হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম:
রাধাপদ রায় একজন চারণ কবি। আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক কবিতা লিখেছেন তিনি। লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন কাটানো এই মানুষটিকে নিয়ে এখন সবার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। একটি পারিবারিক ঘটনা তাকে নিয়ে এসেছে লাইমলাইটে। যে ঘটনার ডালপালা ছড়িয়েছে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ব্যাখ্যায়। কেউবা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে, কেউ বা হত্যাকান্ডে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন। অতি উৎসাহিদের কেউ কেউ বিষয়টি অন্যখাতে নেয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইতোমধ্যেই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ ও পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম নাগেশ^রী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চারণ কবির শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন। এছাড়াও নাগেশ^রী থানা পুলিশ আসামীদের ৩ স্বজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে দুই নম্বর আসামী কদু মিয়ার স্ত্রী, শ্যালক ও শশুর রয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সোমবার রাতে কুড়িগ্রামের নাগেশ^রী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কথা হয় চারণ কবি রাধাপদ রায়ের সাথে। তিনি জানান, এটা কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। আমার ও আমার পরিবারের প্রতি বিদ্বেষের কারণে ঘটনাটি ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। এর বিচার চাই আমি। অভিযুক্ত দুজনের বিরুদ্ধে আমার ছোট ছেলে যুগলচন্দ্র মামলা করেছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে বলে জেনেছি।
তিনি আরও জানান, কুড়িগ্রামের নাগেশ^রী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের মাদাইখাল গোড়ডারা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম সতীষচন্দ্র সরকার। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাড়িঘর বিক্রি করে স্বপরিবারে চলে যান ভারতে। পরে যুদ্ধ শেষে ভারতে কেনা বাড়ী বিক্রি করে চলে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। মায়ার টান তিনি এড়াতে পারেন নি। তাই ফিরতে হয় নিজ বাসভূমে। আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করেন তিনি। মাঝখানে টানাটানির কারণে তিনি বড়ছেলে মাধবকুমারসহ (৩০) ঢাকায় গিয়ে রড মিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। সেখানেই তার কবিতার হাতে খড়ি। তিনি লিখেছেন-
‘সম্পদ যদি থাকে করে সকলে পুজন
সম্পদ না থাকিলে তারে না করে গণন।
চন্দ্রহীন রাত্রী যেমন ঘোর অন্ধকার
সম্পদ বিহিন মানুষ যত আত্মীয়বান্ধব্ থাকুক তার
ফলজ বৃক্ষ যেমন সারে পক্ষিগণ
সম্পদ বিহিন মানুষ চেনে না কোনজন
দয়ামায়া কথার কথা পৃথিবী টাকার গোলাম
টাকা হলে বন্ধু জোটে বাপের মুখে হাসি ফোটে।’
এসময় বেশ কিছু কাব্য রচনা করেন তিনি। সমসাময়িক ঘটনা নিয়েই তার লেখালেখি শুরু। সেখানে ছন্দ আছে, রস আছে, আছে মাধূর্য। এই সময়ে ঢাকায় তার বড় ছেলে মাধবকুমারের সাথে কুড়িগ্রামের নাগেশ^রী উপজেলার পৌরসভাস্থ হাসেম বাজার এলাকার সহকর্মী শ্রমিক মিলন মিয়ার সাথে ৫শ’ টাকা নিয়ে বিবাদ বাঁধে। এই বিবাদের ঘটনা পৌঁছায় নাগেশ^রী অবধি। এনিয়ে একটি সালিস বৈঠক হয়। সেখানে বিবাদকৃত টাকা পরিশোধ করে মাধবকুমার। কিন্তু ঘটনার আরেক সাক্ষী এবং মিলনের পরিচিত তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নাগেশ^রী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের নন্দনপুর কচুয়ারপাড় গ্রামের মৃত: মোহাম্মদ আলীর ছেলে কদু মিয়া (৪০) ও রফিকুল ইসলাম একপ্রকার যেচে গিয়ে পাশর্^বর্তী গ্রামেরই চারণ কবি রাধাপদ রায়ের সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়।
রাধাপদ রায় জানান, কদু মিয়া আমার বাড়ীতে এসে টাকা লেনদেনের সেই ঘটনাটি নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধরণের তর্ক হয় সেই তর্কের বাইরে ছিল এই তর্কটি। তারা আমাকে ও আমার স্ত্রীকে হেয় করে কথা বলছিল। তারা বলছিল তোমাদের মারলে কে এগিয়ে আসবে! এরপর তারা আমার স্ত্রীকে অশ্রাব্য ভাষা ও ইঙ্গিত করে কথা বললে আমি সাথে সাথে প্রতিবাদ জানিয়ে বলি আমার বাড়ীতে এসে তোমরা এমন ভাষা ব্যবহার করে কথা বলো কেন, তোমাদের আমি ঘুষি মারবো। তিনি হাত নাড়িয়ে তাদের হুমকি দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কদু মিয়া জানান, এর প্রতিশোধ আমরা নেবো। দশ বছর হলেও ছাড়বো না।
এরপর এই ঘটনার কথা আমরা ভুলে যাই। সেই তর্কাতর্কির ঘটনার প্রায় ৭মাস পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর ভোর ৬টায় কদু মিয়া ও তার ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম হঠাৎ করে আমার উপর এসে হামলা করে।
তিনি জানান, আমি তখন নন্দনপুর ডুবুরীর ব্রীজের পারে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলাম। তখন সামনে হেলে মাছ তুলছিলাম। এসময় আসামী রফিকুল ইসলাম বাঁশ দিয়ে আমার পিঠে উপর্যুপরি আঘাত করে। তারপর তারা আমার চুল-দাঁড়ি ধরে মাটিতে ফেলে মারতে থাকে। এসময় রফিকুল আমার বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরে বলে আমার ভাইকে মারতে চাস, তোকে শেষ করে দিবো। আমি এসময় পিঠে ও কোমড়ে প্রচন্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হই। পরে আশেপাশের লোকজন এসে আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। এসময় রফিকুল ও কদু মিয়া আমাকে শাসাতে শাসাতে চলে যায়।
এ বিষয়ে রাধাপদ রায়ের ছোট ছেলে যুগলচন্দ্র জানান, আমি প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় বাবাকে উদ্ধার করে নাগেশ^রী স্বাস্থ্য কজমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। পরদিন ১ অক্টোবর বাদি হয়ে অভিযুক্ত দুইভাইকে আসামী করে নাগেশ^রী থানায় মামলা দায়ের করি। তারা বাবাকে অমানুষিকভাবে মারধোর করেছে। এতে আমি মানসিকভাবে খুব কষ্ট পেয়েছি।
রাধাপদ রায়ের মেয়ে শান্তনা রানী জানান, মাকে তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমরা এই বর্বর আচরণ ও ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
এ ঘটনা নিয়ে নাগেশ^রী প্রেসক্লাবের সভাপতি লিটন চৌধুরী জানান, এটি একটি অমানবিক ঘটনা। নাতির বয়সি ব্যক্তির হাতে একজন বয়োবৃদ্ধের নিগ্রহের ঘটনা মেনে নেয়া যায় না।
সচেতন নাগরিক কমিটি সনাক কুড়িগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত দু:খজনক। মামলা হয়েছে, আসা করছি আসামীরা দ্রæত আইনের আওতায় আসবে। তবে ঘটনাটিকে অনেকেই ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এটি আরো দু:খজনক। এটি কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়।
নাগেশ^রী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সাহেব আলী জানান, তাকে ফিজিক্যালি এ্যাসাল্ট করা হয়। তার পীঠে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এখনো ব্যাথা রয়েছে। তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
এ ব্যাপারে নাগেশ^রী থানার অফিসার ইনচার্জ আশিকুর রহমান জানান, এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। আসামীদের ধরতে জোর তৎপরতা চলছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আমরা অসুস্থ রাধাপদ রায়ের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছি। তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।