কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
কুড়িগ্রামে রাজারহাটে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে উদ্যোক্তা তৈরি নামে সরকারের লাখ-লাখ টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের পকেটস্থ করছে। অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ হলেও কাজে লাগছে প্রশিক্ষণার্থীদের। আর এতে করে লাখ-লাখ টাকা গচ্ছা যাচ্ছে সরকারের। সরেজমিনে দেখাযায়,রাজারহাট উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কার্যালয় সাইনবোর্ড বিহীন তিন তলা ভবনে এই সরকারি অফিস। ভিতরে প্রবেশ করে চিত্র দেখে কারোই মনে হবে না এখানে নারী উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যে যার মতই গল্প গুজবে ব্যস্ত সময় পার করছে প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থীরা। চলতি ২০২১-২২অর্থ বছরের বিউটি ফিকেশন এবং ফ্যাশন ডিজাইন কোর্সের ১৪ ও ১৫তম ব্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিন মাস মেয়াদি বছরে ৪টি কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি কোর্সে সকাল ১০টা হতে দুপুর ১টা এবং বিকেল ২টা থেকে ৫পর্যন্ত প্রশিক্ষণে ২টি ব্যাচে ১০০জন নারী উদ্যোক্তা অংশ নেয়। তিন মাসের কোর্সে সরকারি ছুটিসহ অন্যান্য বন্ধের কারণে প্রশিক্ষণ হয় ৬০দিন। প্রতিদিনের ভাতা হিসেবে ২শত টাকা হারে প্র্রশিক্ষণার্থীরা ১২হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে সেই টাকা এক থেকে দু’হাজার টাকা কর্তন করে বাকি টাকা প্রশিক্ষণার্থীদের দেয়া হয়। এছাড়াও প্রশিক্ষনের উপকরণের জন্য প্রতি ব্যাচে ৬হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোন উপকরণ নেই। প্রশিক্ষণার্থীদের নিকট হতে চাঁদা তুলে উপকরণ ক্রয় করা হয়। বিধি অনুযায়ী ৮ম শ্রেণীর পাশের ১৬ হতে ৪২বছরের অবহেলিত-বঞ্চিত নারীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন। কিন্তু বিধি তোয়াক্কা না করেই অফিস সহকারী রেয়াচত আলী তার নিজের তিন মেয়ে এবং অফিসের অস্থায়ী পরিচ্ছন্ন কর্মী ফাতেমা বেগম সহ পছন্দের নারীদের নাম অন্তর্ভক্ত করে থাকেন। প্রশিক্ষণে অনুপস্থিত থেকেও প্রশিক্ষণের ভাতা নিচ্ছেন তারা। এছাড়াও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণী মাসে দু-একবার এসে অফিস করেন। অফিস সহকারী রেয়াচত আলীর তত্বাবধায়নে চলে অফিস। দীর্ঘদিন লোক চক্ষুর আড়ালে এভাবেই প্রতি ব্যাচে সরকারের বরাদ্দকৃত টাকা থেকে ২/৪লাখ টাকা আত্মসাৎ করছে অফিসের সিন্ডিকেট চক্রটি। প্রশিক্ষণার্থী মিনারা বেগম বলেন,এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসছি। নিজে কিছু করার জন্য। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে কোন লাভ হচ্ছে না। এখানে কোন প্রডাক্ট নেই। এসে গল্প গুজব করে সময় পার হয়। একশ টাকা করে নিয়েছে প্রডাক্ট আনবে বলে। আজও সেই প্রডাক্ট নেই। আরিফা আক্তার বলেন,
আমাদের কোন কিছু শেখানো হচ্ছে না। বিউটি ফিকেশনের প্রশিক্ষণ নিলেও এখানে কোন প্রডাক্ট নেই। আমাদের নিজেদের প্রডাক্ট নিয়ে এসে একটু একটু শিখছি। প্রায় দু’মাস হলো প্রশক্ষিণের সেখানে আমরা ভ্রু,চুল আর ফেসিয়াল শিখাইছে। কিন্তু পার্লারের ম্যানলি বউ সাজ আমরা শিখতে পারি নাই। ফেসিয়ালের যেটা আসল সেটাই আমরা শিখতে পারি নাই। লাবনী বলেন,আমরা ব্যাচে ২৫ জন আছি। আমরা দু’মাস ধরে নিয়মিত উপস্থিত থেকে ক্লাস করছি ২১জন।অথচ স্বাক্ষর হচ্ছে ২৫জনের। কোথায় কিভাবে স্বাক্ষর গুলো হচ্ছে আমরা জানি না। প্রতিদিন ক্লাসে ২১জনের স্বাক্ষর করি আমরা আর পরের দিন ক্লাসে এসে দেখি ২৫জনের স্বাক্ষর। প্রশিক্ষক ফাহমিদা হক বলেন,প্রশিক্ষণার্থীর উপস্থিতির বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে না পারলেও তাদের নিকট থেকে জন প্রতি ১০০ টাকা নেবার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন প্রডাক্ট কেনার জন্য টাকা তুলে জয়ন্তী রাণী ম্যাডামকে দেয়া হয়েছে। উনি বর্তমানে ঢাকায় আছেন। অস্থায়ী পরিচ্ছন্নকর্মী ফাতেমা বেগম বলেন,আমাকে অফিস থেকে মাসে এক হাজার টাকা বেতন দেয়। আর আমার নাম প্রতিটি ব্যাচেই অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। সেখান থেকে কিছু টাকা দেয়। এছাড়া আর কোন টাকা পাই না। এই বিষয়ে অফিস সহকারি রেয়াচত আলী প্রথমে নিজের মেয়েদের কথা অস্বীকার যান। পরে প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণার্থীদের চাপে তার তিন মেয়েকে নিয়মিত প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা স্বীকার করেন তিনি। তাদের হয়ে নিজেই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেবার কথা স্বীকারও করেন তিনি। এছাড়াও তিনি আরও বলেন,চলতি ২০২১-২২অর্থ বছরে মোট প্রশিক্ষণার্থী ২শ জন। তাদের উপকরণে ক্রয়ের জন্য ৯০হাজার টাকা এবং ভাতা হিসেবে ২৪লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সিনিয়র প্রশিক্ষক রেজিয়া খাতুন বলেন,আমার অফিস কাজ করার কথা থাকলেও লোকবল কম থাকায় আমাকে ফিল্ডে কাজ করানো হয়। ভিজিডি,নারী নির্যাতন,
বাল্যবিয়ে,মামলা-কোর্ট এগুলো আমাকে দেখতে হয়। যদিও আমার এগুলো কাজ নয়। কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমাকে ফিল্ডে যেতে হয়। এজন্য আমার কোন টিএডিএ দেয়া হয় না। বরাদ্দ আছে কিনা আমার জানা নেই। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণীকে অফিসে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন,উদ্যোক্তা তৈরির নামে সরকার যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে তা কোন কাজে আসছে না। রাজারহাট উপজেলায় শত-শত নারী প্রশিক্ষণ নিলেও তা শুধু কাগজ কলমে। লোক দেখানো প্রশিক্ষণের নামে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। চোখের সামনে এত অনিয়ম হলেও জানা নেই প্রকল্পের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে তাসনিমের তিনি শুনে নিজেও হতবাক হয়ে যান। অনিয়মের তথ্য জানতে পেরে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেন তিনি।