাহিনীগুলো এরকমই !
(এর পরের গল্প আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তস্নাত অসাধারণ গল্প , পরবর্তি পর্বের জন্য দয়া করে একটু সময় দিন)
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা
জনাব মোঃ ওবায়দুল মোখতার