মোঃ নুরনবী ইসলাম, খানসামা (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : মানুষের জীবনে চলার পথে আসে নানা ধরনের বাধা। কিন্তু তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে? অনেকেই আছেন যারা সব বাধা মোকাবেলা করে এগিয়ে যান সামনের দিকে।
অর্জন করেন সফলতা। হয়ে উঠেন একজন সংগ্রামী জয়িতা।

নিজের অদম্য মনোবল সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করেন। দিনাজপুরের খানসামায় এমনই তিন নারী যারা সব ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সফল হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সমাজে “জয়িতা” নামে।

গত ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষ্যে খানসামা উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে উপজেলায় তিনটি ক্যাটাগরিতে তিনজন নারীকে জয়িতা নির্বাচিত করে তাদের পুরস্কার ও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল।
সফল জননী হিসেবে মোছাঃ হোসনেআরা, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী শৈল বালা রায় এবং নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন প্রতষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে মোছাঃ সুফিয়া খাতুন জয়িতা নির্বাচিত হোন। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মহিমায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই জয়িতাদের জীবনের গল্প শুরু অনেক দুঃখ কষ্ট ও অভাব অনটনের মধ্যে। প্রতিটি ক্ষণে বেড়ে উঠেছেন সংগ্রাম করে। সংসার, স্বামী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অতি দুঃখ কষ্টে তাদের দিন কাটাতে হয়েছে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে তারা বিভিন্নভাবে ছুঁয়েছেন সফলতার স্তর।

আমি ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। ৯ম শ্রেণি সমাপনি পরীক্ষার পর বাবা আমাকে বিয়ে দেন। আমরা ৮ ভাই বোন। আমার বাবা দারিদ্রতার কারণে আমাকে লেখাপড়া করাতে পারেন নাই। ফলে বাবা আমাকে বাল্য বিয়ে দেন। আমার স্বামী একজন বেকার। বসত ভিটে ছাড়া তার আর কোন জমি নাই। অতি দারিদ্রতার মধ্যে আমি সংসার জীবন শুরু করি। আমার ছেলে ও মেয়ে মিলে দুই সন্তান । পরবর্তীতে উপজেলা মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় হতে দর্জি বিজ্ঞান বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করি। প্রশিক্ষণ শেষে অতি কষ্টে অর্থ সংগ্রহে সেলাই মেশিন ক্রয় করে নিজ বাড়ীতে পোশাক তৈরীর কাজ শুরু করি। সেলাই কাজে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা চালিয়ে যাই। বর্তমানে আমার ছেলে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মেঘনা ওয়েল লিঃ কোম্পানিতে সহকারী ম্যানেজার (আইটি) পদে চাকুরী করছে এবং একমাত্র মেয়েকে স্নাতক পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করব। অনেক কষ্ট করে হলেও মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি আমার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষ করতে পেরেছি। আমার সংসারে এখন আর কোন কষ্ট নাই। আমি বর্তমানে সন্তানাদি নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন-যাপন করছি। এভাবেই খানসামা উপজেলার গোবিন্দপুর বানিয়াপাড়ার মোঃ মহিউদ্দীন সরকারের স্ত্রী সফল জননী নারী মোছাঃ হোসনেআরা তার জীবন-যুদ্ধের কথাগুলো বলেছিলেন।

এদের মধ্যে অপর একজন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী জয়িতা শৈল বালা রায়। বাড়ি উপজেলার পাকেরহাট মাস্টারপাড়ায়। স্বামী মৃত যোগেশ কোয়ালী। তার দুই ভাই ছিল। তার ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার ১২ বছর পর ৩ জন সন্তান রেখে তার স্বামী মারা যায়। তখন সন্তানদের বয়স ছিল যথাক্রমে ১০, ৭ ও ৩ বছর বয়স। এই ছোট্ট শিশুদের রেখে হঠাৎ তার স্বামীর মৃত্যু হলে, সে হতাশায় পড়ে। কেন না তখন সে ভাল করে হিসাব-নিকাশ করতে পারতো না।তার স্বামীর মৃত্যুর পর ভাসুর, দেবর কেউ কোন প্রকার সহযোগিতা করত না। বরং বাচ্চাদের ভাত খাওয়ানোর জন্য তাদের ঘরে গেলে, তারা ভাত দিত না। উপরšুÍ নানা ভাবে নির্যাতন করতো। তার সন্তান সহ তাকে বাড়ী থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করত। তার উপর চলত বিভিন্ন প্রকার চক্রান্ত ও অত্যাচার। এমন অবস্থায় সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে কখনো দিনমজুর, কখনো রাজ মিস্ত্রীর সাথে যোগালী, কখনো চাতালে ধান ঝাড়া, ধান শুকানো আবার কখনোবা অন্যের বাড়ীতে থালা বাসন ধোয়ার কাজসহ নানা প্রকার কাজ করত। এর মধ্যে কেয়ার বাংলাদেশ প্রকল্প থেকে মাটি কাটার কাজে যুক্ত হয়। সেখানে মাসিক বেতনে কাজ করত এবং সেই বেতনের কিছু টাকা জমা রাখত। ৫ বছর সেখানে মাটি কাটার কাজ শেষ হলে জমানো টাকা পেয়ে তাদের পরামর্শ মোতাবেক ১৫ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ীতে একটি ছোট দোকান চালু করে। এত কষ্টের মধ্যেও সে তার সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যায়। বড় ছেলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং ছোট ছেলে এইচ.এস.সি পাশ করে বর্তমানে ব্র্যাক এনজিওতে চাকরি করছে। বাড়িতে ৩ বছর দোকান চালানোর পর কিছু টাকা পুঁজি হলে পাকেরহাট আঙ্গারপাড়া রোডে একটি ছোট টিনশেডের দোকান চালু করে। এর মধ্যে মেয়ে বড় হলে নিজের টাকা ও আতœীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে মেয়ের বিয়ে দেয়। দোকান চালুর ৫/৬ বছরের মধ্যে ছোট ছেলের একবার মাথায় সমস্যা হলে ঐ সময়ে ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ করে ছেলেকে সুস্থ করে। দোকানের সামান্য আয় থেকে ছেলে-মেয়েদের সকল চাহিদা পূরণ করত। প্রায় ২০ বছর ধরে দোকান করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে তার দোকানে একটি বড় ডিপ রেফ্রিজেটর, একটি রঙ্গিন টেলিভিশন সহ পাকা দোকান ঘর ভাড়া নিয়েছে। তার এই সফলতা দেখে তার প্রতিবেশিদের মধ্যে ৮/১০ জন দোকান চালু করেছে। অনেক লোক বিভিন্ন ধরনের খারাপ কথা বললেও সে দোকান চালিয়ে যাচ্ছে। এখন তার বাড়ি ঘর ভাল করা হয়েছে। মোটামুটি স্বচ্ছল ভাবে জীবন-জীবিকা করছে। ভূমিহীন সংগঠনের একজন সদস্যও অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী জয়িতা শৈল বালা রায়।

আর একজন হলেন মোছাঃ সুফিয়া খাতুন। সে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর জন্ম নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। দুই ভাই বোনের মধ্যে সে ছোট। সে খানসামা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি এবং খানসামা মহিলা কলেজ হতে এইচএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশের পরই গত প্রায় ৭ বছর আগে সম্পর্ক করে একটি ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর হতে সে তার স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হত। বিয়ের ২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই আবার তার স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এরপর তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তাকে বাড়ি হতে বের করে দেওয়া হয়। সে তখন বাবার বাড়িতে ফিরে এসে বাবা-মাকে নির্যাতনের সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। পরবর্তীতে সে আবারও কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করে। সে সম্পর্ক করে বিয়ে করায় তার বাবা পড়াশোনার খরচ চালাতে আগ্রহী ছিলেন না। তাই সে পড়াশোনার পাশাপাশি উপজেলা মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় হতে দর্জি বিজ্ঞান ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর সেলাই মেশিন কিনে পোষাক তৈরির কাজ শুরু করে। পোশাক তৈরির কাজে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তার পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি নিজেকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। বর্তমানে সে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার্থী। এছাড়াও সে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন ও বাল্য বিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন বিরোধী সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে নিয়মিত অংশগ্রহন করেন।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রমটি একটি ভালো কার্যক্রম। উপজেলার বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা এই ৩ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতার জীবন কাহিনী পড়ে আমাদের নারী সমাজ উৎসাহিত হবে এবং এভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন হবে বলে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছাঃ ফারজানা ইয়াসমিন জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *