সিরাজী এম আর মোস্তাক
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রায় ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা নারী গণহত্যার শিকার হয়েছে কথাটি বাস্তব সত্য নাকি শুধু মুখে মুখেই প্রচারিত, তা স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশে উক্ত শহীদদের তালিকা ও স্বীকৃতি নেই। তাদের বংশ ও পরিবারের অস্তিত্ব নেই। ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির মধ্যে উক্ত বত্রিশ লাখ আত্মত্যাগীর সংখ্যা বিবেচনা করলে দেশের কেউই শহীদ পরিবারের বাইরে থাকার কথা নয়। অথচ বাংলাদেশে মাত্র সাতজন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত। প্রায় দুই লাখ ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত। শুধু এ তালিকাভুক্তদের পরিবারের সদস্যরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। আর গণহত্যার শিকার বত্রিশ লাখ শহীদ ও আত্মত্যাগী শুধু মুখে মুখেই প্রচারিত। তাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি না দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শুধু দিবস পালনে ব্যস্ত। আন্তর্জাতিক মহলেও সে দাবি উঠেছে। খোদ বাংলাদেশে যদি শহীদদের স্বীকৃতি, পরিচয় ও পরিবারের অস্তিত্ব না থাকে এবং তাদের সংখ্যা নিয়ে সত্য-মিথ্যা প্রশ্ন ওঠে, তা বিশ্ববাসী কিভাবে নেবে? বরং স্পষ্ট করতে হবে যে, বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। প্রায় বত্রিশ লাখ বাঙ্গালি উক্ত গণহত্যার শিকার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান স্বীকৃত। বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদের সংখ্যা সত্যরূপে ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক উক্ত শহীদের সন্তান ও তাদের পরিবারের সদস্য। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর সকল বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে গণহত্যার শিকার বত্রিশ লাখ শহীদ ও আত্মত্যাগীর ঘোষণা দিয়েছেন। (বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী ও পরবর্তীতে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা অনলাইনে সরাসরি শুনুন)। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নেতা ও পিতা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব স্বীকৃতির জন্য শহীদ ও গাজী মিলে মাত্র ৬৭৬ যোদ্ধাকে বিশেষ খেতাব দেন। এছাড়া দেশ-বিদেশের সকল সংগ্রামী বীরকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেন। তাঁর ঘোষণায় অন্তর্ভূক্ত ছিল সকল শহীদ-আত্মত্যাগী, তিনি নিজেসহ পাকিস্তানে আটক প্রায় পাঁচ লাখ বন্দী, প্রায় এক কোটি শরণার্থী, সকল প্রশিক্ষণার্থী, লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী ও জীবনদানকারী ভারতীয় সেনাদল এবং দেশে অবস্থানকারী কোটি কোটি সংগ্রামী জনতা। এতে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিল যে, এদেশে লাখো বাঙ্গালি গণহত্যার শিকার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি শহীদ-গাজী আলাদা করেননি। তাই তার শাসনামলে (১৯৭২-৭৫) মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের তালিকা করার প্রয়োজন ছিলনা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ভাতা বা কোটাসুবিধা চালু করেননি। তখন দেশের সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য। এভাবে বঙ্গবন্ধু সহজেই জাতিসংঘসহ বিশ্বের সমর্থন লাভ করেন। তিনি নিজেই ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস ঘোষণা করেন। আমরা উক্ত দিবসে গণহত্যাকারী নরপিশাচদের ঘৃণা করি আর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সকল শহীদ, আত্মত্যাগী ও বীর যোদ্ধাদের। বিশ্ববাসী এতে সমর্থন জানায়।
বঙ্গবন্ধুর পর অসাধু রাজনীতিবিদগণ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ৬৭৬ থেকে বাড়িয়ে প্রায় দুই লাখ করে। তারা শহীদদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করে। বঙ্গবন্ধুর ত্রিশ লাখ শহীদের ঘোষণা প্রশ্নবিদ্ধ করে। রাজনৈতিক স্বার্থে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে ব্যাপক সুবিধা দেয়। এতে বাংলাদেশে জাতি বিভাজন সৃষ্টি হয়। তাদের নীতিতে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, এম.এ.জি ওসমানি, লাখো শহীদ, আত্মত্যাগী, বন্দী, শরণার্থী ও যুদ্ধকালে দেশে অবস্থানকারী কোটি কোটি সংগ্রামী জনতা কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত বা তালিকাভুক্ত নন, শুধুমাত্র দুই লাখ ব্যক্তিই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চুড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত। উক্ত তালিকাভুক্তরা সগর্বে নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য পরিচয় দেয়। আর তালিকা বহির্ভূত সমগ্র জাতি তাদের পরিচয় হারায়। তারা না পারে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিতে, না পারে শহীদের সন্তান পরিচয় দিতে এবং না পারে বীর জাতি পরিচয় দিতে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার লাখো শহীদের আত্মত্যাগ বিকৃত হয়।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত আদালত তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাকিস্তানি ঘাতকদের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশিরা গণহত্যাকারী ও মানবতা বিরোধী অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণের আলোকে বিচারে তা প্রমাণ হয়েছে। এজন্য ইতিহাস গবেষণার প্রয়োজন নেই। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে কোনো পাকিস্তানি সেনা বা নাগরিক অভিযুক্ত হয়নি। তাদের সাজা হয়নি। তাদের বিরূদ্ধে গণহত্যার প্রমাণও মেলেনি। তাই আদালতে পাকিস্তানি নয়, শুধু বাংলাদেশিদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। তা বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশিরাই গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা নিজেরাই গণহত্যাকারী এবং গণহত্যার শিকার। আর উক্ত আদালত বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করেছে।
অতএব একথা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে গণহত্যার ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। গণহত্যার শিকার লাখো শহীদেরা বঞ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের বীর প্রজন্মকে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধীদের সন্তান হিসেবে লান্থিত করা হয়েছে। এজন্য উচিত, গণহত্যার শিকার সকল শহীদদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া। প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা বাতিল করা। বাংলাদেশের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারভুক্ত করা। তবেই প্রকৃত ঘাতকদের পরিচয় স্পষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশিরা নয়, আসল গণহত্যাকারীরা সাজা পাবে। বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা সঠিক হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে।
শিক্ষানবিশ আইনজীবি, ঢাকা।