মহিউদ্দিন সরকার

সময়ের চাকা ঘুরে রমযান আবার বিশ্ববাসীর সামনে হাজির। রমযান ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বর্তমানে ইসলাম বেশ কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির শিকার। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রমযানও এই ভুল বোঝাবুঝির হাত থেকে মুক্তি পাইনি। রমযান সম্পর্কে সৃষ্টিকর্তা কুরআনে ঘোষণা করেছেন , ” হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের উপর সিয়াম বাধ্যতামূলক করা হল যেমন করা হয়েছিল পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের উপর, ফলে আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্ৰত হবে “সুরা আল বাকারা আয়াত ১৮৩। রমযান পালনের কেন্দ্রীয় বিষয় তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি অর্জন করা । অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ-ভীরু করে গড়ে তোলা। ফলে রমযান পালনের অর্থই হল আল্লাহ ভীতি অর্জনের সাধনা করা। রমযান মাসে আল্লাহ ভীতি অর্জন করার সাধনার পথের নাম সিয়াম। তাই রমযান মাসে এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যে আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে পারে তারই রমযান পালন সফল হয়। আর যে আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে পারে না তার রমযান পালন সফল হয় না। আল্লাহ ভীতি হল প্রতিটি বিষয় বা কাজে সিদ্ধান্ত গ্ৰহন ও বাস্তবায়নের সময় আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলা। সে সীমারেখা অতিক্রম না করা। একমাত্র আল্লাহর ভয়ে যে ব্যক্তি সে সীমারেখা অতিক্রম করে না সে ব্যক্তির আল্লাহ ভীতি বা তাকওয়া আছে। আর যে ব্যক্তি তা করে না তার আল্লাহ ভীতি নেই। বা যে ব্যক্তি তা করতে পারে না সে ব্যক্তির আল্লাহ ভীতি মজবুত নয়। তাই প্রতিটি সিয়াম সাধনাকারী মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর আত্মসমীক্ষা করলে উপলব্ধি করতে পারবেন তার সিয়াম সাধনা কতটা সফল হল বা তিনি কতটা আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে সক্ষম হলেন। আল্লাহ নির্দেশিত এই সীমারেখা জীবনের প্রতিটি বিভাগ ও স্তরে প্রসারিত। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্র। আবার আচার অনুষ্ঠান, আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা , যুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্মসূচি, খেলাধুলা সহ সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা স্পষ্ট। সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহ ভীতিকে কাজে লাগাতে হবে। ফলে সিয়াম সাধনার সকল কর্মসূচির মূল ভাবনা হতে হবে কীসে আল্লাহ ভীতি অর্জন হবে ,আর কীসে হবে না। আল্লাহ নির্দেশিত এই সীমারেখা বা আল্লাহর নিয়ম-কানুনএর নির্ভুল প্রধান উৎস হচ্ছে আল কুরআন। আল্লাহ বলছেন ” রোযার মাসে কুরআন পাঠানো হয়েছে, এ কুরআন মানব জাতির জন্য পথের দিশা,সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী “। তাই আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে হলে বা আল্লাহ ভীরু হতে হলে কুরআনকে জানতে হবে। বুঝতে হবে। এক মাত্র কুরআনের জ্ঞানী লোকেরাই আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহ ভীরু হতে হলে কুরআনের শিক্ষা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ বলছেন ” আল্লাহকে সত্যিকার ভয় একমাত্র সত্যিকারের শিক্ষিত সম্প্রদায়ই করে থাকে “, সুরা ফাতির আয়াত ৬৮।বোঝা যাচ্ছে কুরআনের জ্ঞানী হওয়া ছাড়া আল্লাহ ভীরু হওয়া যায় না। আল্লাহ বলছেন” বলতো দেখি, শিক্ষিত লোক আর অশিক্ষিত লোক কি কখনো এক সমান হতে পারে? সুরা জুমার, আয়াত ৯। অতএব সমীকরণ দাড়াল রমযানের উদ্দেশ্য আল্লাহ ভীতি অর্জন করা। আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে হলে কুরআনকে অধ্যয়ন করতে হবে। কুরআন অধ্যয়ন করলে জানা যাবে কোনটা আল্লাহর পথ । কোনটা নয়। এটা জানতে পারলে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে। তার ফল উভয় জগতে উপভোগ করতে পারবে। আল্লাহ বলছেন ” তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই অধিক মর্যাদা-সম্পন্ন যে ব্যক্তি অধিক আল্লাহ ভীরু, সুরা হুজুরাত আয়াত ১৩। তাই মানুষের মধ্যে আল্লাহ ভীরুতা সর্বদাই জাগ্ৰত করে রাখার লক্ষ্যে প্রতি বছর নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা এই রমযান।
সিয়াম হল রমযান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কিছু হালাল থেকে বিরত থাকা। ঐ বিষয়গুলোকে ঐ সময়ের জন্য আল্লাহ হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা বা পদ্ধতি হচ্ছে কিছু সময়ের জন্য কিছু বিষয়কে হারাম ঘোষণা করে তা থেকে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া। প্রশিক্ষণ গ্ৰহণকারী যাতে অন্য সময় স্থায়ী হারাম থেকে বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করে বেঁচে থাকতে পারেন। আমরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেখতে পাই সুস্থ শরীরে কোন বিশেষ রোগের শোধিত জীবাণু প্রবেশ করানো হয়। এই শোধিত জীবাণুর সাথে শরীরের মধ্যে থাকা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা যুদ্ধ করে । এই যুদ্ধের ফলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটা আসল যুদ্ধ নয়। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। উদ্দেশ্য আসল যুদ্ধের সময় শত্রুকে পরাজিত করার মত শক্তি অর্জন করা। ফলে কখনো ঐ রোগের জীবাণু সত্যি আক্রমণ করলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা তার সাথে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করে। শরীরকে ঐ রোগ থেকে রক্ষা করে। সুস্থ রাখে। তেমনি হালালকে হারাম ঘোষণা করে তা থেকে বেঁচে থাকার লড়াই করি। এই লড়াই এর মধ্যে দিয়ে যে শক্তি অর্জন করি সে শক্তি প্রয়োগ করে বাকি সময় হারামের সাথে লড়াই করে তা থেকে বেঁচে থাকি। অর্থাৎ রমযান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে ভাবে সাধনা করে অস্থায়ী হারাম থেকে বেঁচে থাকি ঠিক সে ভাবেই সাধনা করে বাকি সময় স্থায়ী হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এটাই রমযানের শিক্ষা। সিয়াম সাধনার অর্জন। যে শিক্ষা বা চেতনা মনের মধ্যে এ শক্তি যোগায় সে শক্তির নাম আল্লাহ ভীতি বা তাকওয়া। আরো সহজ করে বললে যে ভয়ে বা যার ভয়ে রমযান মাসে দিনের বেলায় অস্থায়ী হারাম থেকে বেঁচে থাকি ঠিক সে ভয়েই বা তাঁর ভয়েই অন্য সময় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থায়ী হারাম থেকে বেঁচে থাকি। এ ভয়টার নামই আল্লাহ ভীতি বা তাকওয়া।
রমযান মাসের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি আল্লাহ ভীতি অর্জন করা। এর সিলেবাস আল কুরআন। কুরআন অনুশীলন এর মাধ্যমেই তৈরি হবে আল্লাহ ভীতি। তাই রমযান মাসের প্রধান কর্মসূচি কুরআন চর্চা, অনুশীলন, অধ্যয়ন, গবেষণা। ব্যক্তির পরিসর, যোগ্যতা, সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী। সমষ্টিগত ভাবে কুরআন অধ্যয়ন চক্র ইত্যাদি। কিন্তু সমগ্ৰ রমযান মাসের জন্য তৈরি কোন উপকরণে কুরআন অনুশীলন এর গুরুত্বের কথা চোখে পড়ে না। হোক তা সময়-সারণি, ক্যালেন্ডার বা বিভিন্ন রকম আলোচনা যেমন জুমুয়ার বক্তব্য,অন্য আলোচনা। কুরআন চর্চার কোন পরিকল্পিত কর্মসূচি দেখা যায় না। ক্রমশ আনুষ্ঠানিকতা যান্ত্রিকতার রুপ গ্ৰহণ করছে। সর্বত্র জায়গা করে নিচ্ছে সাহারি এবং ইফতারির ক্ষণ, মুহূর্ত। মিনিট। মনে হয় সিয়াম কবুল হওয়া বা আল্লাহ ভীতি অর্জন হওয়া না হওয়া নির্ভর করছে এক দু মিনিট সময় আগে পরের উপরে। অথচ সুবহে সাদিকের সময় অবিতর্কিত হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট মিনিটে বেঁধে দেওয়া যায় না। তার পরিসর পাঁচ দশ মিনিট তো বটেই। কে কখন খাওয়া শেষ করবে বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। ইফতারির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সূর্যাস্ত এর সূচনা হল ইফতারির শুরু। তারাবীহ নামায আট রাকাত না বিশ রাকাত সেই বিতর্কের আজও অবসান হল না। অথচ নবী তিন দিনের বেশি তারাবীহ পড়েননি। কোরআন খতম এর ব্যবসা ক্রমশ উদ্ধমূখী। ইফতারের সময় কিছু মানুষের অপচয়, কিছু মানুষের কাছে খাওয়ার উৎসবে পরিণত হচ্ছে। এগুলোই রমযান আলোচনার মূখ্য উপজীব্য হয়ে রয়েছে সমাজে। অথচ রোযা বা সিয়াম সাধনার মূল শিক্ষা বা স্পিরিটের দিকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে ঘড়ির কাঁটায় বা যান্ত্রিকতায় আটকিয়ে যাচ্ছি। গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল আল্লাহ ভীতি অর্জন এর সিলেবাস , প্রশিক্ষণ নীতি ও কর্মসূচি হিসেবে আল্লাহ যা দিয়েছেন তা অনুধাবন করার উপর। অনুশীলন করার উপর। এই কর্মসূচি সমাজে না থাকার কারণে আল্লাহ ভীতি অর্জনের সিয়াম সাধনা কেবলমাত্র পরকালের জন্য নেকী অর্জনের আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। ফলে রমযান মাসের শিক্ষার সুফল থেকে সমাজ বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্তরে কিছুটা সুফল মিললেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরে কোন প্রভাব ফেলে না। এমনকি মুসলিম সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। রমযান মাসেও মুসলিম সমাজে ঝগড়াঝাঁটি, হিংসা, বিদ্বেষ, পরচর্চা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বন্ধ হয় না। এই পরিস্থিতিকেই তুলে ধরতে কয়েক বছর আগে পাক্ষিক”রঙধনূ” তে সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ” জ্বলছে আগুন পুড়ছে কই? ” ।
আল্লাহ ভীতি বা তাকওয়ার প্রয়োজন কী ? আল্লাহ ভীতির প্রয়োজন হল কল্যাণকর সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যক্তি গঠন। এই ব্যক্তি চরিত্রের ভিত্তি হবে ত্যাগ, ধৈর্য্য,সংযম, সহিষ্ণুতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি মৌলিক মানবিক গুণাবলী। ইসলামের লক্ষ্য মানবিক ঐক্য ও সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিহীন, বৈষম্য হীন, জাতপাত মুক্ত , দারিদ্র্য মুক্ত,শোষণ ও বঞ্চনা মুক্ত সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এর অনূকুলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের যেমন অর্থ, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, যুদ্ধ , মানবাধিকার, বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের মধ্যে সম্প্রীতির মৌলিক নীতিমালা দিয়েছে ইসলাম। এই সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, লালন পালন, টিকিয়ে রাখার জন্য যে সব যোগ্যতা ও দক্ষতা দরকার হয় তার ভিত্তি তৈরি হয় আল্লাহ ভীতি কেন্দ্রিক মানবিক গুণাবলীতে। এই গুনাবলী কাজ করে দুই ভাবে। এক দিকে সমাজকে শিক্ষিত করে, প্রভাবিত করে এই শিক্ষার দিকে যে, আমি, আমার সহায় সম্পদ সম্পত্তি সমাজের অংশ। সমাজের প্রয়োজনে তার সবটুকুই বিলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রস্তুত থাকার প্রশিক্ষণটাই দেয় রমযান। রমযান তার শিক্ষা শুরুই করে চ্যারিটি বিগিনস আ্যট হোম দিয়ে। অপর দিকে প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রশিক্ষিত করে সমস্ত রকম অন্যায় অবিচার, অপসংস্কৃতি থেকে বেঁচে থাকতে। নিজে বেঁচে থাকার সাথে সাথে সেই অন্যায়, অবিচার, অপসংস্কৃতিকে দূর করাও ইসলামের লক্ষ্য। শোষণ লুন্ঠন, অপচয় বন্ধ করাও এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়নের কাজ শুরু করলে বর্তমান সমাজ বা রাষ্ট্র যে বাধার পাহাড় তুলে ধরবে তার সামনে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকার জন্য যে শিক্ষা দরকার সে শিক্ষাই দেয় রমযান। অর্থাৎ যারা সিয়াম সাধনা করে আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে পারে তারাই সমস্ত রকম মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধৈর্য্য ধারণ করে মজবুত ভাবে টিকে থাকতে পারে। সেই শিক্ষার ফলে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারার মধ্যেই আছে পুণ্য অর্জন। আল্লাহ বলছেন ” পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরানোর মধ্যে পুণ্য নেই। পুণ্য আছে —— দারিদ্র্য ও বিপদের সময় এবং হক ও বাতিলের সংঘর্ষের সময় ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয় তারাই হল সত্যিকারের পুণ্য বান লোক ” । সুরা বাকারা ,আয়াত ১৭৭। রমযান মাসে দিনের বেলায় যে শিক্ষার ফলে শত প্রলোভন, কষ্ট সত্ত্বেও অস্থায়ী হারামের সামনে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকি , সে শিক্ষার বলে বলিয়ান হয়েই শোষণ বঞ্চনা মুক্ত সমাজ গঠনে সমাজ বা রাষ্ট্রের সীমাহীন অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবিচল থাকতে হবে। আজকে দেশের প্রচুর জনগণ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছেন। সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা পঞ্জীভূত। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। জাতীয় সম্পদের অপচয় ও বৈষম্যপূর্ণ বন্টন ক্রমবর্ধমান। এ সবের বিরুদ্ধে সিয়াম সাধনাকারীদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি অধিকাংশ সিয়াম সাধনাকারী সিয়াম সাধনা থেকে অর্জিত শিক্ষাকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে দেখেন। আজকের সমাজ এবং রাষ্ট্রে দুর্নীতি, বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েই চলেছে। দারিদ্র্য, অনাহারে মৃত্যু থামছে না। হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ রমযানের শিক্ষা এ সবের বিরুদ্ধে আমাদের জাগাতে পারছে না। আমরা নিজেরাই এই সব ইসলাম বিরোধী কাজে অংশগ্রহণ করেছি। ঘুষ, তোলাবাজি , কালোবাজারি, মজুমদারী সবেতেই আমাদের উপস্থিতি। রোযাদার ব্যবসায়ীরাও লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে দ্বিধা করছেন না। নিজেরাই পরিবেশের ভারসাম্য ধ্বংশ হয় এমন কাজ করতে পিছপা হচ্ছি না। মদ, অশ্লিলতা , ব্যভিচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সবের বিরুদ্ধে কোন কর্মসূচি গ্ৰহণের উদ্যেগ চোখে পড়ছে না। ইসলাম স্বীকৃত অন্যায় যেই করুক ,সে ব্যক্তি হোক,পরিবার হোক, সমাজ হোক, রাষ্ট্র হোক তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা ইসলামের মৌলিক কর্মসূচি। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব হল , সমাজের অবিচার,যুলুম,অত্যাচার , শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যথাসম্ভব সর্বপ্রকার শক্তি প্রয়োগ করা ও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। ইসলামের নির্দেশ হল, ” তোমাদের মধ্যে যদি কোন অন্যায় কাজ হতে দেখ তাহলে শক্তি প্রয়োগ করে তা বন্ধ করে দাও। যদি শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে মুখ দিয়ে বন্ধ করে দাও। এটাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে মনে প্রাণে সে কাজের প্রতি ঘৃণা পোষণ কর। এটা হবে দুর্বল ঈমানের পরিচয়”। অন্য একটি হাদিসের ভাষ্য ” তোমাদের মধ্যে যে কেউই ন্যায়বিচার বিরোধী কাজ করতে দেখবে তা বন্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো তার অপরিহার্য দায়িত্ব। হাদীসের বক্তব্য সমাজ তথা রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘটিত সর্বপ্রকার অন্যায় অবিচার কাজের জন্য রাষ্ট্রের প্রত্যেক ব্যক্তিকেই জবাবদিহি করার জন্য দায়ী থাকতে হবে। সে উক্ত কাজে অংশগ্রহণ করে থাকুক বা না থাকুক। কোন অন্যায় হতে দেখে নিরব থাকা বা তার উপর অসন্তুষ্ট না হওয়া সে অন্যায়কে সমর্থন করার সামিল। আজকে আমাদের মত রোযাদারদের আত্মসমীক্ষা করতে হবে দেশে ঘটমান অন্যায় অবিচার এর ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কী । আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব যে , ঘটমান যুলুম, নিপীড়ন ও বৈষম্যেকে মনে মনে ঘৃণা করি ? ঘৃণা করলে তো আর যাই করি এ সব যুলুমকারীদের সাহায্য করতে পারি না। সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে এ সব অন্যায় অবিচার দুর করার জন্যই তো প্রতি বছর নিয়মিত সিয়াম সাধনার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এর পরেও চতুর্দিকে যুলুম আর অত্যাচারের সয়লাব। এই প্রেক্ষাপটেই সিয়াম সাধনাকারীদের আল্লাহ বলছেন প্রতি বছর নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পরেও ” তোমাদের এমন কী হল যে, তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্ৰাম করছ না সেই সকল দুর্বল নর নারী ও শিশুদের বাঁচানোর জন্য যারা এই বলে ফরিয়াদ করছে , হে আমাদের রব, যালিমদের এই যুলুম থেকে আমাদের রক্ষা কর।তারা আমাদের উপর শোষণ,পীড়ণ এবং অত্যাচারের স্টীম রোলার চালাচ্ছে। সুরা নিসা আয়াত ৭৫।
রমযান পালনকারীদের উপলব্ধি করতে হবে ইসলামের কোন শিক্ষাই শুধুমাত্র পরকালের জন্য ফল দেয় না। ইসলাম তার মৌলিক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির দাবি মিটানোর সাথে সাথেই সমস্ত মানুষের বাস্তব জীবনের বস্তুগত চাহিদাও পূরণ করে থাকে। প্রতিটি শিক্ষারই সুফল আছে ইহকাল ও পরকালে উভয় জগতের জন্য। বাস্তবে প্রতিদিনের বস্তুগত প্রয়োজনের জন্য উপকারী কর্মসূচির সম্মনয় হল ইসলাম। ইসলামের কর্মসূচি মেনে চললে বাস্তব জীবন হবে শান্তিপূর্ণ, সুন্দর, সুখী ও কল্যাণকর। তারই প্রতিফল পাওয়া যাবে পরকালে। রমযানের শিক্ষা মুসলিম সমাজকে এ পথে পরিচালিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এ ব্যর্থতা রমযানের নয়। এ ব্যর্থতা আমাদের।
আমাদের রাজ্যে সিয়াম সাধনার মধ্যেই শুরু হবে পঞ্চায়েত নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা রকম ইসলাম ও আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে বেশি জড়িয়ে পড়েন মুসলিম সমাজই। রমযান মাসে বা রমযান পরবর্তী মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংঘটিত ইসলাম ও আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডের সংখ্যা যদি অন্য মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের চেয়ে কম না হয় তা হলে অবশ্যই বলা যায় সিয়াম সাধনায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। রমযান মাসের প্রতিটি জুমুয়ার খুৎবায় বলা দরকার আমরা পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের ইসলাম ও আইন বিরোধী কার্যকলাপে জড়াব না। যে দলই করি না কেন (যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে সব দল করা যায় না) মারামারিতে জড়াব না। নেতাদের সাহস করে শান্ত ভাবে বলে দেব আপনার সাথে দল করি ঠিকই কিন্তু আপনার কথায় ঝগড়া ঝামেলায় যাব না। এর ফলে সমাজ কিছুটা হলেও সিয়াম সাধনার ফল উপভোগ করবে। বিষয়টির প্রতি মসজিদের ইমাম ও কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *