নুরনবী মিয়া, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি:
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে কৃত্রিমভাবে সামুদ্রিক শৈবাল (স্পিরুলিনা) চাষের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন উপজেলার ৭ জন উদ্যোক্তা। নিজেদের বেকারত্ব ঘোচাতে তারা যৌথ উদ্যোগে ফুলবাড়ী এগ্রো নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। তারই একটি হচ্ছে কৃত্রিমভাবে স্পিরুলিনা চাষ। এতে তারা স্বপ্ন দেখছেন নিজেদের ভাগ্য বদল ছাড়াও বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে অধিক লাভবানের আশা তাদের।
স্পিরুলিনা নামটি অনেকের কাছে অপরিচিত। স্পিরুলিনা হলো সাইনো ব্যাকটেরিয়া। এটি অতি ক্ষুদ্র নীলাভ সবুজ শৈবাল যা সূর্যালোকের মাধ্যমে দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে। বাংলাদেশে স্পিরুলিনাকে গ্ৰিন ডায়মন্ড বলা হয়ে থাকে। প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ প্রকৃতির আশ্চর্য এই খাবারটি অনেকে সামুদ্রিক শৈবাল হিসেবেই চেনেন। শক্তিবর্ধক এই সম্পূরক খাদ্যটি বর্তমানে কৃত্রিম জলাধারে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে।
গতকাল শনিবার বিকেলে উপজেলার প্রাণকৃষ্ণ গ্রামে যৌথ উদ্যোক্তাদের একজন এরশাদ হোসেনের বাড়ির বাইরের উঠোনে গিয়ে দেখা যায় উঠান জুড়ে তৈরি করা হয়েছে একটি গ্রিন হাউস। গ্রীন হাউসের ভেতরে ১৮ হাজার লিটার পানি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন দুটি হাউজ করা আছে। হাউজের পানিতে রয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল (স্পিরুলিনা)। নতুন হিসেবে এবারে তারা ২৪ হাজার লিটার পানিতে স্পিরুলিনা চাষ শুরু করেছেন। সেখানে অক্সিজেন সরবরাহ চলছে অনবরত। অন্যদিকে পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে ছাকনি দিয়ে তিনজন মিলে হারভেস্টিং পদ্ধতিতে শৈবাল আলাদা করছেন। এসব প্রক্রিয়াকরণ হলেই বাজারজাত করা হবে।
উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পরিচালক মাসুদ রানা বলেন, গ্রীন হাউজ থেকে শুরু করে সবকিছুই তাদের নিজেদের তৈরি করা। গত ১১ মার্চ ২০২১ সেখানে স্পিরুলিনার মাদার কালচার ছাড়া হয়েছে। প্রতি কেজি মাদার কালচার সরবরাহ করতে সাড়ে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এক বছরের জন্য মেডিসিন ক্রয় করতে ব্যয় হয়েছে ৪২ হাজার টাকা। প্রজেক্ট শুরু করা থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। গত ৫ এপ্রিল থেকে স্পিরুলিনার আহরণ শুরু হয়েছে। প্রতি হাজার লিটারে সপ্তাহে গড়ে ১ কেজি করে পিওর স্পিরুলিনা উৎপাদন হচ্ছে। যার প্রতি কেজি পাইকারি বাজারজাত মূল্য বর্তমানে ছয় থেকে আট হাজার টাকা।
যৌথ উদ্যোক্তাদের একজন এরশাদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে স্বল্প পরিসরে স্পিরুলিনার চাষ শুরু হয়েছে। আমরা ২৪ হাজার লিটার পানিতে কৃত্রিমভাবে স্পিরুলিনার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছি। বর্তমানে দেশে এটিই সর্ববৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্র। দেশের বাজারে স্পিরুলিনার চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। সে বিবেচনায় দেশে স্পিরুলিনার বাণিজ্যিক উৎপাদন নেই। স্পিরুলিনার চাহিদা মেটাতে দেশের নাম করা ঔষুধ কোম্পানি গুলোকে বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে স্পিরুলিনার চাষ হলে আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে। বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
উদ্যোক্তা জাকির সরকার বলেন, অনেক জিনিসই বিদেশ থেকে আমদানি করে আমাদের দেশের চাহিদা মেটাতে হয়। আমরা চাই দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করে বেকার সমস্যার সমাধান করতে। বেকার যুবকরা চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই উদ্যোক্তা হলে একদিকে যেমন আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় অপরদিকে আর্থিকভাবেও সচ্ছলতা ফিরে আসে। এবার লাভবান হলে আরও বড় পরিসরে করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।
ফুলবাড়ি এগ্রো প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক সেলিম রেজা। তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পিরুলিনার উপর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তিনি জানালেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ প ম জামাল উদ্দিন স্যার স্পিরুলিনার প্রসারে নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করে সহায়তা করছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে স্পিরুলিনা উৎপাদন করে এ প্রজেক্টে এগারো লক্ষ টাকা আয় হবে বলে ধারণা করছেন তারা।
প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ ও একাধিক খনিজ পদার্থ থাকায় অনেকে স্পিরুলিনাকে সুপার ফুড বলে থাকেন। এটি মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। প্রচুর ভিটামিন, লৌহ ও নীলাভ সবুজ রং থাকার কারণে স্পিরুলিনায় রয়েছে নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধের উপাদান। সাধারণ খাদ্য হিসেবে ও নানা রোগ নিরাময়ে মুল্যবান ভেষজ হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্বাদ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন স্পিরুলিনা নিয়মিত সেবনে বিশেষ করে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে। পুষ্টিহীনতা ছাড়াও রক্তশূন্যতা, রাতকানা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, বাত, হেপাটাইটিস ও ক্লান্তি দূরীকরণে বেশ উপাদেয়। বিসিএসআইআর-এর বিজ্ঞানীরা ৬০ জন আর্সেনিকোসিস রোগীর উপর স্পিরুলিনা নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে স্পিরুলিনা খাওয়ালে প্রায় ৪ মাস পর রোগী সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠে।