নাজমুল হুদা পারভেজ (চিলমারী ) কুড়িগ্রামঃ-
বাজান আমার বিয়া ঠিক করলো। বাজানরে বাধা দিলাম। কইলাম ,বাজান আমি অহনই বিয়া করুম না, খো পড়া করুম। বাজান হুনলো না। উল্টা কামারে কইলো, করোনা যাইবো না, স্কুলও আর খুলবো না। বেকার বাড়িতে তোরে বইয়া বইয়া আমি পালতে পারমুনা। ভালা ছেলে পাইছি,তোরে বিয়া দিয়া দিমু। হেরপর আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়া দিয়া দিছে। তয় আমার বর আমারে কইছে হেই আমারে পড়াইবো। বাজানো ক্ইছে, বিয়ার পর পইরো। শ্যাষে বাজানের মুকের দিকে তাকাইয়া রাজি হ্ইলাম। রাজী না হইয়া কোন উপায়ও আমার আছিল না।- কথাগুলি বলছিল- কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার অষ্টমীরচর ইউনিয়নের নটারকান্দি গ্রামের মোঃ আরদোশ আলীর মাধ্যমিক স্কুল পড়ুয়া নাবালিকা কন্যা আর্জিনা আক্তার। আর্জিনা আক্তার নটারকান্দি কান্দি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী।

উক্ত স্কুল ছুটির পর ব্রহ্মপুত্র নদী পাড়িয়ে নিজ বাড়ি ফিরার জন্য স্কুলের বন্ধু ও বান্ধবীদের সাথে আর্জিনা আক্তারও খেয়ার নৌকায় উঠেছে। মাথার উপর তখন তীব্র রোদ। দুপুর গড়িয়ে গেছে। পাড়ের খোয়াতেই ওর সাথে কথা হয়। আর্জিনা আরও জানায়, নটারকান্দি গ্রামের সাবের উদ্দীনের পুত্র মোঃ মোমিনুল ইসলাম মমিনের সাথে তার বিয়ে হয়েছে করোনা কালীন সময়ে। মোমিন ঢাকার উত্তরায় পঙ্গু হাসপাতালে চাকুরি করে। নৌকায় কথা হয়, ২০২১ ইং সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী মোঃ আলামিনের সাথে। সে জানায় করোনার সময় মোবাইলে কথা বলতে বলতে তার এক বান্ধবীর সাথে প্রেম হয়। পরে প্রেম গড়িয়ে বিয়ে। ও জানায়, ঠিক একই ভাবে মোবাইল প্রেম করে একই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী নুর আমিনের বন্ধু সানোয়ার ইসলাম ও বাবলুসহ আরো ৭-৮ জন ছেলের বিয়ে হয়েছে এই করোনা কালীন সময়ে । স্কুলটির নবম ও দশম শ্রেনীর ছাত্রী আমিনা, ঝর্ণা, ইয়াসমিন, বিউটি, সুমি, রুবিনা ও মিনারা সহ বেশ কিছু মেয়েরও বিয়ে হয়েছে মর্মে আর্জিনা আক্তার এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছে।

অবশ্য বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত চিলমারী উপজেলায় বাল্যবিয়ে হয়েছে ১৩৮টি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে ৭০টি। সরেজমিনে এই প্রতিবেদনের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। নটারকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের মোঃ শুকুর মাহমুদ জানান, করোনা কালীন সময়ে তার স্কুলের ৩০ থেকে ৪০ জন ছাত্রী ও ৭ থেকে ৮ জন ছাত্রের বিয়ে হয়ে গেছে। কেন বাল্য বিবাহ হল ?- তা জানতে চাইলে তিনি প্রথমত অভাব বা দারিদ্রতা ও দ্বিতীয়ত মোবাইলকে দায়ী করেন।

করোনাকালে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় বাল্যবিয়ের হিড়িক পড়েছে। গত ১০ মাসে উপজেলার একটি মাদ্রাসার ৭৪ ছাত্রীই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে। ব্রহ্মপুত্রের নজিরবিহীন ভাঙনের শিকার চিলমারীতে দারিদ্র্য এখনও প্রকট। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের তিনটি ইতোমধ্যে নদী ভাঙনে কার্যত বিলীন হয়ে গেছে। বাকি তিনটিরও অর্ধেক গ্রাস করেছে প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র। দারিদ্র্য ও মোবাইল ফোনে প্রেমকেই বাল্যবিয়ের জন্য দায়ী করছেন স্থানীয়রা। মেয়েদের পাশাপাশি স্কুলপড়ূয়া অনেক ছেলেও করোনাকালে বিয়ে করে ফেলেছে।

উপজেলার অষ্টমীরচর, নয়ারহাট ও চিলমারী ইউনিয়ন তিনটি ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা চরাঞ্চলের সমষ্টি। নদীভাঙনে পুরোপুরি বিলীন হয়নি রমনা, থানাহাট ও রানীগঞ্জ ইউনিয়ন। রমনা ইউনিয়নের একটি স্বনামধন্য মাদ্রাসা হলো পাত্রখাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসার সুপার আব্দুল আজিজ আকন্দ সমকালকে জানান, ২০২১ সালে তার মাদ্রাসার মোট ৭৪ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। গত ১৪ নভেম্বর এক চিঠিতে তিনি সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাদের নামের তালিকাও দিয়েছেন।

এ ইউনিয়নের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কড়াই বরিশাল নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে গিয়ে জানা গেছে, করোনাকালে চলতি বছরেই দারিদ্র্যের কারণে স্কুলটির অষ্টম শ্রেণির আরবিনা, তাহমিনা, লাভলী, নুরমনি ও ছুমাইয়া এবং সপ্তম শ্রেণির ঝর্ণা, আশুরা, মল্লিকা, কুলছুমসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।

সরেজমিনে উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ খাউরিয়া স্কুল এন্ড কলেজ এ গিয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী রেখা আক্তার, স্বপন, নবম শ্রেণির ছাত্রী রুমানা, শিরিনা আক্তার, দশম শ্রেণির ছাত্রী শাহানা আক্তার শানু,নবম শ্রেণির ছাত্র শুভ, সুমন মন্ডলসহ অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনাকালীন সময়ে তাদের ক্লাশের নবম শ্রেণির ছাত্রী স্মৃতির বিয়ে হয়েছে একই ইউনিয়নের বাদলের মোড়ে, কবিতার বিয়ে হয়েছে জেলার ফুলবাড়ি উপজেলায় আহম্মদ আলীর দশম শ্রেণিতে পুড়ায় কন্যা সুমনার বিয়ে হয়েছে ঠাকুরের চরে, বাহেছ সরকারের দশম শ্রেণিতে পড়–য়া কন্যা রুমানার বিয়ে হয়েছে চিলমারীতে। ২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী জেসমিনের বিয়ে হয়েছে নটারকান্দি বাজার পাড়ায়। এছাড়াও হাফিজুর ও অঞ্জলীর বিয়ে হয়েছে মোবাই প্রেমের মাধ্যমে। ওরা দুজনই ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী।

এদিকে স্থানীয় প্রশাসন সম্প্রতি চিলমারীর ৩টি ইউনিয়নকে প্রাথমিকভাবে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা দিয়েছে। এর একটি চিলমারী ইউনিয়ন। সম্প্রতি দুর্গম এ ইউনিয়নে সরেজমিন গিয়ে বাল্যবিয়ের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।ই্উনিয়নের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কড়াই্ বরিশাল নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে গিয়ে স্কুলটির অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আয়শা সিদ্দিকা,আক্তারা, জোহরা খাতুন,সুজন মিঞা, সাজু, সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ফাতেমা আক্তার, রণি আক্তার, ফাতেমা (২), মমিনুল ইসলাম এর সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনাকালীন পরিস্থিতিতে দারিদ্রতার কারণে স্কুলটির ৮ম শ্রেণির ছাত্রী আরবিনা,তাহমিনা, লাভলী, নুরমনি,ও ছুমাইয়া এবং ৭ম শ্রেণির ছাত্রী ঝর্ণা,আশুরা, মল্লিকা,কুলছুম ও আরবিনা আক্তারসহ বেশ কয় জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।

চিলমারীর ইউএনও ও উপজেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান গত সেপ্টেম্বরে থানাহাট, রমনা ও রানীগঞ্জ ইউনিয়নকে প্রাথমিকভাবে শতভাগ বাল্যবিমেুক্ত ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারাদেশে করোনার কারণে বিয়ের হার বেড়েছে। তবে তাদের পরিসংখ্যান বলছে, চিলমারীতে বাল্যবিয়ের হার কমেছে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *