নুরে আলম মুকতা

ষাটোর্ধ আলী মিয়া একটি সরকারি অফিসের পিওন পদে চাকরি পেয়েছিল যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত দেশে। অনাথ , এমনই অনাথ যে মা-বাবার দূর সম্পর্কের আত্মীয় কেউ কোথাও আছে কিনা ,
ও জানত না ।

গাঁও গেরামের মুরুব্বিদের ফাই ফরমায়েশ পালন করে দিন কেটে যাচ্ছিল ।

দিন এভাবেও অনেকের কাটে , অনেকের রাত এভাবেও কাটে যেখানেই কাত ! আগামীর সূর্য ওদের নির্ধারিত কিন্তু উনুন জ্বালানোর দরকার নেই । কোন থালা বাসন ধোয়ার দরকার নেই । খাট পালঙ্ক কিংবা বালিশ তোষকের নেই প্রয়োজন। মানুষের জঙ্গল নামক অরন্যের ওরা সদস্য মাত্র। প্রয়োজনটুকু আল্লাহ জানেন। কেন তিনি এ অনাথ কেও সংসারে রেখেছেন !

অবশেষে হেলথ ইন্সপেক্টরের চোখে পড়েছিল আলী । ম্যাট্রিক পাশ যুবককে কোন কাজে কেউ নিচ্ছিল না । কেউ কন্যা দিতেও আগ্রহ দেখায় নি ।

মিষ্টি দোকানের বয় হিসাবে নষ্ট মিষ্টি ফেলতে না গেলে জীবনের গল্পটি হয়ত ভিন্ন রকম হতে পারত।

ইন্সপেক্টরের ভয়ে যখন ও মিষ্টি কাঁধে নিয়ে দৌড় দিচ্ছিল তখন দোকানী বাড়ির ছাঁদে উঠে মিটমিট করে হাসছিল। কিন্তু মালিক ত আর ভাবেনি মালিকের ওপরের মালিক ওর ভাগ্যলিপি নিয়ে তাকিয়ে আরো জোরে হাসছিলেন ।

ইন্সপেক্টর যখন আলীর পথ আগলে দাঁড়ান তখন আলী কাঁধ থেকে মিষ্টির গামলা নামিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে যায় ।

ইন্সপেক্টরঃ এগুলো কি ?
আলীঃ স্যার নষ্ট মিষ্টি ।
ইন্সপেক্টরঃ কতদিন আগের?
আলীঃ আমি জানি না স্যার , মালিকের আদেশে আমি নদীতে ফেলতে যাচ্ছি ।
ইন্সপেক্টরঃ তুমি দৌড়াচ্ছিলে কেন?
আলীঃ মালিকের হুকুম তালিম করছি ।

তারপর আলী মালিকের নাম ঠিকানা সব গড়গড় করে বলে দেয়। মালিক জানত, ধরা পড়লে আলী সব সত্য প্রকাশ করে দিবে । এলাকায় আলীর সততা সম্পর্কে সুনাম ছিল। এজন্য মালিক, আলীর কিছু করতে পারেনি ।

ইন্সপেক্টর সাহেব যখন জানতে পারলেন আলী ম্যাট্রিক পাশ তখন তিনি বলেছিলেন,
তোমার ত ওই দোকানে আর চাকরি থাকবে না ।

স্যার আমি একা, মা ক’দিন আগে চলে গিয়েছেন। আল্লাহ একটা ব্যাবস্থা
করবেন ।
আমি মিথ্যা বলতে পারব না । মিষ্টি দোকানী জরিমানা খেয়েও ইন্সপেক্টর সাহেবকে বলতে বাধ্য হয়েছিল ,
স্যার আলীর কোন দোষ নেই ।

সেই থেকেই আলী থানা স্বাস্থ্য পরিদর্শকের অফিসে কাজ পেয়েছিল । মাঝ বয়সে গিয়ে এক এতিম কন্যার সাথে যখন বিয়ের পিড়িতে বসে তখন আলীর বাড়িও
ছিল না । সাহেবের দয়ায় নতুন বৌ নিয়ে অফিসেই ঠাঁই হয়েছিল ।

সাহেবের নতুন বৌ, আলীরও নতুন বৌ ।

বছর ঘুরতেই সাহেবের বিবির কোল জুড়ে একটি ফুটফুটে সন্তান এলে আলী আর ওর বৌ মিলে সারাদিন ওদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখত ।

সাহেব তিনবছরের সন্তান নিয়ে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। নতুন সাহেবের বৌ আলী আর ও বৌকে অফিসে থাকতে দেয়নি। ততদিনে আলী সরকারি একটি খাস জায়গায় কুঁড়ে ঘর তুলেছিল।

সীল পাটা ক্ষয় করে আলীর বৌ গর্ভবতী হয়ে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি।

সংগ্রামময় জীবনের আরেক অধ্যায় আলীর জীবনে এক অমানিশা হয়ে গ্রাস করে ভ্রুকুটি করেছিল। দুগ্ধপোষ্য শিশু আর আলীর চাকুরি । যে দেখেছে সেই চোখের জল ফেলেছে । আলীর কাঁধে একটি ঝুলন্ত কন্যার ঝোলা । গোয়ালের কেনা গাভীর দুধ খাওয়ানোর সাথে আবার নিজের জন্য রান্না বান্না!

দুঃসহ এক জীবন !

তারপরও আলীর ঠোঁটে এক চিলতে নিষ্ঠুর হাসি।
আল্লাহই জানেন এরকম পরীক্ষায় তার কী লীলা আছে । বিধিলিপি আলীদের জন্য নির্মম বলেই মনে হয় স্বর্গের দরজা প্রশ্বস্ত করেছেন স্রষ্টা ।

বহু কষ্টে টেনে মানুষ করা আলী অপরূপ কন্যা দান করে আবার নিঃস্ব হয়ে যায় । দশ গ্রামের লোকেরা আলীকে চেনে কিন্তু আলীর জীবনের খোঁজ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না ।

আলীর কন্যাটি যখন গর্ভবতী হয় তখন আবার বাবার কাছে ফিরে আসে।

আলী একটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করায়। পরিচিত ডাক্তার মুখ গম্ভীর করে বলেন,

বাচ্চার পজিশন ঠিক নেই , ডেলিভারির সময় হলে সিজার করতে হবে । মাথা নীচু করে বাড়ি ফেরে আলী। মেয়েকে কিছু জানায়নি ।

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আলী বলে মা, সামান্য সমস্যা হলে আমাকে বোলো মা । আমি তোমার অধম সন্তান আছি, তোমার চিন্তা নেই । টস টস করে আলীর অশ্রু মমতাময়ী কন্যার গন্ডদেশে গিয়ে পড়ে । কন্যার বোবা দৃষ্টি একটি স্যাত সেতে বিছানায় গুমরে ফেরে।

ওপরে আল্লাহ মালিক —

যেদিন রাতে আলীর মেয়ের প্রসব বেদনা ওঠে সেদিন আলী সারারাত মেয়েকে বুকে করে নিয়ে বসে থাকে। ভোর বেলা বাবা মেয়ে শহরের ক্লিনিকে গিয়ে আশ্রয় নেয় । ক্লিনিকের ডাক্তার বলেন,
রক্ত লাগতে পারে, আপনারা সরকারি হাসপাতালে যান । নিরুপায় হয়ে একটি ভ্যানে করে ওখানেই বাপ বেটি চলে যায় ।

আলীর মেয়ের ঠিকানা দেখে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার আলীকে চেম্বারে ডাকেন । তখন মেয়েটির সমস্ত শরীরের ভার বাবার কাঁধে।

ততক্ষণে মেয়েটির নিম্নাংশ
ভিজে গিয়েছে !
ডাক্তার আপাদমস্তক দেখে আলীকে বলেন ,

আপনি কি হেলথ ইন্সপেক্টরের পিওন আলী ,
জী স্যার ,
আপনি কি তায়েজ ইন্সপেক্টরকে চিনেন ?

আলী জীবনের প্রথম হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে ।
তায়েজ ইন্সপেক্টরের একমাত্র ডাক্তার সন্তান আলীর কোলে পিঠে মানুষ হওয়ার ঋণ মাথায় নিয়ে আলীর মেয়েকে ট্রেচারে উঠিয়ে সতীর্থ নারী ডাক্তার সহ ওটিতে প্রবেশ করেন ।

তখন ডাক্তারের চোখেও দুফোঁটা
অশ্রু ছিল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন