হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
কৃষকদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈবসার এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ফুলকপি চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছে কুড়িগ্রামের কৃষকরা। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা নিয়ে দ্বিগুণ লাভের পাশাপাশি রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
জেলার রাজারহাট উপজেলায় সবজির আঁধার খ্যাত ছিনাই ইউনিয়নের মহিধর ও মিস্ত্রিপাড়ার কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ফুলকপির বাম্পার ফলন পেয়েছে। উৎপাদন খরচ কমার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতেও সক্ষম হচ্ছেন এই অঞ্চলের কৃষক। নিরাপদ সবজি উৎপাদন হাব-ক্লাস্টার পদ্ধতির মাধ্যমে সমন্বতিভাবে কৃষকরা জমিতে ফেরোমন ফাঁদ বা বিষ টোপ এবং ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকা রোধ করছে। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে কৃষি পরিবেশ অঞ্চল অনুসারে সঠিক ফসলের জাত নির্ণয়, মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার, বীজতলা প্রস্তুত, চারা রোপন, সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে চারা রোপন। সময় মতো সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গাছ পাতলাকরণ, আগাছা দমন, জৈব সার প্রয়োগ করেন সময়মতো। এতে করে উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফসল উৎপাদন, মাটির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ হ্রাস, স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদন হচ্ছে। পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করে জমিতে চাষাবাদ করায় মাটিতে ক্ষুর অনুজীবের ক্রিয়াশীলতা ৩০-১০০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও মাটিতে উচ্চ মাত্রায় জৈব উপাদানের কারণে মাটিতে অনুজীবের ক্রিয়া এবং মাটির বুনা ঠিক থাকে। কীটনাশক ব্যবহার কমানোর কারণে উপকারী পোকামাকড়, মাছ, ব্যাঙ, পশু,পানি প্রভৃতি সংরক্ষণ হবার পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদন খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। সমন্বিতভাবে কৃষকরা প্রায় চার একর জমিতে ফুলকপি চাষাবাদ করেছেন। এতে করে বিঘা প্রতি ৩০/৩৫হাজার টাকা খরচ করে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন কৃষকরা। কীটনাশক ব্যবহার কমার কারণে শ্রমিকরাও স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন।
মহিধর গ্রামের কৃষক আলম বাদশা বলেন, আমি আরডিআরএস বাংলাদেশের পরামর্শ অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে প্রশিক্ষণ নিয়ে এক একরের বেশি জমিতে ফুলকপি চাষ করেছি। । এতে করে আমার কয়েক বছরের তুলনায় উৎপাদনে খরচ কম হয়েছে এবং আয় দ্বিগুণ হয়েছে।
একই গ্রামের কৃষক আনারুল জানান, বিগত বছরগুলোতে ফুলকপি চাষের সময় ১২ হতে ১৫বার পর্যন্ত কীটনাশক দিতে হয়েছে। এতে প্রায় তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এবার নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে আরডিআরএস বাংলাদেশের পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন কর্তৃক বিনামূল্যে ফেরোমন ফাঁদ বা বিষ টোপ এবং ফ্রুট ব্যাগ পেয়েছি। যেগুলো জমিতে ব্যবহার করে কীটনাশক ছাড়াই ক্ষতিকর পোকামাকড় মারা পরেছে। জমিতে এবার শুধু দু’ বার ব্যবহার করেছি। এতে আমার উৎপাদন খরচ কমেছে এবং জমির উর্বরতাও ঠিক রয়েছে।
কৃষাণী জামেনা জানান, আমি ৪০হাজার টাকার মতো ফুলকপি বিক্রি করতে পেরেছি। সামনে আরও ৭০হাজার টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো।সমন্বিতভাবে এই বিষ টোপ ব্যবহার করায় ক্ষয়ক্ষতিমুক্ত ফসল উৎপাদনে সকলে উপকৃত হয়েছে। এছাড়াও কীটনাশক ব্যবহার কমার কারণে শ্রমিকরা ভালোভাবে কাজ করতে পারছেন। আগের মতো এখন আর হাঁচি, মুখ জ্বালাপোড়া এবং জমিতে কীটনাশকের কোন গন্ধ নাকে আসে না।
আরডিআরএস বাংলাদেশের কৃষিবিদ আব্দুস সাত্তার বলেন, ২০২২সাল থেকে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। পরিবেশবান্ধব, মাটির উন্নয়ন, অধিক ফলন পেতে নিরাপদ সবজি হাব-ক্লাষ্টার পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য আমরা ফেরোমন ফাঁদ বা বিষ টোপ এবং ফ্রুট ব্যাগ এবং জৈব সার ব্যবহার করে কীটনাশককে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে কৃষকদের।
রংপুর আরডিআরএস বাংলাদেশের টিম লিডার বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, পল্লী-কর্ম সহায়ক ফাইন্ডেশনের আর্থিক এবং কারিগরী সহায়োগিতায় এবং আরডিআরএস বাংলাদেশের বাস্তবায়নে কুড়িগ্রাম সদর ও রাজারহাট উপজেলায় সম্বনিত কৃষি কর্মকান্ডের আওতায় ফুলকপি চাষে ব্যাপক সারা ফেলেছে। তিনি বলেন, কৃষক যদি অধিকহারে কীটনাশক ব্যবহার করে তাহলে মাটি দূষণ হবে,পানি দূষণ এবং বায়ু দূষণ হবে। এতে করে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়বে। অনিরাপদ খাদ্যের কারণে কারণে মানুষের হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ নানা রোগ বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশ বান্ধব ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং চাষীরা যেন অধিক ফলন পায় সেজন্য আমরা এই পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে কাজ করছি।
রাজারহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুন্নাহার সাথী বলেন, কৃষকদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন প্রকার সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা বিষমুক্ত সবজিচাষে কৃষকদের উদ্ভুদ্ধ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *