রচনা: আব্দুল খালেক ফারুক
ডিবি অফিসের নির্জন কক্ষটিতে একা থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছে ইতুর। কয়েকদিন ধরে কোন আসামীও আসছেনা এই রুমে। শরীর কেমন জানি ম্যাজম্যাজ করে। সব সময় ছিল হাঁটার অভ্যাস। এখন বসে বসে খেয়ে শরীর ভারি হয়ে যাচ্ছে। দু’একবার ব্যায়াম করার চেষ্টা করলেও পাতলা খানের কড়া দৃষ্টির কারণে তা সম্ভব হয়নি। ইনি মনে হয় ব্যায়ামকেও ভয় পান। ট্রেনিং প্রিরিয়ড কী করে উৎরে গেছেন আল্লাহ জানেন।
বিকালের দিকে ওসি বোরহান উদ্দিন এলেন। সাথে আরো কয়েকজন ডিবির সদস্য।
এই দলে একজন এসআই আছেন। ওসি তাকে কেরামত বলে ডাকছেন। ওসির হাতে মোবাইলের কললিষ্ট এগিয়ে দিলেন কেরামত। গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন ওসি। ইতু গত এক মাসে কার কার সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছে তার আদ্যপান্ত রয়েছে এই কাগজটিতে।
তবে কললিষ্ট হাতে পেয়ে আরো বেকায়দায় পড়ে গেছেন ডিবি সদস্যরা। যাদের সাথে ইতু কথা বলেছে তরা কেউ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন। তার মধ্যে রয়েছেন একজন ভিক্ষুক। তার নাম ইসলাম মিয়া। তিনি ষ্টেডিয়াম এলাকায় থাকেন। তার কাছে ইতুর বিষয়ে জিঙ্গেস করেছিল ডিবির এসআই।
ভিক্ষুক একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন—‘কী জন্য তার নাম জিঙ্গেস করেন। ভালো মানুষকেও আপনারা ভালো থাকতে দেন না’।
এরপর ইতুর হায়াত বাড়ানোর জন্য আল্লাহর কাছে লম্বা মোনাজাত শুরু করেন ইসলাম মিয়া। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এসেছেন এসআই কেরামত।
এরপর যার সাথে ইতু কথা বলতো সে একজন ভ্যানচালক। লোকজন তাকে মন্ত্রী হিসেবে চেনে। তার সাথে নাকি কথা হতো আয় রোজগার—ভালোমন্দ নিয়ে। ইতুর ব্যাপারে তার সার্টিফিকেট—‘অতি ভাল লোক’।
মাঝে মধ্যে দেখা যায় একজন যুবতির সাথে কথা বলেছে ইতু। যুবতির নাম তরি। বাবা ব্যবসায়ী। প্রেমট্রেম থাকতে পারে। মেয়েছেলে বলে ওসির নির্দেশে তার কাছে যায়নি এসআই। ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ? তবে সবচেয়ে বেশী কথা বলেছেন যার সাথে সে একজন ছাত্র। সম্ভবত ইতুর বন্ধু হবে। কলেজে তাকে অনুসরণ করেছে গোয়েন্দারা। কিন্তু তার বাসা খঁুজে বের করা সম্ভব হয়নি। শুধু যুবকের নাম জানা গেছে। নাম ইমরুল। মুখে সন্দেহজনক দাঁড়ি।
তবে দাঁড়ির ব্যাপারটা নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন ওসি বোরহান উদ্দিন। যুবক ছেলেদের দাঁড়ি রাখা আজকাল ফ্যাশান হয়ে গেছে। এখন সেলিব্রেটিরা দাঁড়িতে মজে আছেন। এই তালিকায় আছেন বোম্বের নায়ক অভিষেক বচ্চন থেকে ক্রিকেট তারকা বিরাট কোহলি। তবে প্রথম শুরু করেছিলেন শহীদ আফ্রিদি। এখন দাঁড়ি দেখে বোঝার উপায় নাই কে জঙ্গি আর কে লুঙ্গি ড্যান্সের ‘লুঙ্গি’।
‘ইমরুলের সাথে ফোনে এতো কী কথা হয়েছে তোমার’। ওসি এবার মরণকামড় দেয়ার ভঙ্গিতে প্রশ্ন পাড়েন ইতুর কাছে। যেন ভাবছেন— এবার ব্যাটা যাবে কোথায়?
‘ইমরুল আমার বন্ধু। খুব ভাল ছেলে। প্রাইভেট টিউশনি করে চলে। উপরের ইশারায় আমি কিছু জনহিতকর কাজ করি। আমার পকেটের অবস্থা প্রায়ই কেরোসিন থাকে। তাই মাঝেমধ্যে ওর কাছে টাকা ধার করতে হয়।’
‘সে আমাদের নজরদারির মধ্যে আছে?’
‘ওসি সাহেব আমরা সবাই নজরদারির মধ্যে আছি। কে কোথায় কী দাও মারার তালে আছি—তিনি সব দেখছেন।’ এ কথা বলে উপরের দিকে তাকিয়ে একটা অর্থপূর্ণ হাসি দেয় ইতু।
‘আধ্যাত্মিক আলাপ ছাড়। ব্যাটা খুব মৌজে আছো মনে হচ্ছে। দাঁড়াও তোকে চেংগু দেয়ার ব্যবস্থা করছি।’
গোমর ফাঁক হবার চাঞ্জ দেখে ওসি আবার দ্রুত রুম থেকে চলে গেলেন। সাথে ডিবির অন্য সদস্যরাও। তবে একটু পরে জালাল মিয়া এলেন পঁচা পাউরুটি নিয়ে। ডেট এক্্রপায়ার। পাউরুটি হাতে নিয়ে জালালকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করে ইতু।
‘জালাল সাহেব নিজের ছেলেকে প্রতিদিন অলিম্পিকের নাটি বিস্কুট খাওয়ান আর আসামীকে পঁচা পাউরুটি।’
জালাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ইতুর দিকে। বিষ্ময়ের ঘোর কাটেনি তার। এই ব্যাটা কী করে জানলেন— তিনি প্রতিদিন বাসায় ফেরার সময় বাদামে ভরপুর নাটি বিস্কুট নিয়ে যান বাসায়। ছেলেটা এই বিস্কুট খুব পছন্দ করে। ব্যাটার কোন কুদরতি পাওয়ার নাইতো? সেই থেকে জালাল তার ভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করতে চায়না। হাজার হোক আসামীতো।
রাতে ওসি বোরহান উদ্দিনসহ কয়েকজন এলেন ইতুর রুমে। কী উদ্দেশ্যে বোঝা যাচ্ছেনা। আর এক দফা জিঙ্গাসাবাদ করা হতে পারে।
‘স্যার গাড়ি রেডি। একে নিয়ে যাই।’ এসআই কেরামতের এ কথা শুনেই ইতু বুঝে গেল এবার তার সময় ঘনিয়ে আসছে। তাকে সত্যিই ক্রসফায়ার বা বন্দুক যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাচ্ছে এরা। এবার সত্যি ভয় পেল ইতু। বাবা—মায়ের কথা বেশী মনে পড়ল। বোন মিলা আর তরির কথাও মনে পড়ল। ভিক্ষুক ইসলাম মিয়া তাকে নিজের ছেলে মতো দেখেন। তার কথাও খাপছাড়া দৃশ্যের মতো হানা দিচ্ছে চোখের পদার্য়।
কোন কথাই বলার সুযোগ পেলনা সে। তাকে তেমন জিঙ্গাসাবাদও করা হয়নি। কেবল সন্দেহবশত তাকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে দুনিয়া থেকে।
‘স্যার আমার কিছু কথা ছিল। বলা দরকার’
‘তোমার সব কথা শোনা হবে। আগে চলো।’ ওসি বোরহান উদ্দিন একটু তাড়া করছেন মনে হচ্ছে। কোথায় কোন নির্জন যায়গায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। পরিত্যক্ত কোন ইটভাটায়। হয়তো সেখানে গিয়েই বলা হবে পালাও। তারপর পেছন থেকে গুলি। অথবা সামনে তাকাতেই বুকে গুলি। কীভাবে ঘটনাটি ঘটবে বোঝা যাচ্ছেনা।
‘ইতুকে হাতকড়া পরিয়ে ডিবির দলটি গাড়িতে তুললেন। এসআই কেরামতসহ সাত জনের দল। গাড়িটি দ্রুত চলছে। পরিচিত শহরের রাস্তা দিয়ে চললেও কেমন অচেনা লাগছে ইতুর কাছে। গাড়ির সবাই কেমন যেন চুপচাপ। আর হয়তো কিছু সময় । এরপর তার ভবলীলা সাঙ্গ হবে।
‘ইমরুলের বাসা কোথায়? সেখানে নিয়ে চল আমাদের।’ অনেকক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ নির্দেশ দেন এসআই কেরামত। তাহলে ইমরুলকেও এরা তার সাথে গুলি করতে চায়? যাক তবু শেষ সময়ে বন্ধুর দেখা পাওয়া যাবে।
‘ইমরুল মেসে থাকে। কলেজের পাশের একটি মেসে। এখন কটা বাজে?
‘১০টা। কেন কোন সমস্যা আছে?’
‘সমস্যাতো আছেই। এসময় ইমরুল হয়তো প্রাইভেট টিউশনি করে মেসে ফেরেনি। ষ্টুডেন্টদের বাসায় রাতে খাওয়া হয় তার। টিউশনি ঠিকঠাক করার সময় ইমরুলের শর্ত থাকে রাতের খাবারের। এ ব্যাপারে সে কোন ছাড় দেয়না। তো খাওয়া দাওয়ার পর ফিরতে একটু দেরি হয় তার।’
‘সমস্যা নাই। তুমি মেসেটা চিনিয়ে দাও। বাকী কাজ আমরা করবো।’
কলেজের পাশের ‘ঝিলমিল’ ছাত্রাবাসের সামনে পুলিশের গাড়িটি থাকলো তবে কেউ গাড়ি থেকে নামলো না। ইতু মেসটি দেখিয়ে দিলো গাড়ির ভেতর থেকে। এরপর এসআই কেরামত অফিসে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন ড্রাইভারকে।
হাফ ছেড়ে বাঁচলো ইতু। তাহলে আপাতত বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছেনা। এরা সম্ভবত ইমরুলকে ধরে তার মুখোমুখি করবে। তারপর সিদ্ধান্ত।
রাত ১২টার দিকে জালাল এলেন তার রুমে। আবার কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে নাকি তাকে? না—জালাল আসলে এসেছেন অন্য কারণে। নাটি বিস্কুটের রহস্য ফাঁস করার কারণে সে একটু সমীহ করছে ইতুকে। কাগজের একটা প্যাকেট তার হাতে। প্যাকেট খুলে দিলেন ইতুর সামনে। গরম গরম রুটি আল বুটের ডাল।
‘ইতু ভাই খাইয়ে নেন। আর পঁচা খাবার আনি নাই’।
জালাল মিয়ার হঠাৎ সদয় হবার কারণে খুঁজে পেলেন না ইতু। পরে মনে পড়লো বিস্কুটের কথা। ব্যাটা মনে হয় অনুশোচনায় ভুগছে। তাই গাটের পয়সা খরচা করে তাকে রুটি আর ডাল খাওয়াতে এসেছেন।
‘আপনি খুব ভালো মানুষ ইতু ভাই। আমার ধারণা আপনাকে খামোখা আটকে রাখা হচ্ছে।’
‘আমাকে কী ছাড়া হবে জালাল ভাই’।
‘বলা মুসকিল। গত কয়েকদিন ধইরে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা হইতেছে। তাই স্যাররা বেশ গরম। ’
জালাল মিয়া চলে গেলেন। মনে হয় বেশ আশ^স্ত হয়ে গেলেন। তার দেয়া গরম রুটি বেশ আয়েশ করে খেল সে। একটু আগে মনে হয়েছিল তার সময় শেষ। এখন মনে হচ্ছে আরো কিছু সময় মিলবে। এনাদের মতিগতি ভালো থাকলে ছাড়াও পেতে পারে সে।
এক সময় চোখ জুড়ে নেমে এলো অবাধ্য ঘুমের বন্যা। গভীর ঘুমে ডুবে গেল ইতু।
-লেখক-সাংবাদিক ও কবি