আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার দেশটির সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে – তার প্রতিবাদে সহিংস বিক্ষোভ এখন নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
তেলেঙ্গানা রাজ্যে বিক্ষোভকারীরা একটি ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ রাজ্যের সেকান্দরাবাদ শহরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে একজন নিহত এবং আরো অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছে। উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল, দোকানপাট ও ট্রেন-বাসে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে।
বিক্ষোভকারীরা বলছে, সরকার এই পরিকল্পনা বাতিল না করা পর্যন্ত তারা থামবে না।
কেন ক্ষুব্ধ এই বিক্ষোভকারীরা?
ভারতের নানা রাজ্যের ছোট ছোট শহর ও গ্রামের তরুণ-যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের এক বড় সুযোগ হচ্ছে সেনাবাহিনীর চাকরি।
তাদের চোখে, সৈনিকের চাকরি তাদেরকে নিয়মিত আয়, সামাজিক সম্মান, অবসরের পর পেনশন, এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তির উপায় এনে দিয়েছে।
প্রায় ১৪ লক্ষ জনবলের ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশটির অন্যতম বৃহৎ নিয়োগদাতা। প্রতি বছর সামরিক বাহিনী থেকে প্রায় ৬০ হাজার লোক অবসরে যান, আর তাদের জায়গা পূরণের জন্য ভারতে ১০০টি নিয়োগ কর্মর্সূচি পরিচালনা করে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই এ নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ ।
সরকারি কর্মকর্তারা এর কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস মহামারির কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতের সামরিক বাহিনী সম্পদের সীমাবদ্ধতায় ভুগছে এবং আধুনিকায়নের প্রয়াসেও গতিসঞ্চার হচ্ছে না।
এর মধ্যেই ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার পরিকল্পনা করেছে যে সামরিক বাহিনীতে সৈনিকদের আর স্থায়ী চাকরি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে না। তার পরিবর্তে একেকজন সৈন্যকে নিয়োগ করা হবে চার বছরের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য।
কী আছে এই পরিকল্পনায়?
এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘অগ্নিপথ।’ এর আওতায় প্রথম দফায় ৪৬ হাজার সেনা নিয়োগ দেয়া হবে।
এর আওতায় ১৭.৫ থেকে ২১ বছর পর্যন্ত বয়স্কদের চার বছরের জন্য সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হবে। চার বছরের মেয়াদ শেষ হবার পর এই নিয়োগপ্রাপ্তদের মাত্র এক চতুর্থাংশকে স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনীতে রেখে দেয়া হবে – বাকিদের সৈনিক জীবন শেষ হয়ে যাবে।
এই সৈনিকদের নিয়োগ পাবার পর ছয় মাসের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, এবং তার পর সাড়ে তিন বছরের জন্য তারা সামরিক বাহিনীতে মোতায়েন হবেন। এসময় তারা মাসে ৩০,০০০ রুপি বেতন পাবেন – যা অন্যান্য ভাতা সহ চার বছরে ৪০,০০০ রুপি পর্যন্ত পৌঁছাবে।
এতদিন পর্যন্ত যেভাবে ভারতের একজন সৈনিক অন্তত ২৫ বছরের জন্য নিয়োগ এবং তার পর আমৃত্যু পেনশন, স্বাস্থ্য ভাতা ইত্যাদি পেতেন – সেই প্রথা এখন বাতিল হবার মুখে।
সমস্যাটা এখানেই। ‘অগ্নিপথ’ নিয়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হলো – চার বছর সৈনিক জীবন শেষে যারা সামরিক বাহিনী থেকে বিদায় নেবে এর পর তাদের কী হবে?
আসাম রাজ্যের ২০ বছরের তরুণ দেবজিৎ বোরা বলছেন, “আমি গত দু বছর ধরে অনেক পরিশ্রম করেছি সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য। কিন্তু ‘অগ্নিপথ’ স্কিম ঘোষণার পর দেখছি – আমি নির্বাচিত হলেও চার বছর পর আমাকে রিটায়ার করিয়ে দেয়া হবে। তার পর আমি কী করবো?”
কেন এ পরিকল্পনা করেছে সরকার?
ভারতের সরকার বলছে, সামরিক বাহিনীর বেতন ও পেনশনের জন্য সরকারকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় তা কমানোর জন্যই এ পরিকল্পনা।
ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় এখন প্রায় ৭০০০ কোটি ডলারেরও বেশি – যা পৃথিবীতে তৃতীয় সর্বোচ্চ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরেই। কিছু বিশেষজ্ঞ বলেন, এই ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি খরচ হয় বেতন ও পেনশনের জন্য।
সরকার বলছে, অগ্নিপথ পরিকল্পনার মাধ্যমে যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা সামরিকবাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য খরচ করা যাবে, তা ছাড়া এর ফলে ভারতের সামরিক বাহিনীর একটি ‘তারুণ্যদীপ্ত ভাবমূর্তিও’ তৈরি হবে।
পরিকল্পনার পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত
ভারতের বিশ্লেষকদের মধ্যে ‘অগ্নিপথ’ পরিকল্পনার পক্ষে-বিপক্ষে দু’রকম মত দেখা যাচ্ছে।
এর সমালোচকরা বলছেন, এতে সামরিক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়বে এবং দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাবে।
“এটা একটা বোকার মত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে – যা নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে” – বলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শেওনান সিং।
“খরচ বাঁচানো ভালো, কিন্তু প্রতিরক্ষা বাহিনীর ক্ষতি করে এসব করা উচিত নয়। একজন অভিজ্ঞ সৈন্য যুদ্ধে মারা গেলে তার জায়গা কি চার-বছরের ট্রেনিংওয়ালা একজন সৈন্য পূরণ করতে পারবে?” প্রশ্ন করেন মি. সিং।
কিন্তু আরেক দল বিশেষজ্ঞ বলছেন, সামরিক বাহিনীকে আরো দক্ষ ও আধুনিক করার জন্য এমন পরিকল্পনার দরকার ছিল।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এস বি আস্থানা বলেন, “বয়স্ক মানুষদের আধুনিক প্রযুক্তি শেখানো কঠিন, কিন্তু এই প্রজন্ম অনেক সক্ষম। এ পরিকল্পনার ফলে সেনাবাহিনী সেরা ২৫ শতাংশ সৈন্যকে রেখে দিতে পারবে, আর বাকিদের বিদায় করে দেয়া যাবে।”
কিন্তু এ পরিকল্পনার কথা জানা যাবার পরই এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যে। এখন তা অন্য অনেক রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, প্রথম বছরে আবেদনকারীদের বয়সসীমা ২৩ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হবে।
শুক্রবার সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে সরকার বলেছে, যে সৈনিকরা চার বছরের মেয়াদ শেষ করবে তাদেরকে পরে পুলিশ বাহিনীতে চাকরির মত অন্য নানা সুযোগ দেয়া হতে পারে।
কিন্তু ভারতে এখন বেকারত্বের হার প্রায় ৭.৮৩ শতাংশ। সে কারণে এ কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ আরো বেড়ে গেছে।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেনাবাহিনীর চাকরি শেষ হয়ে যাবার পর বহু যুবকই সীমিত কাজের সুযোগের কারণে হয়তো এক হতাশ জীবনের আবর্তে পড়ে যাবেন।
সূত্র: বিসিসি বাংলা