মোঃ আশতাব হোসেন
এমন ভয়ঙ্কর কাণ্ড দেখে মানুষ ভয়ে দূরে সরে যায়। দীর্ঘদিন লোকজন সেই বিলের আশে পাশে যায়না। অনেক দিন পরে বিলটির উত্তর পাশে স্থাপিত হয় বিডিআর ক্যাম্প। কালের পরিবর্তনে মানুষ বেড়ে গেলে তিন দিকে গড়ে উঠে কিছু মানব বসতি। এখন অনেক বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে। জানা যায় বিলটি সৃষ্টি হওয়ার অনেক পরে গ্রীষ্মকাল এলে দূরদূরান্ত অর্থাৎ আশে পাশের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কিঃমিঃ দূর থেকেও অনেক মানুষ মাছ ধরার জন্য আসে। তখনকার দিনে লোকসমাগমের জন্য কোনো মাইকের ব্যবস্থা না থাকায় দূরের মৎস শিকারীদের মধ্যে কারও কারও থাকতো ভইষের আস্ত শিং দ্বার তৈরী বড় বাঁশি! তাদের সবাই সর্দার মনে করতো। সেই সর্দার খবর রাখতো কোথা কবে মাছ ধরা হবে বা বিল বাও দেয়া হবে। যেদিন অনেক দূরে কোনো বিলে মাছ ধরার পরিকল্পনা থাকলে সকালেই শিংগায় ফূঁ দিতে দিতে ধীর গতিতে সে দিকে যাত্রা শুরু করে আর সেই শিংগার পু -পা -ভু-ভু – হু-হু – হু বিকট শব্দ শুনে সকল মৎস শিকারী যার যে মাছ ধারার যন্ত্র আছে তাই নিয়ে দৌড়ে বেরর হয়ে পড়তো। যেদিকে শিংগার শব্দ শোনা যায় সে দিক অনুসরণ করে। এক শিংগার শব্দ যদি অন্য কোনো শিংগাওয়ালা কানে পোঁছে তখন সেই তার শিংগাটা বের করে ফুঁ দিতে দিতে একই রাস্তার দিকে যেতে থাকে। প্রধান শিংগাওয়ালা কিছু দূর যায় আর বসে বিশ্রাম করে সেই সাথে শিংগাতে মাঝে মাঝে ফুঁ দেয়।। শিংগার শব্দ শুনে কারও আর পথ চিনতে অসুবিধা হয়না। এভাবে মাছ ধরার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশাল অঞ্চলে, মানুষ কাদে করে চাকজাল, ঠেলাজাল, পলো ইত্যাদি নিয়ে ছুঁটতে থাকে মাছ ধরার জন্য। মাছ শিকারীর বেশে যখন অনেক লোক একত্রিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে হাঁটা শুরু করে তখন দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। যে রাস্তা দিয়ে যায় সে রাস্তার আশে পাশের নারী-পুরুষও শিশুরা কৌতূহল হয়ে দেখে সে দৃশ্য। আর যার তার মধ্যে কারও ঘরে মাছ ধারার যে কোনো একটা ব্যবস্থা থাকলেই সে দলে যোগ দিয়ে হাঁটা শুরু করে। ভইষকুড়ি বিলে মাছ ধরতে বেশি এসেছে তিলাই, পাথরডুবি, শিলকুড়ি, পাগলার হাট, এ সব অঞ্চলের মানুষ। তাদের বাড়ি ছিলো ভইষকুড়ি বিল থেকে কমপক্ষে ৩০কিঃমি দূর থেকে। এ ভাবে দলবদ্ধভাবে সকালে যাত্রা শুরু করে প্রায় দুপুর ১২টার সময় এসে পৌঁছে যেতো। যারা দূর থেকে এসেছে তারা এক দিনে ভইষকুড়ি বিলের আশে পাশের বিল যেমন ডাঙ্কার বিল, নয়েরছড়া ও ঝঘড়ুকুড়া নামে বিলগুলি থেকেও মাছ ধরেছে। এ সব বিলে সারা বছর পানি টুপটুপ ভরা ছিলো। মাছও থাকতো বিভিন্ন প্রজাতির অনেক এবং বড় বড়। যেমন: রুই,কাতল,বোয়াল, শোল গজার।
একদিন বেলা ১২টার সময় সজ্জিত মৎস্য শিকারীর দল শিংগা ফুঁকাতে ফুঁকাতে এসে ভইষকুড়ি বিলের এক পাশে সারিবদ্ধভাবে নেমে যায়, একজন অন্যজনের গায়ের সাথে গা লাগিয়ে প্রায়, তখন মনে হয় বিল ঘিরে ফেলছে বিশাল এক মানবজাল! এলাকার লোকজন বলতে থাকে ঐ দেখোরে বিলে বাউত নেমেছে। গ্রামের মানুষ এমন সুসজ্জিত মৎস্য শিকারীর দলেক বাউতও বলতো। বাউত নামার দৃশ্য দেখে বিলের আশে পাশের গ্রামের জোয়ান বুড়ো ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও যার বাড়িতে মাছ ধরার যে ব্যবস্থাই আছে তাই হাতে নিয়ে দৌড়ে ছুঁটে যায় বিলের দিকে। গিয়েই নেমে পড়ে বাউতদের পিছনে। অনেকেই খালি হাতে হাতরে হাতরে ধরে ছোট বড় কই, মাগুর, ভেদা, পুটি, টাকি, খৈলশা, টেংরা ইত্যাদি জাতীয় ছোট মাছ । অনেক লোক বিলটির চার পাশে দাড়িয়ে মজার দৃশ্য উপভোগ করে নয়নভরে! কিযে এক আনন্দনঘণ মুহুর্ত ! সে সব দৃশ্য আজও লেগে আছে স্মৃতির পাতায়! শিকারীদের সবার হাতে চাকজাল, চাকটির কাঠিগুলি বাঁশের তৈরী মোটা গোল , তার সাথে বাঁধা হয় গোলাকার পিছন দিক চিকন সুতার এক জাল। চিকন পাশের শেষ অংশে থাকে শক্ত মোটা লম্বা সুতা। সুতাটি পেচানো চাকটির মাথায়। গভীর পানিতে নামার আগে চাকটির মাথায় বেঁধে নেয় চিকন লম্বা শক্ত একটি বাঁশ। যারা গভীর পানি দিয়ে যাবে তারা ছিলো তন্ত্র মন্ত্র জানা সাহসী মৎস্য শিকারী! বুকভরা প্রত্যাশার তৃষ্ণা নিয়ে পানিতে নেমে সবাই চাক মেরে এগিয়ে আচ্ছে সামন দিকে! হঠাৎ চিৎকার করে বাউত বাচিক মিয়া বলছে লেগে গেছে একটা! বিলজুরে হৈ হৈ রব ডাঙ্গার সাধারণ দর্শকও মারহাবা মারহাবা আর হাতে তালি দিয়ে উৎসাহিত করছে শিকারীদের! বাচিক মিয়ে জলে ডুব মেরে তুলে আনে প্রায় দশ কেজি ওজনের এক কাতল গেঁথে ফেলে কোমড়ে বাঁধা হাইলচার সাথে! আবার শুরু করে চাক মারা সামনের দিকে। এক সাথে শত শত মানুষের চাকমারা মারা শব্দ ও আঘাতে বিলের পানি উত্তাল! মাছেরা ভয়ে দিক বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে! যেখানে দর্শক দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে সেখানেও মাছ দিশেহারা হয়ে লাফ দিয়ে পড়ছে! বিনাশ্রমে কেউ পেয়ে যায় বড় রুই, কাতল ও শোলমাছ! এক দুই কেজি ওজনের মাছ কেউ ধরতে পারলেই চুপ করেই গেঁথে ফেলে কোমড়ে বাঁধা হাইলচার সাথে! গভীর পানিতে নেমেছে সারির অনেক শিকারী, সাঁতরে সাঁতরে চলছে নিজ নিজ চাক মারা আর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। লেগে গেছে বড় একটা! চিৎকার করে বলে উঠে বেনু মিয়া! কেউ একজন সাহায্য করো। পাশের একজন চাকটি খুব জোরে নিচের দিকে চেপে ধরে আর বেনু মিয়া ডুব দিয়ে জাল ও চাকে পেঁচানো বড় এক বোয়াল তুলে আনে পানির উপরে, এনেই বড় সুঁচে লাগানো হাইলচায় গেঁথে বেঁধে রাখে কোমড়ে। আবার শুরু করে চাকমারা। যখন চাকজালে মাছ আটকা পড়ে তখন জালে বা চাকটির কাঠিতে মারে এক গুঁতো ! ঠিক তখনি ছেড়ে দেয় জালের পিছনে লাগানো লম্বা সুতাটি! মাছের গুঁতোগুঁতির ধরণ বুঝে বুঝতে পারে মাছ কতবড় হবে সেই অনুপাতে খুশির চিৎকারটাও হয়! দৌড়ে পালাতে গিয়ে জালের শেষ চিকন মাথায় গিয়ে বাধা পেয়ে উল্টে পেঁচে যায় জালে! তখনই শিকারী আর একটি পেঁচ মেরে দেয় পা দিয়ে বা ডুবে হাত দিয়ে বাঁশের কাঠির সাথে! বিলের প্রায় মাঝা মাঝি শিকারী দল, ছোট বড় অনেক মাছ ধরা পড়ছে হৈ হৈ রব আরও বেগবান! মাছ খাওয়ার চেয়ে ধরার মাঝে আনন্দটা বেশি। যাদের মাছ ধারার খুব নেশা তাদের ভূত পেত্নী ও দেও – দানবের কোনো ভয় থাকেনা।
চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন