সঞ্জিত দাস; বাগেরহাট প্রতিনিধি :
এলাকার বাসিন্দা রুমানা বেগম বলেন, ঘরে পানি বাইরে পানি। বাচ্চাদের নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকি। কখন না জানি কোন বিপদে পরি ! সাপ, জোঁক, কেঁচোর উৎপাত তো আছেই। রাতে ঘুমোতে ভয় লাগে। চুলায় পানি জমে থাকায় রান্না করার কোনো উপায় নাই। কিযে দুর্বিসহ জীবন। তা বলে বোঝানো যায় না। এমন ভয়, আতঙ্ক আর চাপা কষ্টের কথাগুলো প্রকাশ করেন দুই সন্তান নিয়ে পানিবন্দী অবস্থায় থাকা প্রবাসীর স্ত্রী রুমানা বেগম নামের এক গৃহিনী।
সারেজমিনে দেখা যায় শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা সরকারি পাইলট হাইস্কুলের পেছন থেকে খাদ্য গুদাম পর্যন্ত এই এলাকার মধ্যে বসবাসকারি প্রায় তিন শতাধিক পরিবার প্রায় এক মাস ধরে রুমানা বেগমের মতো এভাবে পানিবন্দী অবস্থায় আছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের বৃষ্টিতে তৈরি হয় এ জলাবদ্ধতার । এর পর কয়েক দফা বৃষ্টি হওয়ায় এখন এলাকাটি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রেখে রায়েন্দা শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণের ফলে এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আগে একটি ড্রেন থেকে এলাকার পানি নেমে যেতো খালে। কিন্তু বাঁধ দেওয়ার কারণে ওই ড্রেনটি সম্পুর্ন রুপে বন্ধ হয়ে গেছে।
মঙ্্গল বার দুপুরে সরেজমিনে জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মানুষ ঘর থেকে বহিরে যেতে পারছে না। ঘরের মধ্যেও পানি জমে আছে। বাইরের পায়খাগুলো পানিতে তলিয়ে রয়েছে। মল-মূত্রের পানিতে সবদিক একাকার। পঁচা দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। সাভাবিক কাজকর্ম-চলাচলও করতে পারছে না মানুষ।
এসময় এলাকার ফারুখ খান জানান, তার ঘরের মধ্যে হাঁটু পানি। রান্না বন্ধ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। এ অবস্থায় স্ত্রী-সন্তানদের তিনি শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। রহিমা বেগমকে দেখা যায় দুপুরের রান্না করছেন। চুলার মধ্যে যাতে পানি না ঢোকে সেজন্য চুলার চারপাশে মাটির বেড়ি দিয়েছেন।
ওই এলাকার বাসিন্দা মিলন হাওলাদার, হিরু হাওলাদার ও রফিক খান জানান, তাদের প্রত্যেকের ঘরে ছোট ছোট বাচ্চা রয়েছে। ঘরের বাইরে কোমর সমান পানি। বাচ্ছাদের নিয়ে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। বেখায়ালে কখন না জানি দুর্ঘটনা ঘটে যায়! ঘরের মধ্যে কেঁচো কিলবিল করে। পানিতে তলিয়ে থাকায় পায়খানায় যাওয়ারও কায়দা নেই। পঁচা পানিতে নামলেই চুলকানি শুরু হয়ে যায়।
এছাড়া রায়েন্দা সরকারি পাইলট হাইস্কুলের শিক্ষক মো. ওমর ফারুকসহ ভুক্তভোগী ইব্রাহিম বিন আব্দুর রশি, খলিল খান, শহিদুল খান ও হালিম খান বলেন, শুধু এবছর নয়, এভাবে আমাদের বছরের পর বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন-জনপ্রতিনিধি কেউই এব্যাপারে স্থায়ী সমাধানের কোন উদ্যোগ নেয়নি। একটি ড্রেন থেকে পানি নামতো। তাও বেড়িবাঁধের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমাদের পঁচা পানিতে ডুবে মরতে হচ্ছে। গত ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর প্রায় এক মাস ধরে আমরা এই এলাকার তিন-চারশ পরিবার পানিবন্দী রয়েছি। অথচ আমাদের দুর্ভোগ লাঘবে কেউ এগিয়ে আসছেনা। এভাবে জলাবদ্ধ অবস্থা থাকলে এলাকায় পানিবাহিত রোগ-ব্যাধি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই।
এ ব্যপারে যানতে চাইলে রায়েন্্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন বলেন, উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) আওতায় নির্মিত এই রায়েন্দা শহর রক্ষাবাঁধে পানি নিষ্কাশনের জন্য ১০টি ড্রেন করার কথা। প্রকল্প সংশ্লিদের বার বার বলার পরও তা করছে না। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পাইপ বসিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যবস্থা করা হবে।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরদার মোস্তফা শাহিন বলেন, জলাবদ্ধতার জন্য বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের লোকেরা দায়ী । ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমাধান করে তবেই বাঁধের কাজ করা উচিৎ ছিল। এব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এব্যপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয় বোর্ডের (বাপাউবো) উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসে বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ‘সিএইচডব্লিউই’ নামের চায়নার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান শরণখোলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধসহ রায়েন্দা শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করছে। কাজের প্রায় ৮০ ভাগ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বর্ষা মৌসুম চলছে। বর্ষার তিন মাস কোনো কাজ হবে না। ঠিকাদার কোম্পানির লোকেরা কাজ বন্ধ করে অনেকেই চায়না চলে গেছে। তার পরও যারা আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।