কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
নাম শুনে মনে হতে পারে নীল কর সাহেবদের কোন খাস জমি অথবা তাদের রেখে যাওয়া কোন স্মৃতি চিহ্ন কিন্তু এর সাথে লীলকরদের কোন স্মৃতি জড়িত নয়।
বিভিন্ন রকম লিলা খেলার জন্য কালক্রমে এর নাম হয়েছে নীলার খাস। খাসজমিটি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে অবস্থিত। এটি ছিল পাশ্ববর্তী গাওচুলকা বিলের একটি অংশ। বিলের সবচেয়ে গভীর ও রহস্যময়তায় ভরা। বর্তমানে এটি সরকারি খাস খতিয়ান ভুক্ত একটি শান্ত পুকুর। অতিতের কোন ক্ষমতাই এখন আর নাই। তবে প্রাচীন কালে পুকুরটি ছিল এ এলাকার মানুষের মাছের চাহিদা পুরন ও বিয়ে-সাদিতে প্রয়োজনীয় বাসনপত্র প্রাপ্তির স্হান।
স্হানীয় বয়স্কদের কাছে শোনা যায় প্রাচীন কালে এ অঞ্চলের বিয়ে শাদীতে থালা বাসন প্রয়োজন হলে বিলের পাড়ে অবস্থিত একটি নিদিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত জোর করে অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত থালা বাসন চাইলে তা ভেসে উঠে পুকুর পাড়ে একটি নিদিষ্ট স্হানে জমানো থাকতো। সেখান থেকে নিয়ে অনুষ্ঠান শেষে করে আবার ভালো করে পরিষ্কার করে ঐ আগের জায়গায় রেখে আসলে তা আপনা আপনি আবার বিলের গভীরে নেমে যেত।
বিলে বিভিন্ন প্রকারের মাছ যতই ধরা হোক না কেন, মাছ কখনও শেষ হত না। ধনী -গরীব, হিন্দু -মুসলমান সবাই বিলের মাছ মেরে খেত।
বিলের বদ্ধ অংশ হতে খোলা অংশের দিকে মাছ তাড়িয়ে নিয়ে গেলে বেশি মাছ ধরা পড়তো।খোলা দিক থেকে মাছ তাড়িয়ে লিলে কোন মাছধরা পড়তো না।
গোমাংস খেয়ে মাছ ধরতে গেলে সেই ব্যক্তি মারা যেত না হয় কঠিন রোগে আক্রান্ত হতো। একবার বিল সেছে তেমন মাছ পাওয়া গেল না। এরপর চৌত্র মাসের খড়ায় বিলের তলা শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়। পরে বৃষ্টিতে বিল ভরে উঠলে জাল ফেলে আবার প্রচুর মাছ ধরেছেন এলাকাবাসী।
কেউ বলে বিলের এই অংশে মাছের খনি ছিল।
বড় জাল পেতে একদিনে অনেক মাছ ধরতে গেলে জাল ছিড়ে যেত । তবে এলাকার দরিদ্র মানুষেরা খাওয়ার জন্য বিল থেকে মাছ ধরা যেত সব সময়। বোয়াল, শোল, মাগুর,শিং, টোংরা, পুঁটি, চিতল, রুই, কাতল,শাল,খলিশাসহ সব ধরনের মাছ পাওয়া যেত বিলের এ অংশে।
এর পানি সকালে এক রকম, দুপুরে এক রকম ও বিকালে আর এক রকম দেখা যেত। বিলের পাশে বিশাল জঙ্গল ছিল। জঙ্গলের বিভিন্ন রকম জীব জন্তুু দিনের বেলাতেও এসে বিলে পানি পান করতো। শীতে এই অংশে আসতো হাজার হাজার কোরা, কালিম, শল্লী, চখা-চখি সহ নানা ধরনের অথিতি পাখি।
পাখির কলরবে মুখরিত থাকতো গাওচুলকা বিলের এই অংশটি। জম্মাতো প্রচুর পদ্ম,ভেট,পানিফল ও মাখনা। ভেট ও মাখনা খেয়ে অনেকেই ক্ষুধা নিবারণ করতো। এ রকম নানা লিলা খেলার জন্য নাম হয় নিলার খাস।বর্তমানে এ সবের কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
এটি এখন ৭ বিঘা জমির একটি বিশাল শান্ত পুকুর । ৪৭ এর দেশ ভাগের সময় জোতদার বসন্ত কুমার ভারতে চলে গেলে স্থানীয় কিছু মানুষ বিলটি দখলে নিতে চেষ্টা করে।
স্বাধীনতার পর খাল খনন কর্মসূচির আওতায় খনন কাজ শুরু হয়। পরে এলাকার কিছু লোকের বাধার মুখে তা বদ্ধ হয়। সে সময় এটির মালিকানা নিয়ে মামলা হয়। সবশেষ এন্তাজ আলী চেয়ারম্যান এটি সরকারের ১নং খাস খতিয়ানে অন্তভুক্তকরেন। বর্তমানে এটি নীলের খাস নামে মৎস বিভাগের আওতাভুক্ত। জৈনিক আবুবকর বাৎসরিক ৮ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছেন। নীলের খাসের ঐতিহ্য আর কিছু অবশিষ্ট নেই । তবে এর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভয় এখনো অটুট রয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা এখনো নীলের খাসটি দেখতে আসেন। এখনও এর সৌন্দর্য,টলটলে পানি,বিকালে বিল পারের প্রাকৃতিক দৃশ্য মানুষকে আকর্শন করে।
অন্তপুর গ্রামের বিলের পাড়ের সাইদুল রহমান বলেন, আমাদের বাপ-দাদাদের কাছে শোনা এই বিলে বিভিন্ন নীলা খেলার জন্য এর নামকরণ হয় নীলের খাস এবং প্রাচিনকাল থেকেই এটি খাস জমি ছিল। এখান থেকে মানুষ প্রচুর মাছ ধরে খেত । এতো মাছ কোথা থেকে আসতো তা কেউ জানে না। এখনও বিলটি দেখার জন্য অনেক দশনার্থী আসেন। বিলে যাওয়ার রাস্তাটি সংর্কীন হওয়ায়। দর্শনার্থীদের চলাচলে অসুবিধায় পড়তে হয়। কাশিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান ( মানিক) বলেন আমার পৃর্ববর্তী তিন চেয়ারম্যানের প্রচেষ্টায় এটি সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত হয়। তারা এখন বেচেঁ নেই।