৯০’ দশকের কথা। সন্ধ্যার পর কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা চত্বরে ঢুকলেই আঁধারের নির্জনতা ভেঙে কানে ভেসে আসতো উর্দু, হিন্দি, নাগরী কিংবা বাংলা ভাষায় খালি কণ্ঠে উচ্চস্বরে গাওয়া কোন গান। সাবেক উপজেলার সাবরেজেষ্ট্রি অফিসের বারান্দায় আধারে মাটির হাঁড়ি কিংবা থালি বাজিয়ে আন মনে যে মানুষটি একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছে তার নাম রংলাল। চোয়ানি কিংবা গাঁজা খেয়ে বিভোর হয়ে এক মনে গান করছে। ঝাকরা চুলের অধিকারী, ছোট খাটো গড়নের কালো রং -এর হাসি-খুসি মন খোলা একটি মানুষ। সারাদিন যা রোজগার করে রাতে মদ খেয়ে সব শেষ। মদ খাওয়া এবং মাতলামীর অভিযোগে জেলেও গিয়েছিল কয়েক বার। ওকে একদিন উপজেলা চত্বরেই দেখা পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হ্যাঁরে রংলালা , টাকা-পয়সা তো বেশ রোজগার করিস, মদ-গাঁজা না খেয়ে কিছু টাকা তো ভবিষ্যৎ এর জন্য ব্যাংকে জমাতে পারিস ।ভবিষ্যৎ এ কাজে লাগবে। জবাবে বলেছিল, বাবু হামরা কি মানুষ? হামরা জমি কিতে পারিনা, হামাদের ভোট নাই। হামরা বাবু, অস্পৃশ্য জাতি আছে। হামার আবার ভবিষ্যৎ?
ওর কথা গুলো আমাকে ভীষন আন্দোলিত করেছিল। ওরা অস্পৃশ্য জাতি কেন? ইতিহাসের পাতা থেকে পরে জেনেছি, অস্পৃশ্যতা নিম্নবর্নের মানুষের একটি সামাজিক মর্যাদা যারা ভৃত্য বা নিচু পেশায় নিয়োজিত। অস্পৃশ্যতা সাধারনত হিন্দু ধর্মের বর্ণভেদ পদ্ধতিতে লক্ষ করা যায়। বিংশ শতকের শুরুতে ভারতীয় উপমাহাদেশে অস্পৃশ্যতা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬০ মিলিয়নের বেশি। বর্ণ হচ্ছে প্রাচীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত একটি সামাজিক বিভাজন ব্যবস্থা, যার উৎপত্তি বেদ। সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্যসূত্র হিসাবে বেদই হচ্ছে সমাজের বর্ণ ব্যবস্থার উৎস। মূলত ব্রাহ্মণীয় দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত বর্ণ মতবাদ কোন একটি বিশেষ উপলক্ষে সৃষ্টি করা হয়েছিল যা কার্যত অপরিবর্তিত রয়ে যায়। জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখাই হল বর্ণভেদ ধারণা মূল বিষয়। জাতিগত ক্রোমউচ্চতা অনুযায়ী সমাজের সকল জাতিকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেনীতে ভাগ করা হয়েছে যথা-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ঋকবেদের সূক্তের ভাষ্য অনুযায়ী স্বয়ং ব্রহ্মাই চারটি বর্ণের সৃষ্টিকারী। ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণগণ সৃষ্ট হয়েছেন। যাদের কাজ পূজা অর্চনা ও শিক্ষাদান। বাহু থেকে সৃষ্ট হয়েছেন ক্ষত্রিয়গণ। যাদের কাজ দেশরক্ষা ও রাজ্য পরিচালনা করা। ব্রহ্মার উরু থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বৈশ্যদের। যাদের কাজ ব্যবসায় বাণিজ্য ও কৃষিকাজ। ব্রহ্মার পা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে শূদ্র্রদের। যাদের কাজ বাকি তিন উচ্চ বংশীয়দের সেবা করা। এই চার বর্ণের বাইরে আরো একটি বর্ণ আছে। এই পঞ্চম বর্ণটি হলো চন্ডাল বা অস্পৃশ্য। ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিচ্ছেদের ১৭ নং ধারায় অস্পৃশ্যতা কে নিষিদ্ধ ও অপরাধজনক ধরা হলেও বর্তমান ভারতের বহু অঞ্চলে তথাকথিত উচ্চবর্ণ, জাতির অবহেলা অব্যাহত রয়েছে।মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৩ সালে সমাজে অস্পৃশ্য বলে বিবেচনা করা লোকদের হরিজন নামে নামকরণ করে। হরিজনের অর্থ হচ্ছে হরি বা ভগবানের লোক। হরিজন শব্দটিকে ও পরে মর্যাদাহানিকর এবং অনুপালক বলে অনেকে বিবেচনা করে । সেজন্য এই শব্দটি বর্তমানে তেমন ব্যবহার করা হয় না। দলিত শব্দ ব্যবহারও কেরালা রাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।[ (উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ এর ”অস্পৃশ্যতা” থেকে)।
ফিরে আসি রংলালের কথায়। রংলাল জন্মগত ভাবে চার বর্ণের বাইরে পঞ্চম ভাগ অথাৎ চন্ডাল বা অস্পৃশ্য জাত। জন্মই যেন ওদের পাপ। সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার কারণেই দেশের সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে হরিজন সম্প্রদায়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথাটির বিষবৃক্ষ রোপণ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আর্যরা। তারপর বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী ক্রমাগত সেই জাত-পাতের বিভাজন করেই গেছেন। এই বিভাজন সামাজিকভাবে এমন নির্যাতনে রূপ নিয়েছিল যে, সমাজে নিম্নবর্ণের মানুষের টেকাই দায় হয়ে উঠেছিল। তাদের অস্থিত্বের সংকট শুরু হয়ে যায় রীতিমতো। ভারতবর্ষে এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি ঘটে বিভিন্ন ধর্মের। কিন্তু জাতিভেদের সংকট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা বাংলাদেশ থেকে আজও যায়নি। ইতিহাসে সোনার অক্ষরে নয়, কান্নার নীল হরফে লেখা রয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের কথা। রংলালের জীবনটাও এখন কান্নার জীবন,বড় কষ্টের জীবন।
হরিজন সম্পদায়ের মানুষকে কেন ‘অস্পৃশ্য’ মনে করা হয়? যে রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে তার সব নাগরিকের জন্য সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে, সেখানে কেন এই অন্ত্যজ, সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা সীমাহীন বৈষম্যের শিকার? এই একুশ শতকেও কেন তারা মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত? হরিজনেরা এ সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়গুলোর অন্যতম। তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক মর্যাদার অভাব যারপরনাই বেদনাদায়ক। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটি ক্রিয়াশীল, তা হলো তাদের প্রতি সমাজের বৃহত্তর অংশের হীন দৃষ্টিভঙ্গি। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যা বলেছেন তা এ রকম: হরিজনদের জন্য সুইপার বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর যেসব চাকরি বরাদ্দ আছে, এ সমাজের মানুষের সেসব পদে চাকরি করতে কোনো লজ্জা বোধ হয় না, কিন্তু তাদের পাশে বসে চা খেতে রুচিতে বাধে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মিজানুর রহমান সংগতভাবেই ‘বেহায়াপনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন রাষ্ট্র এটা সহ্য করতে পারে না; এটা বন্ধ করতে হবে এবং এখনই।
যাইহোক, অনেক দিন যাবৎ রংলালকে চোখে পড়ে না। ভাবলাম হয়তোবা মারা গেছে। ওর খুপরিতে গেলাম খোঁজ নিতে। ভীষন অসুস্থ। একটা ষ্টোক হয়েছে ওর স্ত্রীর কথা থেকে মনে হলো। শরীরের কিছু অংশের শক্তি হারিয়েছে। একটা চৌকিতে মরার মতো পরে আছে। আমাকে দেখে হাঁউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম। রংলাল কেঁদে কেঁদেই অস্পষ্ট ভাবে আকুল আকুতি জানিয়ে বললো, আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচতে চাই।
প্রিয় পাঠক, রংলাল একজন মানুষ। রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। ওর রক্তের রং আর আমাদের সকলেরই রক্তের রং -এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উপমহাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানটির কথা মনে করুন“ আমায় একজন সাদা মানুষ দাও, যার রক্ত সাদা, আমায় একজন কালো মানুষ দাও ,যার রক্ত কালো। যদি দিতে পারো- প্রতিদান, যা কিছু চাও পেতে পারো”। রংলাল একজন মানুষ। ওর প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিন। ওকে বাঁচান। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মানবিক সহযোগিতা কামনা করছি। মানুষ মানুষের জন্য। জীবন জীবনের জন্য- একটু সহানুভূতি-মানুষ কি পেতে পারে না?
নাজমুল হুদা পারভেজ
সহকারী অধ্যাপক,লেখক ও সাংবাদিক।
চিলমারী,কুড়িগ্রাম।
মোবাইল ও হোয়াটসএ্যাপঃ ০১৭১২৮৯৭৪৪২
মেইলঃ nhparvez1966@gmail.com