নাগেশ্বরী প্রতিনিধি

 কালের স্বাক্ষী হয়ে ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে সন্ন্যাসীদের আশ্রয়স্থল ভবানী পাঠকের মঠ। মঠটি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কাচারী পয়রাডাঙ্গা এলাকায় নির্মিত। কেউ কেউ এটাকে শিবমন্দির, কামাক্ষ্যা মাতা ঠাকুরনী মন্দির আবার কেউ কেউ এটিকে জয় দূর্গাদেবী চৌধুরানীর আস্তানাও বলে থাকেন।

তবে স্থানীয়দের কেউ কেউ এটাকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সন্ন্যাসীদের আশ্রয়স্থল জানলেও বেশিরভাগ মানুষ এটাকে মন্দির হিসেবেই জানেন এবং একটা সময় এলাকাবাসী সেখানে পূজা অর্চণা করলেও কত সনে এটি নির্মিত হয়েছিল তা জানা নেই স্থানীয়দের। অনেকেই এটাকে ব্রিটিশ আমলের বললেও কেউ কেউ এটাকে ব্রিটিশদেরও পূর্বের নবাবী আমলের বলে ধারণা করে থাকেন।

কুড়িগ্রাম জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ সুত্রে জানা যায়, ১৭৭০ থেকে ১৭৭২ সালের মধ্যে এই শিব মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। ঐ সময় ফকির আন্দোলনের নেতা মজনু শাহের সহযোগী ভবানী পাঠক শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেন। ভবানী পাঠক ছিলেন রংপুরের পীরগাছা এলাকার মন্থনার জমিদার জয় দূর্গাদেবী চৌধুরানীর নায়েব। ভবানী পাঠকের বাড়ি ছিল কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার পাঠক পাড়ায়।

ইতিহাস গ্রন্থ সুত্রে আরো জানা যায়, ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধের পর এই মন্দির থেকেই ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সন্ন্যাসীরা। এজন্য এটিকে ভবানী পাঠকের মঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাগেশ্বরী উপজেলার কাচারী পায়রাডাঙ্গা গ্রামে কুড়িগ্রাম-সোনাহাট স্থলবন্দর মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে অবহেলায়-অযত্নে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এই মন্দিরটি। মন্দিরের দেয়ালকে ভেদ করে ছাদের উপরে মেলে আছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের ডাল-পালা। ক্ষয়ে গেছে দেয়ালের প্রাচীন আমলের ইটও। মন্দিরের ভিতরে রাখা আছে দেব-দেবীর মুর্তি। কিন্তু যেকোন সময় মন্দিরটির অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে এখন আর তেমন পূজা অর্চণা করছেন না স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজন।

সেখানকার স্থানীয়রা জানায়, আজ থেকে বহু বছর আগে সে সময়কার স্থানীয়রা জঙ্গলের ভেতরে থাকা এই মন্দিরটিতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসীদের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত হন এবং তাদের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে পরবর্তী প্রজন্মরা অবগত হয়ে আসেন। তারপর থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষজন সেখানে পূজা অর্চণা করে আসছেন। তবে সংরক্ষন ও সংস্কারের অভাবে বর্তমানে প্রাচীন এই মন্দিরের বেহাল দশা। প্রায় ভঙ্গুর অবস্থার এই মন্দিরটিতে লোকজন আর প্রবেশ করেন না।

স্থানীয় নিতাই চন্দ্র সরকার জানান, এই মন্দিরটি বহু যুগ ধরে এ অবস্থায় পড়ে আছে। আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শুনেছি এটা নাকী দেবী চৌধুরানীর আখড়া ছিল। তেনারা হয়তোবা তেনাদের বাপ দাদার মুখ থেকে শুনেছেন। সন্ন্যাসীরা এখানে অবস্থান করে ধর্মীয় কার্য সহ পূর্জ-অর্চণা করতেন। আমরাও এক সময় এই মন্দিরটিতে পূজা অর্চনা করতাম। তবে মন্দিরের এই ভঙ্গুর দশার কারনে এখন পূজা অর্চনা হচ্ছে না। এটি সংস্কার হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরা ধর্মের প্রতি আরও অনুকরণীয় হতো।

স্থানীয় শিক্ষার্থী চঞ্চল চন্দ্র সরকার বলেন, অনেক পুরনো এই মন্দিরটি সরকারীভাবে সংস্কার করা হলে এখানে ভালোভাবে পূজা করা যেত। অনেক মানুষ এখানে আসত। এটির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারত। আমরা এই মন্দিরটি সংস্কারের জোড় দাবী জানাচ্ছি।

নাগেশ্বরীর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, অনেকেই ধারনা করে বলেন ভবানী পাঠকের এই মঠটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। কিন্তু আমি আমার বাবার কাছে শুনেছি এবং বিভিন্ন বই পুস্তক পড়ে ধারণা করি এটি ব্রিটিশ আমলের পূর্বেও নবাবী আমলে নির্মিত। কবি বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখনীতেও উঠে এসেছিল এই মঠটি। এই মঠে অবস্থান করে সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করেছিলো। এখানে অনেক এতিমদের প্রসাদ খাওয়ানো হতো। এবং তৎকালীন জমিদার ও উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব বিনোদরাম তর্কালঙ্কার পরিব্রাজক হিসেবে এসে এই এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু আফসোসের বিষয়, সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে বিলুপ্তির পথে ভবানী পাঠকের এই মঠটি। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই মঠটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আগামী প্রজন্ম জানবে না ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালনকারী এই মঠটি সম্পর্কে।

ভবানী পাঠকের মঠ/শিবমন্দিরটি সংরক্ষন ও সংস্কারের ব্যাপারে নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আহমেদ মাছুম ‘র সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি।আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। এই মন্দির যদি অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করে তাহলে অবশ্যই সংস্কারের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন