ফুলবাড়ী প্রতিনিধি

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা (এমবিবিএস) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষার্থী মোহছেনা আক্তার। তবে তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চরম আর্থিক সংকট। মেয়ে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় খুশির পরিবর্তে চরম দুশ্চিন্তায় বাবা-মা।

মোহছেনা আক্তারের বাড়ী কুড়িগ্রামের সীমান্ত ঘেঁষা ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলের সমন্বয়টারী গ্রামে। মোহছেনা আক্তার অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। এরপর ২০২২ সালে গংগা হাট দ্বিমুখী দাখিল মাদ্রাসা থেকে এসএসসি জিপিএ- ৫ ও কাশিপুর ডিগ্রি মহাবিদ্যালয় থেকে ২০২৪ সালে এইচএসসি জিপিএ- ৫ পান।

মোহছেনা আক্তারের বাবা মোফাজ্জল হোসেন একজন দরিদ্র কৃষক। মা মোসলেমা বেগম গৃহিণী। তিন বোনের মধ্যে মোহছেনা সবার ছোট। মেজো বোন কুড়িগ্রাম মহিলা কলেজে অনার্সে পড়াশোনা করছে। সীমিত আয়ের এই পরিবারটি এতোদিন মেয়েদের পড়াশোনার খরচ বহন করলেও মেডিকেলে পড়াশোনার বিপুল খরচ মেটানো এখন তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাবা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমার তিন মেয়ে। মোহছেনা সবার ছোট । বড় মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে অধ্যয়নরত এবং মেজো মেয়ে মেয়ে কুড়িগ্রাম মহিলা কলেজে অনার্সে পড়াশোনা করছে। সীমিত আয়ের আমার মেয়ের পড়াশোনার খরচ বহন করতে কঠিন হয়ে পড়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ঋণের পাল্লা ভারী হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ২০ শতক আবাদি জমি ছিল। তিন মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে। এখন কোনো আবাদি জমিও নেই যে বিক্রি করে মেয়ের পড়াশুনা চালাবো। মাত্র ৮ শতক জমিতে বাড়ির চালা। কোনো রকমেই দিন পাড় করছি। আমার ছোট মেয়ে মেডিকেলে চান্স পাওয়া আমাদের জন্য বড় গর্বের। কিন্তু মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন পূরণে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। পড়াশোনার বিপুল খরচ মেটানো এখন আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। কয়েক দিন পর ভর্তি, ঘরে এক কানা-কড়িও নেই।

তিনি তার মেধাবী মেয়ের মেডিকেলে ভর্তিসহ পড়াশুনার খরচ চালানো জন্য সরকারসহ বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন।

মা মোসলেমা বেগম জানান, আমি অনেক কষ্টে তিন মেয়েকে মানুষ করেছেন। যখন শুনতে পেলাম আমার মেয়ে মেডিকেল চান্স পেয়েছে আনন্দে দু’চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আল্লাহর কৃপায় আমার মেয়ে মেডিকেল চান্স পাওয়ায় মা হিসাবে অনেক গর্বের। মেয়ের কাছে একটাই চাওয়া সে ডাক্তার হয়ে গরিব অসহায় মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবো। সেই সঙ্গে মেয়ে ভর্তিসহ মেডিকেলে পড়াশুনা জন্য সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন।

মেধাবী শিক্ষার্থী মোহছেনা আক্তার বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। তবে এখন আমার পড়াশোনার জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি সবার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাই।

তিনি আরও জানান, মহান আল্লাহ অশেষ কৃপায় মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। চিকিৎসক হয়ে মা-বাবার দুঃখ ঘোচাতে চাই। বিনামূল্যে গরিব মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে চাই। কিন্তু টাকার অভাবে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, জানি না।

সাবেক ছিটমহল আন্দোলনের নেতা গোলাম মোস্তফা সরকার ও আলতাফ হোসেন জানান, দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার ও অবরুদ্ধ জীবন আমাদের। ছিটমহল স্বাধীনের পর থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েরা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন নামি-দামি বিদ্যা পিঠে পড়াশুনা করছে। এটা আমাদের বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়াবাসীর অনেক বড় অর্জন। আর এই প্রথমবার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার শিক্ষার্থী মোহছেনা আক্তার মেডিকেল চান্স পেয়েছে। এটা শুনে হাজার গুণ খুবই ভালো লাগছে। কারণ একটা সময় এই ছিটমহলবাসীদের চুরি করে বাংলাদেশে গিয়ে চিকিৎসা করতে হয়েছে। সেই এলাকায় এলাকার কৃতিত্বের সঙ্গে মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন।মোহছেনা শুধু আমাদের এলাকার গর্ব নয়, সে পুরো সমাজের জন্য এক উদাহরণ। তার স্বপ্ন পূরণে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। এমুহূর্তে স্থানীয় মানুষজন এবং শিক্ষাবান্ধব সংগঠনগুলো সরকার মোহছেনার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর এই দুই সাবেক নেতা।

কাশিপুর ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আব্দুল বাকী খন্দকার জানান, মোহছেনা অত্যন্ত মেধাবী। তাকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। এখন যেহেতু মেডিকেলে চান্স পেয়েছে আমরা আবারও প্রতিষ্ঠানে থেকে অবশ্যই সহযোগিতা করবো। মোহছেনা আক্তার শুধু আমাদের কলেজের এলাকার গর্ব নয়, সে পুরো সমাজের জন্য গর্বের। তার স্বপ্ন পূরণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *