কবি মোঃ আশতাব হোসেন
বাবলু, কিরণ,ইমন ওরা তিন বন্ধু একই বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীতে লেখা পড়া করে। এক সাথে স্কুলে যায় একজনের দরকারে তিনজন মিলেই বাজারে যায় এবং একই সাথে খেলাধুলাও করে। রাতের বেলা ও খানার সময়ে শুধু যার যার মতো অবস্থান করে মাঝে মাঝে এক বন্ধুর বাড়িতেই খানা ও রাত্রিযাপন করে। কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারেনা!
প্রতিদিন বিকাল হলেই তিন বন্ধু মাঠে অন্যদের সাথে খেলতে যায় খেলা শেষ হলে দুধকুমার নদীর পাড়ে বটতলায় বসে কিছু সময় মনের সুখে বাঁশি বাজায়। তিনজনই এক সাথে বাঁশি বাজানো শিখে নিয়েছে। বাঁশি বাজানোটা ওদের বেশি প্রিয়।
বটতলায় বেশি সময় কেউ থাকেনা একটু অন্ধকার হলেই সবাই সেখান থেকে চলে যায়। অনেকেই বলে ভূতেরা নাকি রাত হলে সেখানে নাচ গান এবং বাঁশিও বাজায়। তবে এ খবরটা ওরা তিন বন্ধুর জানা ছিলোনা।
একদিন সন্ধ্যার পরেও তিন বন্ধু বাঁশি বাজিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে কিছুদূর যাওয়ার পরেই আবার সেখান থেকে বাঁশির শব্দ ভেসে আসে ওদের কানে। পথেই তিনজন দাঁড়িয়ে যায়,এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে বলে ঘটনাটা কিরে এতো সুন্দর করে কে বাঁশি বাজায়? এতো সুন্দর করেতো এখনও আমরা বাঁশি বাজাতে পারিনা। ওদের কাছেই আবার শিখতে হবে। একজনের প্রস্তাবে অন্য দুই বন্ধু রাজি হয়ে যায়। বাবলু কিরণ ও ইমনকে বলে চল যাই আজকে শুধু চুপচাপ বসে থেকে শুনে আসি তার পর আস্তে আস্তে ওর সাথে মিল দিয়ে শিখে নিব, কিরণ ও ইমন বলে তাই হবে চল যাই। তিনজন মিলে আবারও বটতলার দিকে যাত্রা শুরু করে যতো সামনের দিকে যায় ততোই বাঁশির টানে আকৃষ্ট হতে থাকে, এমন মনমাতানো সুর আর কোনোদিন যেনো শুনেনি।আহ্ কি যে পাগল করা সুররে! সন্ধ্যা পেরিয়ে ঘন আঁধার নেমে এসেছে পথও ঠিকমতো দেখা যায়না এবং শেষ হচ্ছেনা পারেনাতো দৌড়িয়ে গিয়ে বটতলায় হাজির হয়। পৌষ মাস,শীতও নেমেছে একেবারে কম্বল মুড়ি দিয়ে,মানে সাথে কুয়াশাও পড়ছে বৃষ্টির মতো । পায়ের সেন্ডেলে লেগে যাচ্ছে রাস্তার মরা পাতা, লতা ও কাদা। পা পিচ্ছেলে যাচ্ছে তাই হাটা এগাচ্ছেনা কিন্তু মনতো দৌড়ে যাচ্ছে বাঁশিবাদকের দিকে!
কিছুদূর যেতেই দেখে কয়েকটি হারিকেনের আলোর মতো মিটমিট করে জ্বলছে। বাবলু বলে বাঁশিওয়ালারাই মনে হয় আলোর ব্যবস্থা করেছে কারণ ঘুটঘুটে অন্ধকার তো কি করবে!
বটতলার কাছে এসে দেখে আলো জ্বলছে বটগাছের উপরে শাখায় শাখায়! বাঁশির সুরও আগের মতো নেই অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে।
বটগাছের পাশেই আছে শ্বশ্মান ঘাট,সেখান থেকেও ভেসে আসছে বাঁশির সুর!
তিন বন্ধু ভরকে গেছে ঘটনা দেখে, বাবলু একটু বেশি চালাক। সে কিছুটা আচ করতে পারলেও ব্যাপারটা কিরণ ও ইমনকে বুঝতে দিতে চাচ্ছেনা, কারণ ওরা দুজন খুব ভিতু প্রকৃতির শুধু ইঙ্গিতে বলে এসব যায়গা তেমন ভালোনারে;তার মধ্যে পাশেই শ্বশ্মান ঘাট! এসব ভাবতে ভাবতে শ্বশ্মান ঘাট থেকে কে যেনো ওদের তিনজনের নাম ধরে ডাকছে।বাবলু, কিরণ,ইমন তোমরা ওখানে কি করো এদিকে চলে আসো! কিরণ বলে কার গলার শব্দরে ওটা? ইমন বলে গনেশ কাহার গলার মতোই মনে হচ্ছে! কিরণ বলে তাইতো গনেশ কাহাওতো ভালো বাঁশি বাজাতে পারে! হয়তো আজ বাজার ঝাড়ু দেয়ার কাজ শেষ করে এখানে এসেছে বাঁশি বাজাতে। বেচারার মনেও অনেক কষ্ট।এক মাস আগে তার স্ত্রী বিজলি রাণী মারা গেছে,এই শ্বশ্মানেই দাহ করেছে। হয়তো কাহির কথাই মনে করে এখানে এসে করুণ সুরে বাঁশি বাজিয়ে দুঃখগুলি বাঁশির তরঙ্গে ভাসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে! বাবলু বলে সেটাও হতে পারে। তবে চল দেহি কেডা গিয়াই দেহি আগে! তিন বন্ধু সাহস করে শ্বশ্মানের দিকে যাচ্ছে। কিছু দূর যাওয়ার পরে সেখানেও আর বাঁশির শব্দ বা মানুষে শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা! তখন ওদের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো, ঘটনা কিরে কার পাল্লায় পড়লাম আজ! আবার বটতলা থেকে ডাকছে বাবলু কিরণ ইমন তোরা ভুল করে ওদিকে গেলি ক্যান, বটতলায় আইয়া পড়!
তিনজনই আবার বটতলার দিকে যাত্রা করে কিছুদূর যাওয়ার পরে আবার পিছন থেকে ডাকে -কিরে বাচারা; আমার কথা বুজবার পারোসনা ক্যান? এ দিহে আয় আবারও শ্বশ্মান ঘাট থেকে ডাকছে ওদের! কিরণ বলে- গনেশ কাহাইতো আবার ডাকছে! কিন্তু তিনজনই আর দিক নির্ণয় করতে পারছেনা কোন দিক দিয়ে যাবে। তবে যে দিক থেকে ডাকছে সেই দিকটার একটা আনুমানিক ধারণা করে হাটতে শুরু করে তবে ইতিমধ্যে তিনজনের মনের ভিতরে ভয় ঢুকে পড়ে এবং শরীরও অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে! রাত ১২টা পার হয়েছে,আশে পাশে মানুষের কোনো সারাশব্দ নেই! গনেশের কণ্ঠে আবারও বলছে এই আমি হেরিকেন দরে আছি এদিহে লজর হরে হরে আয়। টোরা আইলেই হাবার বাঁছি টান দিমুনে!
হারিকেনের আলো লক্ষ্য করে আবারও ঘুরে যাত্রা শুরু করে যাচ্ছেতো যাচ্ছেই দুধকুমার নদীর পাড় ঘেঁষে পথ যেনো শেষ হচ্ছেনা। এদিকে বট গাছের উপর থেকে কারা যেনো হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ করে হাসছে আব বলছে যা আজ ধরা খাবিনে! এমন হাসি আর কথা শুনে রিতিমতো ঘাবরে গেলো তিনজনই! উপায় কি করা যায়? বাবলু তখন বলে আমাদের এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা ঠিক হবেনা রে, বিপদে পড়েই গেছি! ভূতেরা আরও বেশি ভয় দেখায় ! এ কথা শুনে কিরণ আর ইমন জোরে বলছে ঠিক তাই, কিন্তু ভিতরের আবস্থা বেহাল শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। বিড়বিড় করে বলছে আজ কোনো মতে পার পাওয়ার পর আর জীবনেও রাতের বেলায় নদীর ঘাট তো দূরের কথা ঘর থেকেও বের হবোনা!
তিন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেয় জলদি করে সোজা চলে যাই ফুল মিয়ার ঘাটে, যদিও একটু দূর হবে তবুও সেখানে যাওয়া সহজ হবে। কারণ দক্ষিণ দিকে বাঁশের খুটির সাথে যে বিদ্যুৎতের বাতি জ্বলছে সেটাই ঘাট। মানুষের দিক নির্ণয়ের জন্য সেটা দিয়েছে ফুল মিয়া! এই বলে তিনজন দূরের সেই বাতির আলোকে লক্ষ্য করে নদীর পাড়ে উঠে সোজা দৌড় শুরু করে। দৌড়ায় আর মাঝে মাঝে হুমরি খেয়ে পড়ে যায় আবার উঠেই দৌড়! কে কার আগে যাবে হুস নেই যেনো রাতে অন্ধকারে দর্শকবিহীন দৌড়ের প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেছে! তাদের হাতের বাঁশি কোথায় যে পড়ে গেছে কেউ বলতে পারেনা পায়ের স্যান্ডেল কখন যে খুলে গেছে তাও টের পায়নি!
এদিকে পিছন থেকে কে যেনো বারবার ডাকছে-ফিরে আয়, ফিরে আয়, গাহান হুইনা যায়। এবার টোদের গাহান হুনাইয়া শিক্কা দেই হকল দিন হামাদে আস্তনায় এছে বাঁছি বাজানো আর আদ্দাবাজি জনমের মতো হাদ মিতাই ! থোরা তিনজুন অনিক দিন থেকে হামাদের ছাধীনতা নস্ত করি দিবার বুঝ কিমন মোজা!
ভৌতিক বাঁশির সুর
শীতকাল হলেও তিন বন্ধুর শীতের ভয় আগেই পালিয়ে শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে, উত্তর দিক থেকে শীতল বাতাস বয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে অনেক কলাগাছে বাতাস লেগে কালাপাতা ফর ফর করে শব্দ করছে। মাঝে মাঝে সে শব্দ হাতে তালি বাজানোর মতো তিনজনের কানে পৌঁছে! ইমন তেমন দৌড়াতে পারছেনা অনেক পিছনে পড়ে যায় বারবার, কিরণের অবস্থাও একই। বাতাসে কলাপাতার শব্দটা ওদের কাছে মনে হচ্ছে ভূত যেনো সাথেই দৌড়ে আসছে, ইমন বলছে, ঐ বাবলু তুই আগে যাইস ক্যান? ভূত আমাদের সাথেই দৌড়ে আসছে আর খুশিতে হাত তালি দিচ্ছে আমাদের ভয় দেখাতে পেরে! তুই খাড়াইয়া একটু হুন বাবলু! কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাবলু বলে খাড়া অওনের সুমায় নাইকা জলদি দৌড়া।হয়তো ফুল মিয়ার ঘাটের কাছেই আইয়া পড়ছি গায়ে বল রাইখা দৌড়া। ইমন আর কিরণ বলে গায়ে আর বল পাইনারে বাবলু তোর কারনেই আজক্কা এই দশা অইলো আর তুই আমাদের ফেলাইয়া যাইসরে।এইডা তোর ভালা কাম অয়না কিন্তুক বাবলু! বাবলু বলে- আরে আইলসা হকল দৌড়া জলদি পাছমুরায় তাহাসনা ভূতে ধরলে পাছে ফিরে দেখতে হয়না তাতে ভূত আরো ডর দেহায়! এ কথা শুনে ইমন আর কিরণ যেনো পানি পান করতে চায়! মানে ভিতরে সব শুকিয়ে পাটখড়ি হয়ে গেছে!
পেয়ে যায় ফুল মিয়ার ঘাট! লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, গদিতে বসে ফুল মিয়া সারা দিনের খেয়া পারাপারের টাকা পয়সা হিসাব করছে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে। ওরা তিনজন গদি ঘরের পিছনে গিয়ে দেখে সেখানে মাটির একটি কলসিতে পানি ও একটা বড় মগ আছে। একজন একজন করে তিনজনই কলসির পানি পান করে ভরা কলসি খালি করে ফেলে!
পানি পান করে নদীর ঘাটের পানি দিয়ে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে ফুল মিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়! ফুল মিয়া বলে কিরে বাপুরা তোমরা এতো রাইতে কুনহান থেহে আইলা? বাবলু পরিস্কার করে বলতে চাইলে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও বলে কাহা আমরা দহিন পাড়ায় পালাগান হুনতে গেছিলাম। দুরে থেইয়া আপনারে দেইহা নিহটে আইলাম, একডা কতা জানতি। ফুল মিয়া কয় তয় কও দেহি কি কতা? কিরণ আর ইমন পাশেই দাড়ানো আছে, বাবলু বলে আইচ্চা কাহা
পাটেশ্বরী বাজারে যে গণেশ মেথর ছিলে হেতো ভালা বাঁশি আর গানও নাহি গাইবার পারে। তয় একদিন আফনের গদিঘরে ডাইহা আইনা একটা আসরের আয়জিন করতি পারব্যাননা? খরচাপাতি আমরা কজন দিমুনে! ফুল মিয়া কয় হেইডাতো হরতে পারিরে বাজান! গণেশের পরিবার বিজলি রাণী এক মাস আগে মারা যায়, তার হর পেনোরো দিন যাইবার হরেই গণেশও ঐ বট তলায় আইয়া বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে স্টেক কইরা মইরা গেছেরে বাজান ! দুই জনকেই ঐ যে বটতলা শ্বশ্মানেই পুইড়া হালাইছে!
এই কথা শুনা মাত্রই কিরণ আর ইমন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়! ফুল মিয়াতো চিৎকার দিয়ে বলে কিরে বাবা! কিরে বাবা! তোদের আবার কি অইলো! হায় হায়রে কি বিপদেইনা হরলাম! চিৎকার করে দৌড়ে যায় ভরা কলসির কাছে গিয়ে দেখে পানি নেই ফুল মিয়া হতাশ আমার ভরা কলস কে খালি করলোরে কি না বিপদে হরলাম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *