মোঃ আশতাব হোসেন
সামনের দিকে ধাবমান শিকারী দল বিলের ঠিক মাঝ বরাবর পৌছার আগেই বিল জুড়ে মাছ ভয়ে পাগলের মতো ঝাপা ঝাপি শুরু করেছে। মনে হয় যেনো আমন ধানে খৈ ফুটছে বিলের পানির উপরে ! ধরাও পড়ছে পর্যাপ্ত পরিমান! খুশির সীমা অতিক্রম দর্শক সহ বাউতদের! তাদের বাড়িতেও অপেক্ষার মন্থর প্রহর গুনছে পরিবারের সকল সদস্য ! কখন যেনো বিশাল এক মাছ চাকজালের বাঁশের সাথে বেঁধে হাজির হয় কর্তা বাবু! ক্লান্ত সূর্য গা হেলিয়ে দিচ্ছে শয়ন ঠিকানায় সূর্যের দিকে তাকিয়ে আরও উৎকণ্ঠা বাড়ছে পরিবারের সকলের! পৌষের কনকনে শীত তার পরে বিলের স্থির বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি। মাছ পাওয়ার আনন্দে প্রমত্ত শীতও পিছু হটেছে যেনো শিকারী দলের! যারা মাছ পায়নি তারাও শেষ প্রত্যাশায় দ্রুতালয়ে চাক মেরে চলছে শীতল বাবুকে অগ্রাহ্য করে! লেগে গেছে বড় মাছ মাঝখানের একজনের জালে! বিকট আনন্দের চিৎকার! সহযোগীতায় আসে পাশের একজন, সে চিল্লানি দিয়ে বলছে জসিম মণ্ডলের কাপালে লেগেছে এবার বিলের শ্রেষ্ঠ মাছটি! এ কথা বলেই চাকজালটি খুব জোরে চেপে ধরে নিচের দিকে! জসিম মনে মনে কি যেনো মন্ত্র পাঠ করে ডুব মারে পানির নিচে মাছ তুলে আনতে! অনেক সময় অতিবাহিত জসিম পানির নিচ থেকে উঠছেনা! চিন্তায় পড়ে যায় সহযোগী মিন্টু মিয়া! এর এক মিনিট পরেই জসিম উঠে আসে নিচ থেকে বড় বড় রক্তিম চোখ নিয়ে মুখের কথা ছোট হয়ে গেছে মিন্টুর কানের কাছে মুখ দিয়ে বলে এবার বেঁচে গেলাম! মাছ নয় ওটা বড় একটি বেড়া ভ্যা ভ্যা করছে, আমাকে জলদি বাড়ি পৌছানোর ব্যবস্থা করো এই বলেই সে জ্ঞান হারায়! একজন নৌকা নিয়ে আসছে জসিমের দিকে এমন সময় পাশের আর একজনও পানির নিচ থেকে উঠে এসে একই ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনার বর্ণনায় বলে আমি দেখলাম পানির নিচে এক বিশাল স্বর্ণসিন্দুক তার পাশেই চারটি রাম ছাগল ভ্যা ভ্যা করছে আমার চাকের ভিতরেও একটি আটকা পড়েছে এই আমাকে জলদি বাড়ি পাঠাও বলেই সেও জ্ঞান হারায়! ভীতিকর এ সব কথা একমুহুর্তেই বাতাসে চার দিক ছড়িয়ে পড়ে, সকল শিকারী যে যেভাবেই পারছে ডাঙ্গায় দৌড়ে উঠছে! সবাই ডাঙ্গায় উঠে গেলে শীতলবাবু সবার উপরে ভর করে চেপে বসে। কাপুনির চোটে মনে হচ্ছে যেনো তীরে ভূমিকম্পন শুরু হয়েছে! দর্শকদের কেউ কেউ খড় এনে এবং শুকনা কচুরি পানার স্তব করে আগুন জ্বালিয়ে দিলে! শীতে কাতর সবাই আগুনের ওম নিয়ে যার যার মতো শুরু করে আপন গন্তব্যের দিকে যাত্রা! এমন ভয়াবহ ঘটনার পর থেকে আর কোনো দিন বাউতরা নামেনি ভইষকুড়ি বিলে!
বাতাস ঘোড়া এবার দৌড় শুরু করে দিয়েছে সবার কানে কানে স্বর্ণ সিন্দুকের খবর পৌছে দিতে! খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, মুরুব্বীরা বলছে ঘটনা সত্য হতে পারে, আমারাও আমাদের মুরুব্বীদের মুখে স্বর্ণসিন্দুকের আশ্চর্য কাহিনী শুনেছি! তারাও তাদের দাদা – দাদী ও নানা- নানীদের মুখেই শুনেছিলো ঐ সিন্দুক সোনার থালা, গামলা, বাটি ও চামচে ভরা! সে সময় নাকি ভইষকুড়ি বিলের পূর্ব পাশের বাড়ির কুদ্দুস প্রধানের দাদা ওয়েজ উদ্দীন প্রধানকে এক রাতে ঘুমের মাঝে কে যেনো বলে উঠে – ঐ ওয়েজ উদ্দীন প্রধান মনোযোগ সহকারে শুনে নে কথা। তোদের এলাকাতে লোক খাওয়ানোর বড় বড় অনুষ্ঠান হলে সেই বাড়ির বড় কর্তাকে সূর্যোদয়ক্ষণে, বিলের পাড়ে যে বটগাছটা আছে সেখানে যেতে বলবি। সেখানে গিয়ে দেখতে পাবে একটি লোহার শিকল বটগাছের গোড়ায় বাঁধা আছে সেই শিকল ধরে টানা শুরু করলেই ভেসে উঠবে বড় এক স্বর্ণসিন্দুক! বিশ্বাস ও সৎমনোভাব নিয়ে শিকল টানা শুরু করলে সিন্দুকটি তার কাছে চলে আসবে, আসার পরই আপনগতিতেই সিন্দুকের তালা খুলে ঢাকনা সরে গেলে দেখবে সিন্দুক ভরা স্বর্ণের সব বাসন-কোসন! তার যতোগুলি প্রয়োজন সব তুলে নিয়ে অনুষ্ঠানের লোকদের মেহমানদারি করাতে পারবে! মেহমানদারি শেষে সব পরিষ্কার করে পরের দিন আবার গিয়ে শিকলে টান দিলেই সিন্দুক তার দিকে ভেসে আসবে এবং তালা খুরে যাবে তখন সব বাসনকোসন হিসাব করে সিন্দুকে রেখে চোখ বন্ধ করবে। তার পর সিন্দুক কোথায় কিভাবে যায় সেটা আর জানার দরকার নেই! এই স্বপ্ন দেখা শেষ হলেই সকাল হয়ে ওয়েজ প্রধানের ঘুম ভেঙ্গে গেলে! চিন্তায় পড়ে যায় প্রধান সাহেব কেমন খব দেখলামরে! সে বিছানা ত্যাগ করে চোখ ঘোষে বাহিরে রাস্তায় যায় এবং একটি ভাটির গাছের ডাল ভেঙ্গে দাঁত মাজতে মাজতে সেই বটতলায় গিয়ে তার ঝিমানো চোখ ছানাবড়া! সত্যিইতো বটগাছের গোড়াতে শিকল বাঁধা আছে! সে শিকল ধরে টানা শুরু করে দেয় পরিক্ষা করার জন্য! সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে যায় শিকল শেষ হয়না বটতলায় বিশাল শিকলের স্তুপ হয়ে যায় সিন্দুকের খবর নেই! ক্লান্ত দেহে হতাশ মনে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে! কয়েক কদম যাওয়ার পরে পিছন ফিরে তাকায় বটগাছের গোড়ার দিকে এবার প্রধান সাহেব হতবিহবল ! শিকল সুর সুর করে নেমে যাচ্ছে পানির দিকে! প্রধান সাহেব জোর কদমে যাচ্ছে বাড়ির দিকে তার ভিতরে ভয়ও বাসা বেঁধেছে, ইতিমধ্যে কোনো কথা নেই সোজা বাড়ি গিয়েই এক সাথে তিন মগ পানি পান করে নেয়! ঘটনা সেদিন আর কাউকে বলেনা রাতে আবার যখন নিদ্রা বিছানায় যায় ঘুম সহজে ধরেনা রাতের শেষের দিকে ঘুম নেমে আসার সাথেই আবার আগের দিনের মতোই কে যেনো বলে কিরে প্রধান? পরিক্ষা নিতে গিয়ে নিজেই ফেলটুস! ভয়ের কিছু নেই, দরকার ছাড়া মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, শিকল টানলেও সিন্দুক ভাসবেনা হদ্দবোকা! যে বাড়িতে যখন দরকার হবে তখনই সে বাড়ির কর্তা গিয়ে টানলেই সিন্দুক আসবে এটা যেনো মনে থাকে। চলবে —

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন