চিলমারী, (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধিঃ
কুড়িগ্রামের চিলমারীতে গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজের বিনিময়ে খাদ্য(কাবিখা) ও টেস্ট রিলিফ(টিআর) প্রকল্প ঘিরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুই দফায় দেয়া সাধারণ ও বিশেষ বরাদ্দের আওতায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার ৩৪৮ টি প্রকল্প কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে এগুলোর অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সুত্রে জানাগেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষন টেস্ট রিলিফ(টিআর) ৩০৬টি প্রকল্পের বিপরীতে(সোলার প্যানেলসহ) ২৫৩.৬২ মেঃ টন খাদ্য শস্য ও ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬ হাজার ৯৯৯ টাকা এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য(কাবিখা) ৪২ টি প্রকল্পের বিপরীতে ৩০৮.১৫৪৩ মেঃ টন খাদ্য শস্য ও ৪২ লাখ ১৬ হাজার ৬৬ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখাগেছে, উপজেলার রমনা ইউনিয়নের মাঝিপাড়া মন্দির সংস্কার ও মাঠ ভরাটের জন্য ৫৮ হাজার ৩৫৭ টাকার বরাদ্দ প্রদান করা হয়। বাস্তবে বেশ কিছুদিন আগে ওই মন্দিরটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মন্দিরটি থাকা কালিন সময়ের সভাপতি নগেন্দ্র চন্দ্র দাস জানান, প্রায় ৭/৮ মাস আগে মন্দিরটি নদীগর্ভে বিলীন হয় এবং মাঝিপাড়া মন্দিরের নামে প্রকল্পের ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না। রমনা উত্তরপাড়া জামে মসজিদ সংস্কার কাজের জন্য ৫৮ হাজার ৩৫৭ টাকার বরাদ্দ দেয়া হলেও বাস্তবে মসজিদের কোন কাজ হয়নি। মসজিদটির সভাপতি মহির উদ্দীন মসজিদ সংস্কারের জন্য কোন বরাদ্দ পাননি বলে জানান। ওই প্রকল্পের প্রকল্প সভাপতি আবুল কাশেম সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আবুল কাশেম নামে একজন শিক্ষক ছিলেন যিনি অনেকদিন আগে মারা গেছেন। রমনা রেল স্টেশনের মাঠে মাটি ভরাট ও মেরামতের জন্য ২ মেঃটন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হলেও সেখানে কোন কাজ চোখে পড়েনি। রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের ফকিরেরহাট কবরস্থান, ঈদগাহ মাঠ ও জামে মসজিদের মাঠ ভরাট ও সংস্কার বাবদ প্রতিটি প্রকল্পের জন্য ৫৩ হাজার ১৮৮ টাকা করে পাশাপাশি ৩ টি প্রকল্পে মোট ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫৬৪ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও এগুলোর কোনটিতে কোন কাজ করা হয়নি। তেতুলকান্দি জামে মসজিদ ঘর মেরামত বাবদ ৫৩ হাজার ১৮৮ টাকা বরাদ্দ দেয়া থাকলেও মসজিদটির সহ-সভাপতি আঃ হাকিম বলেন, আমরা মসজিদের জন্য কোন বরাদ্দ পাইনি। রাণীগঞ্জ বাজার উচ্চ বিদ্যালয় ও মন্দিরের মাঠ ভরাট বাবদ প্রতিটি প্রকল্পের জন্য ৫৩ হাজার ১৮৮ টাকা করে মোট ১ লাখ ৬ হাজার ৩৭৬ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হলেও বাস্তবে মাঠে কোন মাটি ফেলা হয়নি। থানাহাট ইউনিয়নের থানাহাট মন্ডলপাড়া নুরানী মাদ্রাসায়, হাসিনা বেওয়া ও আব্দুল মাজেদ মন্ডলের বাড়ীতে সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য ১ লাখ ১০ হাজার ১৫৫টাকা প্রকল্পের বরাদ্দ দেয়া থাকলেও তা করা হয়নি। প্রকল্পটির সুবিধাভোগী আঃ মাজেদকে প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আঃ মাজেদের সাথে কথা হলে তিনি ওই প্রকল্প সম্পর্কে কিছু জানেন না এবং তিনি কোন সোলার পাননি বলে জানান। মাচাবান্দা হাটখোলা জামে মসজিদে সোলার স্থাপনের জন্য ২৮ হাজার ৭০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। প্রকল্পটির সভাপতি আব্দুল লতিফ মিয়া জানান, তিনি এখন পযন্ত মসজিদে কোন সোলার পাননি। মাচাবান্দা জামে মসজিদের(নতুন) মেঝে পাকাকরণ ও মাঠে মাটি ভরাট বাবদ দুটি প্রকল্পের প্রত্যেকটিতে ৫৮ হাজার ৩৫৭ টাকা করে মোট ১ লাখ ১৬ হাজার ৭১৪ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও বাস্তবে মসজিদের কোন কাজ হয়নি। মসজিদটির সভাপতি মোঃ লুৎফর রহমান জানান, মসজিদের মেঝে পাকাকরণ কিংবা মাঠে মাটি ভরাট কোনটির বরাদ্দের টাকা তিনি পাননি। উপজেলার অষ্টমীরচর, নয়ারহাট ও চিলমারী ইউনিয়নেও গৃহীত প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে একই চিত্র লক্ষ করা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ সিরাজুদ্দৌলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে প্রকল্প দেখিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের পকেটস্থ করতে সহায়তা করেছেন। জুন ক্লোজিং এর আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ায় তিনি তড়িঘড়ি করে যাচাই-বাচাই না করে কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দেন। পরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলাম বাকী প্রকল্প গুলোর অনুমোদন দেন। ফলে ওই অর্থ বছরে ৩৪৮টি প্রকল্পের বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়ম দেখা দিয়েছে। এতে সরকার প্রদত্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে কিছু প্রকল্পে নামমাত্র সোলার প্যানেল স্থাপন করা হলেও বাকি প্রকল্পগুলোর হযবরল অবস্থা দেখা দেওয়ায় সরকারীভাবে গৃহীত মহৎ উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কাজের নামগন্ধ নেই, প্রকল্প সভাপতিসহ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই, অথচ সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে টিআর-কাবিখার খাদ্য শস্য ও নগদ অর্থ। এভাবে বছরজুড়ে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষনের নামে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা পিআইও’র যোগসাজসে জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ সিরাজুদ্দৌলা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিটি প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করে বলেন, দেখে শুনে যাচাই-বাছাই করে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জুন ক্লোজিংয়ের আগে বদলী হয়ে যাওয়া বর্তমান কাহারোল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা’র সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ১ম দফার প্রকল্পে অনুমোদন দিয়েছিলাম। যাচাই-বাছাই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব পিআইও সাহেবের।
সে সময়ের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলামের সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করে মিটিংয়ে আছি বলে কেটে দেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি চলতি মাসের ৮তারিখে যোগদান করেছি, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের টিআর, কাবিখা প্রকল্পের কাজের বিষয়ে কিছু জানি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *