-মনজুরুল ইসলাম
বর্তমানে ভাইয়ে ভাইয়ে সাম্যতা নেই,পরিবারে সাম্যতা নেই,যেখানে ভাইয়ে ভাইয়ে অমিল সেখানে চাচা ভাতিজার পরিচয়ই থাকছেনা। পুষ্টিহীন মা-বাবা প্রতিনিয়ত গাধার শ্রম বিনিয়োগ করেও ফল পায়না ।দাদা-দাদী পরিবারের বৃদ্ধরা চিকিৎসাহীন অপুষ্টিতে ভোগে এবং দুর্বিসহ জীবন যাপন করে। সামর্থবানদের খুবই যৎ কিঞ্চিত অপ্রতুল নাম মাত্র বৃদ্ধ আশ্রমে মানসিক যন্ত্রনায় ভোগে। প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিবেশী অনেক বেশী রুক্ষ অবস্থায় অবস্থান করে। কেউ কারো ভালোর দিকে তাকায় না। পারলে হায়েনার মত ঘায়েল করার চেষ্টা করে এবং সর্বস্তরে হরহামেশা অরাজকতার সৃষ্টি করে।ক্রমে শ্রেনী বৈশম্য প্রকট আকার ধারণ করে। এসব কিছুই প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনহীনতা,অর্থনৈতিক,শিক্ষা বিষয়ক,বিচার বিভাগীয়,প্রশাসনিক,উৎপাদন বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ,রাজনীতির দুষন মহামারী আকার ধারন করে।
এই অবস্থা থেকে স্থায়ী মুক্তির ভাবনা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে যারা ফিরে ফিরে শাসন ক্ষমতা চালিয়ে আসছে তাদের মধ্যে কোন উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় না। তারা সর্বদা স্বার্থ সিদ্ধির রাজনীতি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিথ্যা প্রচারনা চালিয়ে আসে। যার হাতে রাষ্ট্রের সম্পদের নিশ্চয়তা নেই তারাই বার বার সম্পদের রক্ষক হয়ে ভক্ষন করে। এই লোক ঠকানো রাজনীতির অবসান হওয়া একান্ত জরুরী।
যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোর সঙ্গে জড়িত থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্ত আত্মসাত করে দেশের বাইরে পাচার করে বিদেশে সেকেন্ড হোম করে তাদের দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই। তারাই আবার বার বার ক্ষমতার অংশীদার হয়।
সকল কিছুর যেমন নির্ধারিত মাত্রা থাকা বাঞ্জনীয় তেমনি সম্পদ সংগ্রহের ব্যাপারেও মাত্রা থাকা উচিৎ। রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্র সেবার নামে রাষ্ট্রের সম্পদ জনগণকে ফাঁকি দিয়ে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে,সর্বোচ্য ভোগ বিলাস করার চেষ্টা করে,কিন্তু তাদের চৌদ্দ পুরুষও ভোগ করে শেষ করতে পারেনা। ভোগেরও সীমা রেখা আছে। একজন ব্যক্তি এক সাথে কখনই সুরম্য প্রাসাদে ঘুমাতে পারেনা,এক সঙ্গে দুটি নারীকে ভোগের সামগ্রী বানিয়ে ভোগ করতে পারেনা,এক সাথে দুটি গাড়ীতে চড়তে পারেনা। তাহলে কেন লোক ঠকানো?সাধারণ মানুষের অধিকারকে খর্ব করে কেন এই জুয়া খেলা বা ক্যাশিনোর ফাঁদ? পক্ষান্তরে অবৈধ সঞ্চয়ের বিচার দুরের কথা ? আবার তারাই কালো টাকা সাদা করণে বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করে অপরাধীকে বৈধ করে নেয়। যদি না সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এই ধারাবাহিকতা অনন্তকাল গতিশীল থাকবে সন্দেহ নেই।
কোন জায়গায় স্বচ্ছতা আছে কেউ কি আঙ্গুল উচিয়ে দেখাতে বা জোর গলায় বলতে পারবে? আমরা যত কথাই বলি এর কোন পরিবর্তন হয় না। এই জন্যই বলে চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। সাধারন মানুষ অধিকার আদায়ে যতক্ষণ সোচ্ছার না হয়,ততক্ষণ তাদের ভাগ্যের লিখন যায়না খন্ডন।
অসাধু চোর স্বেচ্ছায় সাধু না হয়ে বিপদে পড়ে আদালতে গিয়ে সাধু সাজার প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করে বিচার থেকে কোন মতে মুক্তি পেলেই আবার পুর্বের পেশায় লিপ্ত হয়।
নৈতিক পরিবর্তনের জন্য চাই নৈতিক শিক্ষা। দলমত নির্বিশেষে মিথ্যা বলা যদি রাজনৈতিক কৌশল বা চর্চা হয়,সেখানে সত্যিকারের সত্য বলতে আর কিছুই থাকে না। রাষ্ট্রের শিক্ষা যখন রাষ্ট্রের অযোগ্যতার কারনে বাণিজ্যকরণ বা লম্পটের হাতে বিক্রি হয় সেখানে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত হওয়া ছাড়া নৈতিক শিক্ষার আশা করা গুড়ে বালি মাত্র।আর এসব রাষ্ট্রের জন্য বড় সিদ্ধান্তে পরিনত হয়। বিষয়টি যদি সুপরিকল্পিত একটি মৃৎসুদ্ধি আমলা তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার নির্ভর হয় তখন ভাল কথাও পাগলের প্রলাপ হয়ে যায়। আর তখনই দেশ ভবিষ্যতে সংকট থেকে গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হবে। সংকট ধরে চিকিৎসা না হলে রাষ্ট্রীয় রোগ কখনই মুক্ত হবে না। বরং সেক্ষেত্রে দেশ সংকট থেকে গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হবে। সংকট ধরে চিকিৎসা না করলে রাষ্ট্রীয় সংকট বা রোগ কখনই মুক্ত হবে না বরং ক্ষত থেকে ক্যান্সারের সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক।
এদেশের সাধালন মানুষ থেকে কৃষক,বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রমিক ,তাতী জেলে কামার কুমার ক্ষেত মজুর ইত্যাদি ক্ষুদ্র পেশার লোকজন ইতিহাসে কখনই ভুল করেনি। বরং কতিপয় কলঙ্কিত শিক্ষিত নামধারী টাউট,বাটপার,ঠিকাদার ও রাজনীতিবিদরা যুগ যুগ ধরে এদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই পুঁজিবাদ শ্রমিক শ্রেণীর পিছে ধাওয়া শুরু করে আর এদের সঙ্গে সহায়ক অস্ত্র হিসাবে যোগ হয় ছদ্মবেশী গণতন্ত্র,বিশ্ব ব্যাংক,বিভিন্ন আঞ্চলিক ব্যাংক,আইএমএফ,দাতা গোষ্ঠী,এনজিও,জাতিসংঘ ইত্যাদি।
১৯৯০ সালের শুরু থেকে রাশিয়া পতনের পর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ব্যাংক দায়বদ্ধ রাষ্ট্রায়াত্ত শ্রমজীবি কারখানা গুলো রাতারাতি বিরাষ্ট্রীয় করণ করে শ্রমিক শ্রেণীকে বেকার বানিয়ে মেরুদন্ডহীন করে ঘরে বসায়,যাতে পুনরায় শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতি দাড়াতে না পারে। এরপর থেকে পুঁজিবাদের চেষ্টায় নতুন আঙ্গিকে ভ্রাম্যমান শিল্পের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীকে খোলসধারী গণতন্ত্রের পদপৃষ্টে নতজানু করার ব্যবস্থা করে রাখে আর এ ব্যাপারে পশ্চিমা নামধারী ক্লাব ‘‘জাতিসংঘ’’ পুঁজিবাদের অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।
পক্ষান্তরে নিষ্পাপ শ্রমিক শ্রেণীকে কলঙ্কিত করে পুঁজিবাদ সমর্থিত তৎকালীন সংকারের কিছু মন্ত্রী,সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রায়াত্ব কারখানাগুলোকে সস্তায় পানির দরে রাষ্ট্রীয় প্রনোদনায় হস্তগত করে ব্যক্তি কারখানার মালিক হয়ে পুনরায় বিশদ উপায়ে কারখানা চালু করে।রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সেই লোকটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল ,যে চিকিৎসা নিতে পারেনা,কে দেয় তাকে চিকিৎসা?যে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়না,কে দেয় তাকে পুষ্টি জ্ঞান? এভাবে কে দেয় তাকে সামাজিক মর্যাদা? কে দেয় তাকে ন্যায্য বিচার? এই ধরনের হাজারো প্রশ্নের উত্তর থেকে আড়াল হচ্ছে প্রতিদিনের সেবার মুখ।
যুগে যুগে জমিদার,সুদখোর মহাজন,পুর্তগীজ,ওলন্দাজ,ফরাসী,ইংরেজ,পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অধিকারের জন্য লড়াই করে আজও তারা দিশেহারা হয়ে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর অন্ধকারে সাধারণ মানুষকে ঢেকে রাখার জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শিক্ষাকে করেছে কলুষিত।
যেখানে রাষ্ট্রের মন্ত্রীবর্গের অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতার কারনে সত্য কাজটাকে ঢেকে জনসাধারণের মাঝে মিথ্যা প্রচার বা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় সেখানে সুশিক্ষা বা সত্যের প্রতিষ্ঠা কোন কালেই সম্ভবনা।
ইতিহাস নৈতিকতা,অধিকার ,শিক্ষা-সংস্কৃতি সার্বজনীন। তা একক কোন দল বা গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ নয়। আর একক কোন দল বা গোষ্ঠী যদি এসব শুধু তাদের ইচ্ছামত প্রতিষ্ঠা করে তা হবে ফ্যাঁসিবাদী আচরণ। ইতিহাসে ফ্যাঁসিবাদী আচরণ কখনই স্থায়ী হয়নি আর কখণও হবেই না।
বাংলাদেশী পরিকল্পনা এবং অর্থনীতির মধ্যে যথাযোগ্য সমতা পরিষ্কার অর্থে শুন্যেে কোঠায় অবস্থান করছে।
একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী আর্থিক উন্নয়ন সব সময়ই ভাবনা চিন্তার বাইরে থেকে যায়। চাহিদার তুলনায় কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে কারখানার প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় উৎপাদন খুবই অপ্রতুল এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
পক্ষান্তরে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশে উৎপাদনের বিপরীতে দিনের পর দিন আমদানী নির্ভরশীল হয়। অপ্রতুল ভ্রাম্যমান শিল্পের কারনে রাষ্ট্রের মুল অর্থনীতিও বহির্বিশ্বের উপর স্থায়ী নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
অস্থায়ী উৎপাদন থেকে স্থায়ীকরণের জন্য টেকসই যে পরিকল্পনার দরকার এবং তার উপর জমানো অর্থের সঠিক,সুষম প্রয়োগের পরিবর্তে বৃহৎ অংশই অনুৎপাদনশীল খাতে যত্রতত্র ব্যবহার করে নগদ টাকার অপচয় করে এবং পুঁজিবাদের গর্ভে চলে যায়। এর অবসান না হলে কোন দিনই গড় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দরিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়।
ওভার ব্রীজ,কথিত মেট্রোরেলের পিছনে ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অনুকরণে রাজধানী ঢাকা সিটির যানজট নিরসনের নামে সৌন্দর্য্য বর্ধণ একটি তৃতীয় বিশ্বের বৃহৎ জনবহুল রাষ্ট্রের জন্য প্রকৃত অর্থে কতটুকু যুক্তিসঙ্গত সকলে একবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। বরং যানজট নিরসনে সারাদেশ ব্যাপী গ্রামীণ পর্যায়ে অথবা প্রতিটি জেলা পর্যায়ে শিল্পনীতি বাস্তবায়ন করা হলে একদিকে যেমন দারিদ্র বিমোচনসহ সমগ্র বাংলাদেশে অর্থনৈতিক একটি সাম্যতা ফিরে আনা সম্ভব। অন্যদিকে ওভার ব্রীজ,মেট্রোরেলের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসবে এবং ব্যয়ের টাকা স্থায়ী উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে এবং ঢাকা শহর যানজটমুক্ত হবে।
একটি মিথ্যাকে ঢাকতে হলে কমপক্ষে দশটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। মিথ্যা এবং অন্যায় সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণ মানুয় বার বার ক্ষতির স্বীকার হয়ে আর বেলতলা যেতে চায়না। প্রকৃত সংকটকে মিথ্যা দিয়ে নয় বরং সত্যকে সত্য দিয়ে মোকাবেলা করে স্থায়ী এবং টেকসই সমাধান সম্ভব। তাতে দল এবং রাষ্ট্রের সুনাম বৃদ্ধি পায়।
@লেখক,সাংবাদিক,গবেষক
ইমেইল-news.asianbangla@gmail.com