নুরুল আমিন কালাম,

প্রকৌশলী নুরুল আমিন কালাম ॥ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল মাতৃভাষাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জাতীয় আন্দোলন। জাতীয় এই আন্দোলনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে সব প্রতিবাদী নারী নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ একজনের নাম ছালেহা বেগম। সকলের প্রিয় ছালু আপা। ১৯৫২ সালে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন, জন্মÑ১৯৩৫ সালের ২৪সেপ্টেম্বর। বাবা এ. এম. আশরাফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। বাড়ি সিলেট অঞ্চলের মৌলভী বাজার জেলার কুলাউড়া থানার উছলাপাড়া গ্রামে। ঐ সময়ে বাবা সরকারি চাকুরির কারণে পিরোজপুরে পোস্টিং ও সেখানকার সাব রেজিস্ট্রার। তিন বোন ও দুই ভাই-এর মধ্যে ছালেহা বেগম তৃতীয়। বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এস. এম. হলে অ্যাটাস্ট ছিলেন কিন্তু থাকতেন চামেলী হল বা রোকেয়া হলে। দর্শনে অনার্স পড়ার সুবাদে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসাবে ছাত্র রাজনীতি ও তখনকার চলমান মাতৃভাষা আন্দোলনের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। মেজো বোন হোসনে আরা বেগম ১৯৪৮ সালে পিরোজপুর আরবান গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। জিন্নাহ ঢাকায় এসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ স্কুল থেকে ধর্মঘটের আহ্বান করায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

ছালেহা বেগমকে ময়মনসিংহে থাকতে হতো স্কুলের শানকিপাড়ার ছাত্রী হোস্টেলে। সেখানকার অভিভাবক হিসেবে ছিলেন তাঁদের মামা সি. এ. মান্নান, যিনি বন বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে ময়মনসিংহে কর্মরত ছিলেন। বলা বাহুল্য ছালেহা বেগম-এর পরিবার ছিল শিক্ষানুরাগী ও রাজনীতি সচেতন। ছালেহা বেগম ছিলেন দশম শ্রেণির অন্যতম মেধাবী ও সাহসী ছাত্রী। তিনি ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের খেলাধুলা ও সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন থাকার সুবাদে সবকিছুতেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। ছোট ক্লাসের মেয়েরাও ছালেহা বেগমকে তাদের বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করত।

১৯৫২ সালের ২১ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। দুপুরে জেলা টেলিফোন অফিসের মাধ্যমে খবর আসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় মিছিলে গুলি বর্ষণ হয়েছে এবং পরে রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মেইল ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে ময়মনসিংহের জনগণ জানতে পারে, ভাষার জন্য বরকত, রফিক, জব্বার ও সালাম গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সর্বত্র বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ময়মনসিংহেও। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রীরা সেদিন ক্লাসে যোগ দেয়নি। পরদিন তারা বিদ্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করে। মিছিল বের করে কালো পতাকা হাতে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে তারা। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করার মূল কারিগর ছিলেন ছালেহা বেগম। কালো পতাকা হাতে নিয়ে ছিলেন মিছিলের সামনে। নেতৃত্ব দিয়ে শহরের বিভিন্ন পথে মিছিল করেন। স্টেশন রোড হয়ে বিদ্যাময়ী স্কুলের সামনে এসে ঐ স্কুলের মেয়েদেরও মিছিলে সংযুক্ত করেন। ময়মনসিংহ শহরের ছাত্র জনতা সেদিন সকাল থেকেই ঢাকায় কী হচ্ছে খবর জানার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকালবেলা ময়মনসিংহের সর্বস্তরের মানুষ তখনকার রাজনীতিবিদ রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার শ্যামচরণ রায় রোডের বাড়িতে একত্রিত হয়ে “ময়মনসিংহ” শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও কালো পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনরত কর্মসূচিতে পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে ময়মনসিংহে আন্দোলনে মেয়েদেরকে শরিক করার জন্য সৈয়দ সুলতান আহমেদ, আফতাব উদ্দিন, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া ও শামসুল হক প্রমুখসহ আরো অনেকে সক্রিয় হন। বিদ্যাময়ী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা খানমের কঠিন প্রহরা ভেঙে সেই স্কুলের ছাত্রীদের ও মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রীদেরকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে মূল আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কঠিন দায়িত্ব পালন করার জন্য মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছালেহা বেগম একাই কাঁধে তুলে নেন মেয়েদের নেতৃত্বের প্রধান ভূমিকা। কালো পতাকা হাতে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই, রাজপথে গুলি কেন, জবাব চাই, জবাব চাই” ইত্যাদি। তার পরদিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারিও মিছিল হয় কালো পতাকা হাতে। সেদিন তাঁর সাথে অন্যান্য মেয়েদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছোট বোন তাহমিদা সাইদা, যিনি বিদ্যাময়ী স্কুলে লেখাপড়া করতেন, আরো ছিলেন সুফিয়া খানম। ডা. হালিমা খাতুন, জাহান আরা বেগম এবং তখন ময়মনসিংহে অন্য যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন, মতলুব আনাম হিরা ভাই, মাহবুব আনাম ওরফে গোরা ভাই, রজব আলী ফকির, মোজাম্মেল হক, শামসুল হক, মীর আবুল হোসেনসহ আরও অনেকে। এঁরা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের নেতা হিসাবে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বরকত, রফিক, জব্বার, সালাম ও ৯ বছরের ছোট শিশু ওহি উল্লা গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। এই সংবাদটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওতে শিল্পীরা অনুষ্ঠান বর্জন করেন, সরকারি অফিস আদালতসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। ময়মনসিংহ শহরেও থমথমে ভাব, হোস্টেল সুপার ‘সুফি আপার’ কড়া নির্দেশ ছিল, কাউকে রুম থেকে বের না হওয়ার জন্য। ছালেহা বেগম, বান্ধবী বেলী ও আছমা খাতুন এবং টেইলার মাস্টার হোসেন ভাই-এর সহায়তায় সকালে অ্যাসেমব্লি পয়েন্ট এ মেইন বিল্ডিংএর সামনে যেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হতো ঐ স্থানে ঐ মাপে শোক প্রকাশ করার লক্ষ্যে পরদিন শুক্রবার সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-এর মত ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলেও কালো পতাকা উড়ানো হলো, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছালেহা বেগম একাই। সকলের বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে কালো পতাকা ওড়ালেন। সরকারি অফিসার-এর মেয়ে বলে মারধর করা হয়নি, কিন্তু কথার ধারালো তির ছালেহা বেগমের বুকে বিদ্ধ করাতে সেদিন দ্বিধা করেননি স্কুলের প্রিন্সিপাল এবং জেলা প্রশাসক এম. এ. মজিদ। ফলে ছালেহা বেগমকে স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গের কঠিন শাস্তিস্বরূপ তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার ঘোষণা করা হয়। লজ্জায় গ্লানিতে তখন ছালেহা বেগমের মনে হয়েছিল “ছাত্র জনতার গুলি খেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল,” তা হলে হয়তো ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের গুলির প্রতিবাদ স্বরূপ কালো পতাকা উত্তোলনের দায়ে স্কুল ত্যাগের মতো এতো বড়ো লজ্জা মাথা পেতে নিতে হতো না। এই লজ্জা প্রাণত্যাগ-এর চেয়ে ভয়াবহ কষ্টের, অপমানজনকÑ তা হলো একজন মেধাবী ছাত্রীর “ছাত্রীত্ব” হারিয়ে মা বাবার কাছে, ফিরে যাওয়া। ছালেহা বেগমকে ২৫ ফেব্রুয়ারি স্কুল ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তিন বছর পর ছোটদের সাথে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার মতো মন মানসিকতা ও পরিবেশ তখন ছিলনা বলেই পরবর্তীতে কোন স্কুলেই আর তাঁকে ভর্তি করানো হয়নি। ফলে তাঁর আর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া হয়ে ওঠেনি এবং অল্প বয়সেই ছালেহা বেগমকে বসতে হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে।

ছালেহা বেগমের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে কেউ কেউ তাঁর গৌরবোজ্জ্বল অবদানকে হেয় করে কারো কাছে প্রকাশ করা থেকে সর্বদাই তাঁকে বিরত রাখতেন। ফলশ্রুতিতে পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে ছালেহা বেগম সন্তানদের ছাড়া আর কারো কাছে তাঁর এই ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা প্রকাশ করেননি, সেটাও ছিল খুবই যৎসামান্য। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে সেই অনাকাক্সিক্ষত বহিষ্কার আদেশের কথা মনে হলেই চোখে জল আসত ছালেহা বেগমের, চুপ করে একা একা কাঁদতেন, অন্য আর দশটা ছাত্রীর মত তাঁরও নিয়মিত পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার অদম্য বাসনা ছিল এবং স্বপ্ন ছিল অনেক বড়ো কিছু হওয়ার। কিন্তু ময়মনসিংহের অনাকাক্সিক্ষত বহিষ্কার আদেশের জন্য তাঁর জীবনে নেমে আসে নির্মম পরিহাস। তাই ছালেহা বেগম-এর স্বপ্ন অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে ছালেহা বেগম এতই মেধাবী ছাত্রী ছিলেন যে বরাবরই তিনি প্রত্যেক ক্লাসেই মেধা স্থান অর্জন করতেন ও সাহিত্য চর্চা খেলাধুলাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সব সময় প্রথম স্থান লাভ করে প্রচুর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।

কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সহযোগিতা এবং শিক্ষকতা :

তৎকালীন দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই ১৯৫৮ সালে তিন বোন অর্থাৎ ছালেহা বেগম ও তাঁর দুই বোন রওশন আরা বাচ্চু ও হোসনে আরা বেগম-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মেয়েদের পড়ালেখার কথা চিন্তা করে কুলাউড়া উছলা পাড়া নিজ বাড়ির সামনেই “আমতৈল” এর হেড স্যার ‘বিধু বাবুর সহায়তায় মাত্র ১১ জন ছাত্রী নিয়ে যিনি প্রথম ১৯৩৮ সালে আমতৈল অঞ্চলে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেই স্কুল খানসাহেব বাড়ির সম্মুখে কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে নব উদ্যোমে চলে। যাঁর প্রথম প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু এবং তাঁর সাথে তাঁর ছোট দুই বোন ছালেহা বেগম ও হোসনে আরা বেগম এর সর্বাত্মক সহযোগিতায় মেয়েদের পড়ানো শুরু করেন, উল্লেখ্য কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি সেই স্কুলে ৪ বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেন। সেই স্কুলই বর্তমানে ‘কুলাউড়া বহুমুখী গার্লস হাই স্কুল’ নামে পরিচিত এবং ছাত্রী সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। রেজাল্টও প্রতি বছরের মত ভাল করে আসছে বর্তমানে। কুলাউড়া বহুমুখী গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রীদের ভাল রেজাল্টের খবর শুনলে ছালেহা বেগম সর্বদাই আনন্দিত হয়ে উঠতেন।

সেই সময়ের দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নিয়েই ছালেহা বেগম শুরু করলেন শিক্ষকতা। ছাত্রীদের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জয়পাশা খন্দেগার জমিদার বাড়ীর ছাত্রীগণের কথা উল্লেখ করেন, বিশেষভাবে রশিদা, হুমেরা, বেবী এবং কোহিনুর, মুক্তা ও নিগারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এই ৬ বোন-এর সকলেই বিশেষ প্রহরায় “পালকি” যোগে স্কুলে আসতো লেখাপড়ার জন্য। বড় বাড়ির মেয়ে বলে অন্যান্য শিক্ষকগণ তাদেরকে কিছু না বললেও শিক্ষয়িত্রী ছালেহা বেগম ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি সব সময় তাদের কাছ থেকে তার পড়া আদায় করে নিতেন। এছাড়াও আর.আই.ও. সাহেবের মেয়ে ফাতেমা এবং আলাউদ্দিন হাজী সাহেবের বড় মেয়ে তারও নাম ছিল “ফাতেমা”। এই দুই ফাতেমাও ছালু আপা বলতে ছিলেন অজ্ঞান। বিনা বেতনে চাকরি করেছেন চার বছর এই বালিকা বিদ্যালয়ে।

ছালেহা বেগম ১৯৬১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ তাড়াইলের সেকান্দার নগর নিবাসী সৈয়দ আবদুল আহাদ মশ্কূর-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সৈয়দ আবদুল আহাদ (মশ্কুর) সাহেবের পূর্ব পুরুষ ছিলেন হয়রত শাহ জালাল (রা.) ৩৬০ আওলীয়াখ্যাত সিলেট কুমার পাড়ার হযরত হামজা (রা.)। উল্লেখ্য সৈয়দ আবদুল আহাদ ছিলেন একজন চলচ্চিত্র সাংবাদিক, “ফিল্ম ইন্সটিটিউট অ্যান্ড আর্কাইভ”-এর চলচ্চিত্র সংগ্রাহক, কলামিস্ট, চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক। ছালেহা বেগমকে বিয়ের পর চলে যেতে হয় স্বামীর কর্মস্থল উত্তরবঙ্গে। প্রথমে রংপুর তারপর দিনাজপুরে তারপরে কুষ্টিয়ায়। পরবর্তীতে তাঁর স্বামীর নানাবাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার হয়বত নগর দেওয়ান বাড়িতে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের কথা

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডামাডোলে কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে খিচুরি রান্না করে, ভাই আমির আলীর মাধ্যমে পাঠাতেন। বাড়ির ফলমুলাদি ও সুপেয় পানি সাথে দিয়ে দিতেন, যা খেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলের মাঠে ক্যাম্প চলাকলীন সময়ে শারীরিক কসরতে উৎসাহিত হত।

কুষ্টিয়ার চাঁদ সুলতানা হাই স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষকতা

ছালেহা বেগম ১৯৬৩ সালে কুষ্টিয়ার “চাঁদ সুলতানা হাই স্কুলে” কোন সার্টিফিকেট ছাড়াই শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করে ইতিহাস বাংলা সহ অন্যান্য বিষয়ে পড়াতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, তাঁর হাতের লেখা ছিল সুন্দর, উচ্চারণ ছিল স্পষ্ট ও সাবলীল।

বাবার বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও আইন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন

এত কিছুর মাঝেও বাবা এম. আশরাফ আলীর মৃত্যুর পর ছালেহা বেগমকে যখনই তাঁর মা মনিরুন্নেসা খাতুন ট্রাংকলের মাধ্যমে খবর পাঠাতেন তখনই ছুটে যেতেন কুলাউড়াতে। বাবার বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করতে বিধবা মা ও ছোট ভাইকে সহযোগিতা করতেন। মামলা মোকদ্দমা পরিচালনা করতে করতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আইন বিষয়ে দক্ষ জ্ঞানের অধিকারী।

নারীর ক্ষমতায়নে ছালেহা বেগমের যুগান্তকারী পদক্ষেপ

বাবার বাড়ির সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে ছালেহা বেগম জমিজমা ও ফৌজদারি আইন বিষয়ে সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী হয়ে ওঠেন। সম্পত্তি উত্তরাধিকার বণ্টনে মেয়েদের এক অংশ এবং ছেলেদের দুই অংশ এই বিষয়টি ছালেহা বেগমকে সমসময় ব্যথিত করতো। আর তাই তিনি সর্বদাই বলতেন, আমি ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোন তফাত করি না এবং আমার সম্পত্তিতে আমার ছেলেমেয়েরা সমঅধিকারে বণ্টন করে নেবে। বলাবাহুল্য, ছালেহা বেগমের সন্তানেরা তাদের মায়ের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তকে সম্মান করে তা বাস্তবায়ন করেছেন। সকল ক্ষেত্রে তারা বাবা মায়ের সম্পত্তি বণ্টনে সমঅধিকার নিশ্চিত করেছেন।

শশুর বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস

১৯৬৫ সালে তিনি চলে আসেন স্বামীর মাতুলালয় হয়বৎ নগর দেওয়ান বাড়ি কিশোরগঞ্জে। জীবনের বাকি সময় তিনি সেখানে কাটান এবং পুরোটা সময় স্বামী সংসার এর পাশাপাশি শিক্ষকতা ও সেলাই, বয়স্ক শিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কর্মকাণ্ডে আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

“বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র” গঠন :

ছালেহা বেগম সংসার জীবনের পাশাপশি সবসময় তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিশোরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী ফাতেমা ইসলামকে সাথে নিয়ে, উনার বাসভবনের সামনে বৈঠকখানাকে ব্যবহার করেন, নারীদের হস্তশিল্প ও নানারকম কারুকার্যময় পোশাক তৈরির উদ্যোগ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের নারীদের কর্মমুখি করে গড়ে তোলার উদ্যোগে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করেন। উনাদের সঙ্গে ছিলেন এসভি সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ও ভাষাসৈনিক বেগম রাজিয়া হোসাইন। খড়মপট্টি এলাকায় ১৯৭৮ সালে গড়ে তোলেন কিশোরগঞ্জের প্রথম ‘বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র’ যা কিশোরগঞ্জের, খড়মপট্টি, শোলাকিয়া, গাইটাল, হারুয়া, হয়বৎ নগর, নগুয়া, বত্রিশ, নিউটাউন, বউলাই ইত্যাদি অনেক এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। মহিলাদের যারা পড়াশুনায় আগ্রহী এবং বয়স্ক, তারা বিনা বেতনে এই অবৈতনিক স্কুলে পড়াশুনা করতে আসতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার অভাবে বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

যেমন ছিলেন কর্মচঞ্চল মহিয়ষী ভাষা কন্যা ছালেহা বেগম :

ছালেহা বেগম তাঁর বাবার বাড়ি কুলাউড়ার মানুষের কাছে ও শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জের হয়বৎ নগরের মানুষের কাছ একজন অত্যন্ত আন্তরিক, দয়ালু, অতিথিপরায়ণ, সৎ, নিষ্ঠাবান, অক্লান্ত পরিশ্রমী, পরোপকারী মানুষ বলেই পরিচিত ও শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় হর্টিকালচার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে আরও অধিকতর দক্ষ করে তোলেন। নারী শিক্ষার প্রসার ও মেয়েদের স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ছালেহা বেগম সবসময়ই পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি গুরুত্ব দিতেন শিশুদের শরীরচর্চা, গল্পের বই পড়া, বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজি, ফলমূলের চাষ, হাতে ও কলমে সেলাই শিক্ষা এবং অন্যান্য কর্মমুখি শিক্ষা বিস্তারে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। নারী শিক্ষার প্রসার ও মেয়েদের স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ছালেহা বেগম সবসময় সাহসী ভূমিকা পালন করতেন। যাতে পুরুষের পাশাপাশি গৃহিণীরা নিজস্ব অঙ্গনে থেকে কিছু উপার্জন করে স্বনির্ভর হন এবং সংসারে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারেন।

হয়বৎ নগর জমিদার বাড়ির বউ হওয়ার পরও তিনি নিজেকে রেখে ছিলেন আড়ম্বরহীন। পরিশ্রমী সহজ সরল জীবনের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন। নিজ গৃহের সকল কর্মকাণ্ড অধিকাংশ সময় নিজেই সম্পন্ন করতেন। ছালেহা বেগমের স্বামী একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় সাংসারিক জীবনে বৈষয়িক ছিলেন না। এমতাবস্থায় ছালেহা বেগমের প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকা সত্ত্বেও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে চার সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলেন। কখনও দমে যাননি। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে একজনের পর একজন সন্তানকে স্কুলের পড়া ও পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দিতেন। রাত্রিবেলা প্রতিদিনের হিসেবের খাতা লিপিবদ্ধ করা ও ডায়েরি না লিখে তিনি ঘুমাতেন না। পরিবারে সদস্য ও আত্মীয় প্রতিবেশীদের প্রতি ছিলেন ত্যাগী ও সহনশীল। ছালেহা বেগমের কাছ থেকে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরে যাননি। ছিলেন সাহিত্যের ও সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগীÑ সময় পেলেই বই পড়তেন। গুন গুন করে আপন মনে হাসন রাজার, (কান্দে হাসন রাজার মনমণিয়ারে….) লালনের গান গাইতেন। পালন করতেন প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় দিবস। জীবনের প্রতিটি ২১ ফেব্রুয়ারিতে খুব ভোরে ফুল দিয়ে আসতেন শহিদ মিনারে, কিন্তু কখনই প্রকাশ করেননি মনের গভীরে লুকানো কষ্টের কথা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন বেড়াতে। সর্বগুণে গুণান্বিতা ছালেহা বেগমের কর্মময় জীবন ও তাঁর উচ্চ মানবিকতা ও পরিমিতিবোধ আজও এলাকার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত।

উল্লেখ্য যে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছালেহা বেগম আজীবন তাঁর কাছে যখন যে গৃহকর্মী কাজ করতেন তাকে তিনি বিকেলে অথবা তার কাজের অবসরে শিক্ষা দান করে শিক্ষিত করার চেষ্টা করতেন। নিজের শিক্ষাজীবনের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় আজীবন শিক্ষানুরাগী হিসাবে সকল আত্মীয় স্বজন ও শ্বশুর বাড়ির সকল মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার ব্যাপারে সর্বদা উৎসাহ ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন এবং সেই চেষ্টার অংশ হিসাবে নিজের ২ ছেলে ও ২ মেয়েকেও লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষা দান করে যান। তাঁর বড় মেয়ে অ্যাডভোকেট সৈয়দা ফেরদৌস আরা দীর্ঘদিন যাবত আইন পেশায় নিয়োজিত, ছোট মেয়ে অ্যাডভোকেট সৈয়দা ফরিদা আক্তার আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আইন বিভাগে কর্মরত আছেন। বড় ছেলে লেখক, গবেষক সৈয়দ শাকিল আহাদ ১টি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত এবং সর্বকনিষ্ঠ ছেলে সঙ্গিত শিল্পী সৈয়দ ওয়াকিল আহাদ ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সর্বশ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার অর্জন করেন।

ছালেহা বেগমের শেষযাত্রা

ছালেহা বেগম বিভিন্ন রকম সামাজিক শিক্ষা সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে দেশ ও দশের উন্নয়নে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালে ১৯ আগস্ট কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন)। তাঁর স্বামীর ইচ্ছায় পরদিন কিশোরগঞ্জ হয়বৎ নগর জমিদার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

বর্তমান মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার একই পরিবারের তিন বোন তিন জায়গায় থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এরকম একটি ভাষা সৈনিক পরিবারের উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশে কোথাও আছে বলে জানা নেই। এই তিন বোন সমগ্র বাঙালি জাতির গৌরব, এঁরা রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোন বড় পুরস্কারে ভূষিত হননি। বাংলা ভাষা আজ বিশে^র দরবারে পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান। ছালেহা বেগম এত অল্প বয়সে যে অবদান রেখেছেন তা বিরল। যে শাস্তি পেয়েছেন তাও বিরল। নীরবে নিভৃতে চলে গেলেন প্রচার বিমুখ ভাষা কন্যা ছালেহা বেগম, কিন্তু ছালেহা বেগমের অবদানের কোন মূল্যায়ন হয়নি কিংবা শাস্তিও প্রত্যাহার হয়নি।

তাই বিশিষ্টজনের দাবি, ছালেহা বেগমের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিরল নেতৃত্ব প্রদানের জন্য ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত তৎকালীন বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং তাঁর জন্য ভাষা আন্দোলনের সর্বোচ্চ মরণোত্তর সম্মান প্রদর্শন করা হোক। লেখক, প্রকৌশলী.সাধারন সম্পাদক, ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন, ময়মনসিংহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন