হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম:

কুড়িগ্রামে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পরেছে গরুর ল্যাম্পি স্কিন রোগ। এই রোগে মারা গেছে প্রায় ৫শতাধিক গরু। আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক হাজার পেরিয়ে গেলেও জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে নেই কোন তথ্য। বাজারে নেই প্রতিকারের কোন ঔষধ। গরুর স্যাম্পল পাঠিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। দারিদ্রপীড়িত এ জেলার মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন গরু হারিয়ে দিশেহারা হলেও দেখার যেন কেউ নেই।

জেলা পরিষদের সদস্য ও রাজারহাট এলাকার বাসিন্দা এনামুল হক জানান, রাজারহাটে এই রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পরেছে। ইতিমধ্যে এই উপজেলায় প্রায় দু’শতাধিক গরু ল্যাম্পি স্কিন রোগে মারা গেছে। এত গরু আক্রান্ত কিংবা মারা গেলেও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে কোন তথ্য নেই। সরকারিভাবে দ্রুত এই রোগের প্রতিষেধক ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করা না গেলে বড় লোকসানের মুখে পরবে গরু ব্যবসায়ীরা।

একই উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ডাংরারহাট এলাকার গরু ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান জানান, ‘অনেক আশা করি ৭টা বিদেশী গরু কিনি খামার দিছিলং। গত ১৫দিন আগোত ৯০ হাজার টেকা দামী একটা গরু মরি গেইছে। আরো একটা গরুর সেই রোগ হইছে। বাকীগুলাক নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছোং। এদন হইলে হামরা ফতুর হয়া যামো।’

একই এলাকার জোদ্দার আলী কুরবাণি ঈদে বিক্রি করার জন্য একটি গরু লালন-পালন করছিলেন। কিন্তু ঈদের এক সপ্তাহ আগেই ল্যাম্পি স্কীন রোগে গরুটি মারা গেছে। জোদ্দার আলী হতাশ কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে জানান, ‘ধারদেনা করি খরচপাতি করি গরুটেক সগাই মিলি বড় করছিলং। হঠাৎ রোগ ধরিল। অষুধপাতি দিয়া ডাক্তার ডাকি খুর চেষ্টা করলং। কিন্তু গরুটেক বাঁচপের পাইলং না। মেলা টেকা খরচ হয়া গেইল।’

অপরদিকে চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ কৃষকের ঘরের গোয়ালের গরুতে ল্যাম্পি স্কিন রোগ দেখা দিয়েছে। পল্লী চিকিসক কিংবা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে ধর্ণা দিয়েও কোন প্রতিকার না পেয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এখানকার গরু পালনকারীরা। ইউনিয়নের পাত্রখাতা গ্রামের বাসিন্দা গৃহিনী রওশন আরা জানান, ‘ছওয়া-পোয়ার খরচপাতি আর এখনা ভালো করি চলার জন্যে ৭টি গরু লালন-পালন করছিলং। কিন্তু আজগুবি একটা গরুর গায়োত ফোসকা ওঠা শুরু হইল। তারপর গা’র গোস্ত খসি পরা শুরু হইল। ডাক্তার-কবিরাজ-গাছনা অষুধ দিয়াও গরুটেক বাঁচপের পাইলং না। মোর আরো ৩টা গরুর রোগ হইছে। মুই তো চোখোত শর্ষে ফুল দেকপের নাগছং। এই গরুগুলা গেইলে মুই কি করি বাচিম।’ চরম হতাশা নিয়ে কথাগুলো বললেন গৃহিনী রওশন আরা। যে সন্তানের লালন-পালন আর ভালোভাবে চলার জন্য নিজের সন্তানের মত গরুগুলা লালন-পালন করছিলেন তার এমন দুরবস্তা দেখে কান্না চেপে রাখতে পারছেন না তিনি।

পাশর্^বর্তী পাড়ামৌলা গ্রামের নুরনাহার বেগম জানালেন, ‘হামার গ্রামোত অনেকগুলা গরু মারা গেইছে। এই গ্রামের ফকরুল, শমসের চাচা, শাহিনা চাচী, বাবু, শরিফুল, বিপ্লব ভাই এবং শমির দাদার একটা করি গরু রোগ হয়া মারা গেইছে। গত কয়েখ মাসে হমারা তিস্তা নদীর ১৮/২০টা গরু ভাসি যাইতে দেখছি।

গ্রামের মনোয়ারা বেগম জানান, ‘সরকারি ডাক্তার হামার গ্রামোত একদিনো আইসে নাই। গ্রামের পশু ডাক্তার আসলে গরুর গায়োত হাত েিবর চায় না। হামরায় গরু ধরি আর ওমরা ইনজেকশন দেয়। অষুধপাতি হামরা আনি খোওয়াই। ওমরা দুরোত থাকে। এটা এ্যালা কি রোগ, হামারগুলোর ক্ষতি হইবে কিনা জানি না। কাঁইয়ো কোন পরামর্শও দেয় না।’

গ্রামের আব্দুর রহমান জানালেন, হঠাৎ করি এই রোগ দেখা দিছে। এবার সবার বাড়ি বাড়ি এই রোগোত গরু মরবের নাগছে। প্রত্থমে গরুর গায়োত ছোট ছোট গুটি ধরে। তারপর বড় ফোসকা হয়া আগুনের মতো নাল হয়া যায়। অনেক সময় গায়ের গোস্তগুলা খসি খসি পরে। গরুর কান্দোন আর কষ্ট দেখলে মনটা খারাপ হয়া যায়’

বিষয়টি নিয়ে রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাইজুল ইসলাম জানান, ‘আমার ইউনিয়নের ব্যাপকহারে গরুর ল্যাম্পি স্কিন রোগ দেখা দিয়েছে। এতে অনেকের গরু মারাও যাচ্ছে। ফলে গরীব পরিবারগুলো বেশ লোকসানে পরছে। সরকারিভাবে মাইকিং করে লোকজনকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোশাররফ হোসেন বলেন, গত এপ্রিল মাস থেকে জেলায় ল্যাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে নাগেশ^রী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা থেকে ২৩টি গরুর নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্স ইন্সটিটিউটে পাঠিয়েছি। প্রতিষেধক না পাওয়ায় আক্রান্ত গরুকে অধিক পরিমাণে স্যালাইন, জ¦র হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ ও খাবার সোডা খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছি। এন্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহার না করে গরুগুলোকে মশারীর ভিতরে রাখার পারামর্শ দিচ্ছি। আক্রান্ত ও মৃত: গরুর তথ্য না থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, যেসব গরু আমাদের প্রাণিসম্পদ অফিসে চিকিৎসা নিতে আসে আমরা সেগুলোর হিসাব দিতে পারি কিন্তু বাইরের গরু আমাদের নজরদারীতে থাকে না বিধায় আমরাদের কাছে সেগুলোর কোন তথ্য থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *